ধর্মীয় মেরুকরণের মুখে আসাম
ধর্মীয় মেরুকরণের মুখে আসাম - ছবি : সংগৃহীত
সদ্য আসাম আসাম বিধানসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দ্বিতীয়বার ভারতীয় রাজ্যটিতে ক্ষমতায় বসতে চলেছে বিজেপি-অগপ জোট। আসাম বিধানসভার ১২৬টি আসনের মধ্যে বিজেপি-অগপ জোট বিজয়ী ৭৫টি আসনে। অপরদিকে কংগ্রেস-এআইইউডিএফ জোট বিজয়ী ৫০টি আসনে।
১.
আসামে বিজেপির প্রধান এজেন্ডা হলো অবৈধ বাংলাদেশী (!) মুক্ত আসাম গঠন করা। বিজেপি ও অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের দাবি বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক অবৈধ অভিবাসী গিয়ে আসামের জনমিতিতে পরিবর্তন এনেছে। অসমীয়াদের মতে, অবৈধ বাংলাদেশীদের (!) কারণে আসামে অসমীয়রা এখন সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে। আর তাই এনআরসি করে সব বহিরাগতকে (তাদের মতে) ভারত থেকে বিতাড়িত করতে হবে।
বিজেপি অবশ্য এদিকটায় একটা পরিবর্তন এনেছে। বিজেপির মতে, সব বাংলাদেশীকে (!) বের না করে শুধুমাত্র বাংলাদেশী মুসলমানদের বিতাড়িত করা হবে। আর অমুসলিম বাংলাদেশীদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। বিজেপি আসামের জাতিগত সমস্যাকে ধর্মীয় মোড়কে নিয়ে গেছে। আগে আসামে সমস্যা ছিলো বাঙালি-অসমীয়া জাতিগত, বিজেপির নতুন পলিসি সমস্যাটিকে হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় রূপ দান করেছে।
সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের এই রাজনীতিতে গত কয়েক বছর যাবৎই উত্তাল আসাম। বিজেপি কয়েক দফা বহিরাগত বিতাড়ন কর্মসূচি শুরু করতে যেয়েও তা পারেনি। কিন্তু এবারের নির্বাচনে বিজেপির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতে আসার মাধ্যমে আগামী দিনে বহিরাগত বিতাড়ন কর্মসূচি পূর্ণগতিতে শুরু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২.
আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকাটি সম্পূর্ণভাবে বাঙালি মুসলিম অধ্যুষিত। অপরদিকে ব্ৰহ্মপুত্ৰ ভ্যালির কিছু জেলা মুসলিম (বাঙালি+অসমিয়া) অধ্যুষিত আর বাকি জেলাগুলো অসমীয়া (মূলত হিন্দু) ও উপজাতি (মূলত খ্রিস্টান) অধ্যুষিত। এছাড়া বাঙালি হিন্দু বরাক উপত্যকার একটা জেলায় সংখ্যাগুরু এবং বাকি আসামজুড়ে ছড়িয়ে আছে।
আসামে সর্বমোট মুসলিম ১ কোটি ৪০ লাখ। যার মধ্যে বাঙালি মুসলিম ৯৭ লাখ আর বাকি ৪৩ লাখ অসমীয়া জাতির মুসলিম। এই ৪৩ লাখ মুসলিমের জাতীয়তা নিয়ে অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের সমস্যা নেই। অসমীয়া মুসলমানদেরকে বহিরাগত মনে করে না অসমীয়া জাতীয়তাবাদীরা। অসমীয়াদের প্রধান সমস্যাটা হচ্ছে ৯৭ লাখ বাঙালি মুসলমানকে নিয়ে এবং বেশিরভাগ অসমীয়া হিন্দু বাঙালিকেও আসাম থেকে বিতাড়িত করতে চায়। তবে বিজেপির ভিন্ন রাজনৈতিক পলিসির কারণে আপাতত অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের দৃষ্টি বাঙালি মুসলমান বিতাড়নের দিকে। বিজেপি সফলভাবে জাতীয়তাবাদী সমস্যাকে ধর্মীয় সমস্যায় রূপান্তরিত করেছে।
আসামের এবারের নির্বাচনে বিজেপি-অগপ জোটের প্রধান এজেন্ডা
* বাঙালি মুসলমান মুক্ত আসাম বাস্তবায়ন!
আর কংগ্রেস-এআইইউডিএফ জোটের প্রধান এজেন্ডা ছিলো
* যেকোনোভাবে এনআরসি প্রতিহত করা!
কার্যত আসামের এবারকার নির্বাচন স্পষ্টই গণভোটে রূপ নিয়েছিলো এনআরসির পক্ষে বিপক্ষে। আর এই গণভোটে বিজয়ী হয়েছে বিজেপি জোট!
আর সবচেয়ে বড় বিষয়, অসমীয়া ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনগুলোতে জিততে পারেনি কংগ্রেস জোট। অপরদিকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনগুলোতে জিততে পারেনি বিজেপি জোট।
অর্থাৎ মুসলিমরা সর্বান্তকরণে চেয়েছে কংগ্রেস-জোট ক্ষমতায় এসে এনআরসি প্রতিহত করুক। আর অসমীয়া ও বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠী চেয়েছে বিজেপি ক্ষমতায় এসে এনআরসি হোক!
আসামে মোট মুসলিম এমএলএ নির্বাচিত হয়েছে ৩১ জন। যার সবাই কংগ্রেস-এআইইউডিএফ জোট থেকে নির্বাচিত। বিজেপি-অগপ জোট থেকে একজন মুসলিম প্রার্থীও জয়ী হতে পারেনি।
নির্বাচনী ফলই বলে দিচ্ছে, আসামে স্পষ্টত দুটি মেরুকরণ তৈরি হয়েছে।
৩.
বরাক উপত্যকার (সাবেক সিলেট জেলা) তিনটি জেলার মধ্যে দুটি বাঙালি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং একটি বাঙালি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ।
ক) হাইলাকান্দি (ধর্মীয়ভাবে ৬০% মুসলিম। জাতিগতভাবে ৮৫% বাঙালি, ৭% হিন্দিভাষী)
* এই জেলার তিনটি আসনের তিনটিই পেয়েছে কংগ্রেস-এআইইউপিডিএফ জোট।
খ) করিমগঞ্জ (ধর্মীয়ভাবে ৫৭% মুসলিম। জাতিগতভাবে ৮৭% বাঙালি, ৬% হিন্দিভাষী)
* এই জেলার ৫টি আসনের ৩টি পেয়েছে কংগ্রেস-এআইইউপিডিএফ জোট এবং বাকি দুটি পেয়েছে বিজেপি-অগপ জোট।
গ) চাঁচাড় জেলা (৩৮% মুসলিম। জাতিগতভাবে ৭৫% বাঙালি, ৯% হিন্দিভাষী)
* এই জেলার ৭টি আসনের মধ্যে ৩টি পেয়েছে কংগ্রেস-এআইইউপিডিএফ জোট এবং বাকি ৪টি পেয়েছে বিজেপি-অগপ জোট।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বরাক উপত্যকার দুটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলায় কংগ্রেস-এআইইউপিডিএফ জোট ভালো করেছে এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ চাঁচাড় জেলাতে বিজেপি-অগপ ভালো করেছে।
৪.
লোয়ার আসামের ১২টি জেলার মধ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা ৫টি।
ক) ধুবড়ি (ধর্মীয়ভাবে ৮০% মুসলিম। জাতিগতভাবে ৩০% বাঙালি, ৬৬% অসমীয়া)
* এই জেলার ৫টি আসনের মধ্যে ৫টি আসনই কংগ্রেস-এআইইউপিডিএফ জোট পেয়েছে।
খ) বড়পেটা (ধর্মীয়ভাবে ৭১% মুসলিম। জাতিগতভাবে ৬২% বাঙালি, ৩৬% অসমীয়া)
* এই জেলার ৬টি আসনের মধ্যে টিই কংগ্রেস-এআইইউপিডিএফ জোট পেয়েছে।
গ) গোয়ালপাড়া (ধর্মীয়ভাবে ৫৮% মুসলিম। জাতিগতভাবে ৩০% বাঙালি, ৫২% অসমীয়া)
* এই জেলার ৪টি আসনের মধ্যে ৪টিই কংগ্রেস-এআইইউপিডিএফ জোট পেয়েছে।
ঘ) বনগাঁও (ধর্মীয়ভাবে ৫০% মুসলিম। জাতিগতভাবে ৪৫% বাঙালি, ৫০% অসমীয়া)
* এই জেলার ৩টি আসনের মধ্যে ২টি কংগ্রেস-এআইইউপিডিএফ জোট এবং বাকি একটি বিজেপি-অগপ জোট পেয়েছে।
ঙ) সাউথ সালমারা ( ধর্মীয়ভাবে ৯৫% মুসলিম। জাতিগতভাবে ৪০% বাঙালি, ৫৯% অসমীয়া)
* এই জেলার ২টি আসনের মধ্যে ২টিই কংগ্রেস-এআইইউডিএফ জোট পেয়েছে।
অর্থাৎ লোয়ার আসামের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোর ২০টি আসনের ১৯টিই কংগ্রেস-এআইইউডিএফ জোট এবং বাকি ১টি বিজেপি জোট পেয়েছে।
এছাড়াও লোয়ার আসামের মুসলিম প্রভাবিত তিনটি জেলায় মোটামুটি ভালো করেছে কংগ্রেস-ইউডিএফ জোট।
ক) কামরূপ ( ৪০% মুসলিম )
* এই জেলার ৬টি আসনের মধ্যে ২টি কংগ্রেস-ইউডিএফ জোট এবং ৪ টি পেয়েছে বিজেপি-অগপ জোট।
খ) নালবাড়ি ( ৩৫% মুসলিম )
* এই জেলার ৩ টি আসনের মধ্যে ১টি কংগ্রেস-ইউডিএফ জোট এবং বাকি ২টি বিজেপি-অগপ জোট পেয়েছে।
গ) কোকরাঝাড় ( ২৮% মুসলিম )
* এই জেলার ৩টি আসনের মধ্যে ১টি কংগ্রেস-ইউডিএফ জোট এবং বাকি ২টি বিজেপি-অগপ জোট পেয়েছে।
লোয়ার আসামের মুসলিম প্রভাবিত জেলাগুলোর ১২টি আসনের মধ্যে ৪টি আসন পেয়েছে কংগ্রেস-ইউডিএফ জোট।
লোয়ার আসামের বাকি ৪টি অমুসলিম প্রভাবিত জেলায় বাকি ১০টি আসনের মধ্যে ৮টি বিজেপি এবং ২টি কংগ্রেস জোট পেয়েছে।
অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, লোয়ার আসামের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলায় বিজেপি যেমন ভোট তুলতে পারেনি, ঠিক তেমনি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলায় কংগ্রেস জোট ভোট পায়নি।
৫.
সেন্ট্রাল আসামে মোট জেলা ৮টি। তার মধ্যে তিনটি জেলা মুসলিম অধ্যুষিত।
ক) নওগাঁ (ধর্মীয়ভাবে ৫৫% মুসলিম। জাতিগতভাবে ২৯% বাঙালি, ৬৩% অসমীয়া)
* এই জেলার ৮টি আসনের মধ্যে ৫টি কংগ্রেস-ইউডিএফ জোট এবং বাকি ৩টি বিজেপি-অগপ জোট পেয়েছে।
খ) মরিগাঁও (ধর্মীয়ভাবে ৫৩% মুসলিম। জাতিগতভাবে ২২% বাঙালি, ৭৩% অসমীয়া )
* এই জেলার ৩টি আসনের মধ্যে ১টি কংগ্রেস-ইউডিএফ জোট এবং বাকি ২টি বিজেপি-অগপ জোট পেয়েছে।
গ) হোজাই (ধর্মীয়ভাবে ৫৪% মুসলিম)
* এই জেলার ৩টি আসনের মধ্যে ১টি কংগ্রেস-ইউডিএফ জোট এবং বাকি ২টি বিজেপি-অগপ জোট পেয়েছে।
সেন্ট্রাল আসামে কংগ্রেস জোট মোট সাতটি আসন পেয়েছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই তিন জেলা থেকে। বাকি পাঁচটি জেলাতে কংগ্রেস জোট কোনো আসন পায়নি। অর্থাৎ স্পষ্ট মেরুকরণ!
৬.
নর্থ আসামে ৭টি জেলার মধ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা একটি মাত্র।
ক) দ্বারাং (ধর্মীয়ভাবে ৬৪% মুসলিম। জাতিগতভাবে ৪৯% বাঙালি, ৪৯% অসমীয়া)
* এই জেলার ৪টি আসনের মধ্যে ৩টি কংগ্রেস-ইউডিএফ জোট এবং বাকি ১টি বিজেপি-অগপ জোট পেয়েছে।
নর্থ আসামের ২১টি সিটের মধ্যে কংগ্রেস জোট পেয়েছে ৫টি আসন, যার তিনটিই দ্বারাং জেলা থেকে।
* আপার আসামে কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা নেই। আপার আসামের ২৮টি আসনে কংগ্রেস জোটের ঝুলিতে তাই আসন সংখ্যা মাত্র ৪টি।
৭.
আসামের নির্বাচনের জেলাভিত্তিক ফলাফল স্পষ্ট করে দিচ্ছে, আসামে দুটি স্পষ্ট মেরুর তৈরি হচ্ছে। একদিকে বাঙালি মুসলিমরা আসামে টিকে থাকার লড়াইয়ে গা-উজাড় করে ভোট দিয়েছে কংগ্রেস জোটকে। অপরদিকে অসমীয়া ও বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠী নিরঙ্কুশভাবে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে দ্রুত এনআরসি বাস্তবায়নের পথে সহযোগী হতে।
আসাম থেকে যদি সত্যি সত্যি নাগরিক বের করে দেয়ার ঘটনা ঘটে তবে এর সরাসরি ভুক্তভোগী হবে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে এমনিতেই বহু সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে যদি আবার উত্তর দিক থেকে শরণার্থী ঢেউ আসে তবে তা ঢাকাকে নিশ্চিত দুশ্চিন্তায় ফেলবে।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের উচিত আগে থেকে রাজনৈতিক কিছ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
* আসামের জাতিগত এবং ধর্মীয় বিভেদকে তাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যু মনে না করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে।
* আসামে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশের ঠুনকো অভিযোগকে মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয়ভাবে গবেষণা করে প্রমাণ করা যে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসী আসামে যায়নি। ভারতীয় কিছু এজেন্সির মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় সাধারণ অসমীয়রাও মনে করে, বাংলাদেশ থেকে মাইগ্রেট হয়ে লাখ লাখ মানুষ আসামে বাস করছে। এই বিভ্রান্তি দূর করতে হলে বাংলাদেশকে যথেষ্ট প্রমাণ ও গবেষণার সাথে বাংলাদেশী মাইগ্রেন্ট যে মিথ, তা প্রচার করতে হবে।
* এনআরসির বিরুদ্ধে সোচ্চার ভারতীয় রাজনীতিবিদের (যেমন : মমতা ব্যানার্জি) সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তৈরি করা উচিত সরকারের। এতে করে অভ্যন্তরীণ চাপে পড়ে এনআরসি করতে হিমশিম খাবে ভারত সরকার।
সর্বোপরি বলা যায়, আসাম সঙ্কট নিয়ে এখনই মাথা না ঘামালে পরে আসাম থেকে হয়তো মিয়ানমারের মতো শরণার্থীর ঢেউ বাংলাদেশের বুকে নেমে এলেও আসতে পারে। (আল্লাহ এমনটি না করুক।)