সাইপ্রাস সঙ্কট ও তুরস্কের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ
সাইপ্রাস সঙ্কট ও তুরস্কের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ - ছবি : সংগৃহীত
পূর্ব ভূ-মধ্যসাগর এবং সন্নিহিত অঞ্চল বিশ্ব রাজনীতির মনোযোগের অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে আসার সাথে সাথে এই অঞ্চলের রাজনীতিতে যে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে তা এখানকার ঘটনাবলির গতি প্রকৃতিতে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গ্রিস তুরস্ক লিবিয়া মিসর আর সাইপ্রাসকে নিয়ে অক্ষ এবং পাল্টা অক্ষ তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে এখানকার নৌপথ এবং তেল সম্পদে কর্তৃত্বে প্রচেষ্টাকে সামনে রেখে। এর সাথে সক্রিয় রয়েছে ইসরাইল ফ্রান্স এবং আরব আমিরাতের মতো দেশও। আর এই মেরুকরণে সাইপ্রাসের ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র ১১ লাখ জনসংখ্যার এই দ্বীপদেশটির অবস্থান এমন একটি কৌশলগত স্থানে যার কারণে সাইপ্রাসের বিরোধ নিষ্পত্তি এই অঞ্চলের গতি নির্ণীত হবার জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিরোধ নিষ্পত্তিতে জাতিসঙ্ঘ
সাইপ্রাস ইস্যু নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াটি নতুন করে জোরদার হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এ জন্য আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করার আগে গত ২৭ থেকে ২৯ এপ্রিল সুইজারল্যান্ডে ‘ফাইভ প্লাস ওয়ান’ নিয়ে এক অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বসেন। যেখানে তুরস্ক গ্রিস যুক্তরাজ্য এবং গ্রিক ও তুর্কি সাইপ্রিয়ট নেতারা অংশগ্রহণ করেছেন।
জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের প্রতিবেদন অনুসারে, এই বৈঠকে তুর্র্কি সাইপ্রিয়টরা যে অবস্থান প্রকাশ করেছেন, তা হলো ক্রানস মন্টানার সর্বশেষ প্রচেষ্টাসহ সাইপ্রাস ইস্যু সমাধানের জন্য সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। দ্বি-অঞ্চল, দ্বি-সম্প্রদায়ভিত্তিক ফেডারেশনের আলোচনার প্রচেষ্টা শেষ হয়ে গেছে। তুর্কি সাইপ্রিয়টদের অন্তর্নিহিত সার্বভৌম সাম্য রয়েছে এবং তারা সমান আন্তর্জাতিক মর্যাদার দাবিদার। আর সাইপ্রাস সঙ্কটের সমাধান বর্তমান বাস্তবতা অনুসারে দুটি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদান এবং এই দুই রাষ্ট্র একে অপরকে সহযোগিতা করার ভিত্তিতে সহাবস্থান করার মাধ্যমেই সম্ভব।
অন্য দিকে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের সম্মেলন-উত্তর রিপোর্ট অনুসারে, গ্রিক সাইপ্রিয়ট প্রতিনিধি দল যে অবস্থান প্রকাশ করেছে সেটি হলো ক্রানস মন্টানায় যেখানে সাইপ্রাস সঙ্কট নিরসনের চেষ্টা থেমে গেছে সেখান থেকেই আলোচনা আবার শুরু করা। এর অর্থ হলো, দ্বি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবে তাদের সম্মতি নেই। ফেডারেল ব্যবস্থা এবং দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান কোনোটা না করে এখনকার অবস্থাকেই মূলত তারা টেনে নিয়ে যেতে চান।
জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রাসঙ্গিক প্রস্তাবগুলোর ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমতা নিয়ে দ্বি-অঞ্চল, দ্বি-সম্প্রদায়ভিত্তিক ফেডারেশনের ভিত্তিতে একটি নিষ্পত্তি অর্জনের প্রচেষ্টায় কফি আনান জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব থাকাকালে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই প্রস্তাবে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের সার্বভৌম ঘাঁটি অঞ্চল বাদে সাইপ্রাসের পুরো দ্বীপটিকে নিয়ে ইউনাইটেড সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্র গঠন করা হবে। এই নতুন দেশটি দুটি নির্বাচনী ইউনিটের একটি ফেডারেশন হবে, একটি হবে গ্রিক সাইপ্রিয়ট রাজ্য; অন্যটি তুর্কি সাইপ্রিয়ট রাজ্য। একটি ফেডারেল সরকার সমন্বিতভাবে রাষ্ট্রটি পরিচালনা করবে। এই ফেডারেল স্তরটি সুইস ফেডারেল মডেলের ওপর ভিত্তি করে গঠিত হবে যেখানে বর্তমান জনসংখ্যার ভিত্তিতে বরাদ্দকৃত (চারজন গ্রিক সাইপ্রিয়ট এবং দু’জন তুর্কি সাইপ্রিয়ট) ছয় সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্রপতি পরিষদ থাকবে। আর সংসদ দ্বারা নির্বাচিত অতিরিক্ত তিনজন ভোটারবিহীন সদস্যকে ২:১ অনুপাতে নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রেসিডেন্ট কাউন্সিলের পাঁচ বছরের মেয়াদি কার্যকালে প্রতি ২০ মাসে তাদের কার্যক্রমে এ কাউন্সিল কর্তৃক প্রত্যেক সম্প্রদায়ের সদস্যের মধ্য থেকে একজনকে প্রেসিডেন্ট এবং একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হবে। রাষ্ট্রে দুই কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা থাকবে। এর একটি সিনেট (উচ্চকক্ষ) থাকবে যার ৪৮ জন সদস্য দুই সম্প্রদায় থেকে ২৪:২৪ এ বিভক্ত হবেন। অপর সভাটি হবে চেম্বার অফ ডেপুটিজ (নি¤œকক্ষ)। এর ৪৮ জন সদস্য দুই সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার অনুপাতে বিভক্ত হবেন। তবে কোনো সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব ১২ জনের কম হবে না। সমান সংখ্যক গ্রিক সাইপ্রিয়ট এবং তুর্কি সাইপ্রিয়ট বিচারক নিয়ে একটি সুপ্রিম কোর্ট থাকবে। এতে আরো তিনজন বিদেশী বিচারক থাকবেন যারা রাষ্ট্রপতি পরিষদ দ্বারা নিযুক্ত হবেন। পরিকল্পনার মধ্যে একটি ফেডারেল সংবিধান, রাষ্ট্রের প্রতিটি উপাদান গঠন, সাংবিধানিক ও ফেডারেল আইনগুলোর একটি স্ট্রিং এবং ইউনাইটেড সাইপ্রাস প্রজাতন্ত্রের পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীতের প্রস্তাবও ছিল।
প্রস্তাবে দুটি সম্প্রদায়কে একত্র ও অতীতের বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য একটি পুনর্মিলন কমিশনেরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। প্রস্তাব অনুসারে, গ্রিস এবং তুরস্ক উভয়ই এই দ্বীপে স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে পারত, যদিও সৈন্য সংখ্যা পর্যায়ক্রমে হ্রাস পাওয়ার কথা ছিল।
২০০৪ সালে সাইপ্রাস বিরোধ নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে কফি আনান পরিকল্পনাটি অনুমোদনের জন্য উত্তর সাইপ্রাস এবং দক্ষিণের সাইপ্রিয়ট রিপাবলিক উভয় অংশে গণভোটের ব্যবস্থা করা হয়। এই গণভোটে তুর্কি সাইপ্রিয়টদের ৬৫.৫ শতাংশ এই পরিকল্পনার পক্ষে ভোট দিয়ে তা অনুমোদন করেন। অন্য দিকে গ্রিক সাইপ্রিয়টদের ৭৪ শতাংশ এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে তা নাকচ করে দেন।
গত ২৯ এপ্রিলের অনানুষ্ঠানিক সভা শেষে গুতেরেসের মুখে কিছুটা হতাশার সুর বেজে ওঠে। তিনি বলেন, ‘এটি কোনো সহজ সভা ছিল না। আমরা অভিন্ন জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা করার জন্য দ্বিপাক্ষিক এবং পূর্ণাঙ্গ বৈঠকের ধারাবাহিকতায় ব্যাপক পরামর্শ নিয়েছি। সত্য হলো, আমাদের প্রচেষ্টার শেষে আমরা সাইপ্রাস সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক আলোচনা পুনরায় শুরু করার জন্য পর্যাপ্ত কমন ভিত্তি খুঁজে পাইনি। তবে আমি হাল ছাড়ি না। আমার অ্যাজেন্ডা খুব সহজ। তা হলো কঠোরভাবে গ্রিক সাইপ্রিয়টস এবং তুর্কি সাইপ্রিয়টদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের জন্য লড়াই করা, যারা একসাথে শান্তিতে ও সমৃদ্ধিতে বাস করার উপযুক্ত। আর তাই, আমরা একমত হতে পেরেছি, অদূরভবিষ্যতে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে অভিন্ন অবস্থানে পৌঁছানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ৫+১ (পাঁচটি পক্ষ এবং জাতিসঙ্ঘ) এর আরেকটি বৈঠক ডাকব। আমরা এই সংলাপটিকে এগিয়ে নিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।’
জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বলেছেন, একটি বোঝাপড়া ছিল যে, দুই থেকে তিন মাস সময় কাঠামোয় সমঝোতা কার্যকর হতে পারে। যদি এ সময়ের চেয়ে খুব কম হয় তবে এটি কোনো অর্থবহ ফলাফল আনবে না। যদি এটি দীর্ঘ হয়, তবে এটি কোনো নিষ্পত্তিমূলক সমাধানে সহায়তা করবে না।
‘গ্রিক এবং তুর্কি সাইপ্রয়টদের অবস্থান একটি বৃত্তকে বর্গাকারে নিয়ে আসার মতো’। এটি কি আসলেই সম্ভব হবেÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে গুতেরেস বলেন, বৃত্তটিকে বর্গ করা জ্যামিতিতে অসম্ভব; তবে এটি রাজনীতিতে খুব সাধারণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান খুব পরিষ্কার। সেক্রেটারি-জেনারেল হিসাবে আমার একটি ম্যান্ডেট রয়েছে এবং সেটি নিরাপত্তা পরিষদ দিয়েছিল। অবশ্যই এই বৈঠকে উল্লেখিত বিভিন্ন অবস্থানের বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদকে অবহিত করব।
সঙ্কটের উৎস কোথায়?
মাত্র ১১ লাখ জনসংখ্যার সাইপ্রাস দ্বীপটি ১৯৬০ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের ১৪ বছর পর ১৯৭৪ সাল থেকে বিভক্ত হয়ে আছে। এ সময় গ্রিসের সাথে দ্বীপটিকে অন্তর্ভুক্তকরণের লক্ষ্যে গ্রিক সাইপ্রিয়ট অভ্যুত্থানের পরে দ্বীপের তুর্কিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা শুরু হয়। আর গ্যারান্টার শক্তি হিসাবে আঙ্কারার হস্তক্ষেপ ঘটে সাইপ্রাসে। ফলে ১৯৭৪ সালে উত্তরাংশে তুর্কি সাইপ্রিয়টদের আলাদা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে উত্তর সাইপ্রাস স্বাধীনতা ঘোষণা করে ১৯৮৩ সালে রউফ দেঙ্কতাসের নেতৃত্বে। এরপর বিভিন্ন সময় সাইপ্রাসে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়; কিন্তু কোনটি সেভাবে সফল হয়নি।
বর্তমানে তুর্কি রিপাবলিক অব নর্থ সাইপ্রাসের (টিআরএনসি) জনসংখ্যা চার লাখ। তুরস্ক ছাড়া অন্য কোনো দেশ রাষ্ট্র হিসাবে এটিকে স্বীকৃতি না দিলেও গণতন্ত্র এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার দিক থেকে এটি একটি মডেল। দেশটির বিষয়ে ২০১৬ সালের ফ্রিডম হাউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, যখন রাজনৈতিক অধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতার কথা আসে তখন এটি ‘মুক্ত’।
পুনর্মিলন আর কি সম্ভব?
এই দুই রাজ্যকে একই রাষ্ট্রে একীভূত করার জন্য কফি আনানের ফর্মুলার বাস্তবায়ন ছিল সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উদ্যোগ যেটি তুর্কি সাইপ্রিয়টরা মেনে নিলেও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন গ্রিক সাইপ্রিয়টরা। এভাবে একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পর দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রস্তাবিত ফর্মুলাটি বর্তমান স্থিতাবস্থার রাষ্ট্রিক বৈধতা প্রদান করবে, যেখানে গ্রিক সাইপ্রিয়টরা দ্বীপের দক্ষিণাঞ্চল পরিচালনা করবেন এবং তুর্কি সাইপ্রিয়টরা উত্তর অংশটি পরিচালনা করবেন। এটি রাষ্ট্রিক স্বীকৃতি পেলে তুর্কি সাইপ্রিয়ট রাষ্ট্রটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি স্বাধীন দেশ হবে।
২০১৪ সালের পর থেকেই মূলত একীভূত সাইপ্রাস গঠনের বিষয়টি আর বাস্তবে রূপায়িত হবে বলে আশা থাকেনি। ২০১৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর উত্তর সাইপ্রাসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুদ্রেত জজারে বলেন, ইস্যুটির দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানটি ‘হাতের কাছে’। ২০২০ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি উত্তর সাইপ্রাসের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে এরসিন তাতার বলেছিলেন, ‘জবরদস্তিমূলক বিয়ে সফল হতে পারে না’। তিনি বিশদভাবে বলেন, ‘আমরা আলাদা, আমরা তুর্কি ভাষায় কথা বলি এবং তারা গ্রিক ভাষায় কথা বলে। আমরা মুসলমান এবং তারা খ্রিষ্টান। নতুন প্রজন্ম একে অপরকে একেবারেই জানে না। ১৯৭৪ সালের ১০ বছর বয়সী একটি শিশু এখন ৫৫ বছরের; তার নাতি-নাতনি রয়েছে। আমরা পৃথক হয়ে গেছি।’
বর্তমান বিভক্ত মানচিত্র
শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং একত্রকরণের নানা উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পর টিআরএনসির প্রেসিডেন্ট এরসিন তাতার স্পষ্টভাবেই বলেছেন, তার দেশ এমন একটি প্রস্তাব চায় যা সাইপ্রাস দ্বীপে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সহাবস্থান সৃষ্টি করবে। গত নভেম্বরে, প্রতিদ্বন্দ্বী সাইপ্রিয়ট নেতারা একটি ‘ব্রেক-দ্য আইস’ বৈঠক করেছেন যাতে তারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন শান্তি বাহিনীকে বাইরের শক্তির সাথে জড়িত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অক্টোবর মাসে আঙ্কারা সমর্থিত তাতার তুর্কি সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এটি তাদের প্রথম এবং একমাত্র বৈঠক ছিল।
সাধারণভাবে তুরস্ক পুনরায় একীভূত হবার বিকল্প হিসাবে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের পক্ষে সমর্থন জানায়। বিশেষত তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোগান ২০১৪ সালে তুর্কি সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর নিকোসিয়ায় যাবার পর এটি একরকম স্পষ্ট হয়ে যায়। গ্রিক সাইপ্রিয়ট মিডিয়া দাবি করে যে, জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতাভিত্তিক শান্তি প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানটি তুরস্ক চাপিয়ে দিয়েছে। তুর্কি সাইপ্রিয়টদের প্রশ্ন, জাতিসঙ্ঘের ব্যর্থতার পর আলাদা রাষ্ট্র না করে কি উত্তর সাইপ্রাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে দক্ষিণ সাইপ্রাসের সাথে বিলীন হয়ে যাবে?
২০০৯ সালের এপ্রিলে, সাইবিসির এক মতামত জরিপে দেখা যায়, গ্রিক সাইপ্রিয়টদের বেশির ভাগই বিভাজনকে সমর্থন করেন। ২০১০ সালের মতামত জরিপ অনুসারে, গ্রিক সাইপ্রিয়টদের ৮৪ শতাংশ এবং তুর্কি সাইপ্রিয়টদের ৭০ শতাংশ এই অনুভূতির সাথে একমত হন যে ‘ন্যায্য ও টেকসই নিষ্পত্তির জন্য যে অপরিহার্য আপত্তি রয়েছে, তা অন্য পক্ষ কখনো গ্রহণ করবে না।’
২০১২ সালের নভেম্বরে এক ইউরোপীয় সামাজিক জরিপে বলা হয় যে, গ্রিক সাইপ্রিয়টদের ১৮ শতাংশ স্থিতাবস্থার পক্ষে এবং ৩১.২ শতাংশ এর পক্ষে বা বিপক্ষে ছিল না তবে প্রয়োজনে তা গ্রহণ করতে পারে। জরিপে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ৪৯.২ শতাংশ গ্রিক সাইপ্রিয়ট বর্তমান পরিস্থিতির বিপরীতে ছিল না এবং ২৭.৬ শতাংশ দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের বিরোধী ছিল না। অন্য দিকে গেজিসির ২০২০ সালের জানুয়ারির এক জরিপে দেখা গেছে, তুর্কি সাইপ্রিয়টদের মধ্যে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের সমর্থন হার ছিল ৮১.৩ শতাংশ।
গ্রিক সাইপ্রিয়টরা এখন দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের বিরোধিতা করলেও সমনাগরিক মর্যাদার ভিত্তিতে একক ফেডারেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাব তারাই প্রত্যাখ্যান করেছে। জাতিসঙ্ঘ একটি ফেডারেল মডেলের ওপর ভিত্তি করে সাইপ্রাসের পুনর্মিলনের মাধ্যমে এই বিরোধের সমাধান অর্জনের চেষ্টা করেছিল।
আনান প্ল্যানের উপর গণভোটের পরে, জাতিসঙ্ঘ তুর্কি সাইপ্রিয়ট জনগণের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় তাদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং উত্তর সাইপ্রাসের সাথে প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের আহ্বানকে তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করা হয়েছে।
গণভোটের পর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমরা অবশ্যই তুর্কি সাইপ্রিয়ট পক্ষের বিচ্ছিন্নতা সহজ করার পদক্ষেপগুলো দেখছিলাম। সাইপ্রাসে আমাদের রাষ্ট্রদূত গত সপ্তাহে তুর্কি সাইপ্রিয়টদের ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে একটি পদক্ষেপ ঘোষণা করেছিলেন যা তাদের ভ্রমণকে সহজতর করেছে। আমরা অন্যান্য পদক্ষেপের দিকে নজর রাখব যা আমরা নিতে পারি এবং উপযুক্ত সময়ে সেগুলো বলা হবে।’
তখনকার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এক বিবৃতিতে বলেন, আমাদের এখন উত্তর সাইপ্রাসের বিচ্ছিন্নতা অবসানে কাজ করতে হবে। এর অর্থ বাণিজ্য ও ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নেয়া। এর অর্থ, এটিও নিশ্চিত করা যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের তহবিলগুলো বর্তমান বাস্তবতাকে সামনে রেখে বিতরণ করা হবে।
ইউরোপীয় কমিশনও গভীরভাবে আক্ষেপ করে যে, গ্রিক সাইপ্রিয়টরা সাইপ্রাস সমস্যার ব্যাপক নিষ্পত্তি অনুমোদন করেনি, তবে ইইউ জনগণের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তকে সম্মান করে। এতে করে দীর্ঘস্থায়ী সাইপ্রাস সমস্যার সমাধান আনার একটি করার সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। ইউরোপীয় কমিশন তাদের ‘হ্যাঁ’ ভোটের জন্য তুর্কি সাইপ্রিয়টদের আন্তরিকভাবে অভিনন্দন জানায় এবং উল্লেখ করে, এটি দ্বীপের সমস্যা সমাধানের জন্য সম্প্রদায়ের সুস্পষ্ট আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত দেয়। সাইপ্রাসের উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক বিকাশে আরো উন্নয়নের উপায়গুলো বিবেচনা করতে কমিশন প্রস্তুত রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
ভূ-কৌশলগত সমীকরণ
সাইপ্রাস সমস্যার সমাধানের জন্য উদ্বেগ সর্বদা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেখা গেলেও জড়িত সব পক্ষই তা সমাধানের পরিবেশ সৃষ্টিতে আগ্রহী ছিল না। দ্বীপে দুটি সম্প্রদায়ের সাম্য এবং রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব বিবেচনায় একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে গ্রিক সাইপ্রিয়ট সরকারের দাবি অস্বীকার করার বিষয়ে তাদের অনীহা, একটি বাস্তববাদী ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তিপূর্ণ সমাধানে ছিল প্রধান বাধা।
এর আগে না হলেও ১৫৭১ সালে অটোম্যান বিজয়ের পরে সাইপ্রাস পূর্ব ভূমধ্যসাগরের কৌশলগতভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ হিসাবে রয়ে গেছে। প্রথমত, ভেনিসবাসীদের কাছ থেকে ফরাসিরদের গৃহীত বাণিজ্যিক কৌশলগত নিয়ন্ত্রণের ভূ-মধ্যসাগরীয় কাঠামো এতে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ব্রিটিশদের ভূ-কৌশলগত কাঠামো গ্রহণ করার বিষয়টিও রয়েছে। ব্রিটিশরা লেবাননে ফরাসিদের দখলের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের সাথে যোগাযোগের জন্য নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে সাইপ্রাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। চলমান বৈশ্বিক শক্তির পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করে একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরে সাইপ্রাসের কৌশলগত সম্ভাবনা এবং টিআরএনসির জন্য তাদের প্রভাব অনুসন্ধানেও কাজ হচ্ছে। বাকু-সিহান পাইপলাইন প্রকল্পের বাস্তবায়নের সাথে সাথে সাইপ্রাস সেকেন্দারুন উপসাগরের সাথে একটি নতুন কৌশলগত গুরুত্ব অর্জন করবে।
ইউরোপের পূর্ব ভূ-মধ্যসাগর সীমানা এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে কঠিন সীমানা। মূলত ইউরোপের দুর্বলতম সদস্য গ্রিসের ওপর নির্ভর করে এই সীমানা আঁকতে হয়েছে। সেখানে দেয়ালগুলো ভাঙা সহজ ছিল, প্রতিরক্ষা লাইনগুলোও সবচেয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং দুর্বল বলে মনে হয়েছিল। সাম্প্রতিক অতীতে, গ্রিসে একটি গুরুতর নীতি পরিবর্তন চলমান বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সাইপ্রাস এবং ইজিয়ান বিরোধগুলোর সমাধান সংক্রান্ত এই পরিবর্তন সত্ত্বেও গ্রিস শর্তাধীন আলোচনার মাধ্যমে এবং তৎক্ষণাৎ তুরস্ক থেকে আরও ছাড় পাবার জন্য এই রূপান্তর তৈরিতে জোর দিয়েছিল।
উনিশ এবং বিংশ শতাব্দীতে কৌশলগত সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ ছিল উপসাগরীয় গুরুত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট। উপসাগরীয় যুদ্ধের সাথে আমরা এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছি, যেখানে কেন্দ্র মধ্য প্রাচ্যের তেল রুটের সাথে রেখে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মধ্য প্রাচ্যের তেল নিয়ন্ত্রণে কারা থাকবে তা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ উভয়ের জন্য উচ্চ অগ্রাধিকার। এর অর্থ, একটি সুপার পাওয়ারের পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরে ধারাবাহিক উপস্থিতি। এই শতাব্দীর প্রথমার্ধেই তাৎপর্যপূণভাবে মধ্য এশীয় তেল রুটের অংশটি সেকেন্দারুন উপসাগরের দিকে পাইপলাইন দিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই নতুন ফ্যাক্টরটি পূর্বাঞ্চলীয় ভূমধ্যসাগর সাধারণভাবে এবং সাইপ্রাসের বিশেষভাবে গুরুত্ব বাড়াতে সহায়তা করবে। এটি নিয়ন্ত্রণের একটি উপায় হিসাবে কৌশলগত সেকেন্দারুন উপসাগর ছাড়া প্রতিরক্ষা চিন্তা করা অবাস্তব হবে। এ কারণে এর সাথে সাইপ্রাস রেফারেন্স হিসাবে চলে আসবে। তুরস্কের জন্য পূর্বাঞ্চলীয় ভূ-মধ্যসাগরে নিজের অবস্থান উন্নত করার জন্য স্থানীয় ও আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে সাইপ্রাসের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গ্রিসের সাম্প্রতিক অতি সক্রিয় তৎপরতা এবং দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের বিরোধিতা করে অচলাবস্থার মধ্যে সাইপ্রাস সংকটকে আটকে রাখার পেছনে একটি মূল কারণ হলো, লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হবার পর তুরস্ক এই অঞ্চলে যে প্রাকৃতিক গ্যাস আহরণের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে, তা সীমিত করা। এ জন্য তাড়াহুড়ো করে গ্রিস সাইপ্রাস ইসরাইল মিসর মিলে সমুদ্রসীমা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর বিপরীতে তুরস্ক লিবিয়ার সাথে যে সমুদ্রসীমা চুক্তি করে যার সাথে মিসরকেও সংযুক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে, তা পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরে তুরস্ককে সীমিত করার প্রচেষ্টাকে সফল হতে দেয়নি। সাইপ্রাসের দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এই অঞ্চলের সমুদ্রসীমা বিরোধ নির্ণয়েও একটি বড় ভূমিকা রাখবে। সাইপ্রাসের সমাধানের বিষয় এই অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ণয়ের জন্য এই কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি হয়ে গেলে ২০২৩ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে অনেক বড় এক পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে। এই পরিবর্তন ঠেকাতেই হয়তোবা তুরস্কে বার বার অভ্যুত্থান ঘটিয়ে এরদোগান শাসনের অবসান ঘটানোর চেষ্টা চলছে।
mrkmmb@gmail.com