আফগানিস্তানে কি শান্তি ফিরবে?
আফগানিস্তানে কি শান্তি ফিরবে? - ছবি : সংগৃহীত
আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন জো বাইডেন৷ ট্রাম্প আমলে কাতারের দোহায় একটি চুক্তি সই হয়েছিল। সেই চুক্তিতে মে মাসের মধ্যে সেনা প্রত্যাহারের উল্লেখ ছিল।
বাইডেন সেটা বাড়িয়ে সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ নির্ধারণ করেছেন। ইতোমধ্যে সেনা প্রত্যাহারের কাজ শুরু হয়ে গেছে৷
বিশ্বে যতগুলো সংকট রয়েছে এর মধ্যে আফগানিস্তান অন্যতম৷ দেশটির অর্ধেক লোকই দরিদ্র সীমার নিচে বাস করে। খনিজ সম্পদ ভরপুর দেশটি আধুনিক যুগে এসেও উন্নতির রঙে রঙিন হতে পারেনি। এর পিছনে সাম্রাজ্যবাদীদের দায় থাকলেও দেশটির নেতারাও সমান অপরাধে দোষী।
যুদ্ধবাজ নেতারা ক্ষমতার ভাগ বাঁটোয়ার নিয়ে আজ পর্যন্ত একক কোনো ফর্মুলা তৈরি করতে পারেনি। তাই প্রশ্ন উঠছে যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহার করলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? শান্তির শ্বেত পায়রা কি উড়তে শুরু করবে? আদৌ কি যুক্তরাষ্ট্র সব সেনা সরিয়ে নিবে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার আগে একটু পিছনের ইতিহাসে চোখ বুলিয়ে আসা যাক।
বারাক ওবামার সময় সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা এসেছিল। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ২০১১ সালে সকল মার্কিন সৈন্য প্রত্যহার করবেন। পরে এই সময়সীমা বাড়িয়েছেন, যা ট্রাম্প আমল পেরিয়ে বাইডেন আমলে স্থিত হয়েছে।
বারাক ওবামার সময়ে তালেবানের সাথে শান্তি আলোচনা শুরু হয়েছিল। ওই লক্ষ্যে গঠিত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট বোরহানউদ্দিন রব্বানি।
এক হামলায় বোরহানউদ্দীন রব্বানি নিহত হন। সেই সময়ের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই তালেবানের সাথে শান্তি আলোচনা বাতিল করে দেন৷
একই বছরে কারজাই ভারতের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করে। বর্তমান সরকার প্রধান আশরাফ গানির সাথেও ভারতের সখ্য রয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্র ভারতের মাধ্যমে আফগানিস্তানে প্রভাব ধরে রাখতে চায়৷ ব্লিংকেনের সফরের সময় এমন আভাসই স্পষ্টতর হয়েছে।
উল্লেখ্য, হামিদ কারজাই শৈশবে ভারতের শিমলায় পড়াশোনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি আলোচিত কোম্পানি ইউনোকলের উপদেষ্টাও ছিলেন।
নতুন করে পুনরায় শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা শোনা গেলেও খেয়াল করার বিষয় হলো এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন আফগান সরকারের সাথে তালেবানদের কোনো আলোচনা হয়নি। সেনা প্রত্যাহার হলে কোন উপায়ে শান্তি আলোচনা হবে তার কোনো ফর্মূলাও তৈরি হয়নি। আবার সর্বশেষ তুরস্ক সম্মেলনেও তালেবান নেতারা যোগ দেয়নি।
আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিন দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। এর ব্যাপারেও তালেবানদের পক্ষ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। এদিকে দোহায় তালেবান মুখপাত্র আল জাজিরার কাছে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করেছে। তাই বলাই যায়, শান্তি প্রতিষ্ঠা এখনও অনেকটাই অনিশ্চিত।
এই অবস্থা সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেই সময়ে সোভিয়েত বাহিনী চলে যাওয়ার পর দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। কারণ সোভিয়েত বাহিনী চলে গেলেও সরকার পক্ষের সাথে মুজাহেদীন বাহিনীর কোনো আপস-রফা হয়নি।
এখন যুক্তরাষ্ট্র সব সৈন্য সরিয়ে নেয়ার পর পুনরায় গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এমন অবস্থার সৃষ্টি হলে আখেরে লাভবান হবে যুক্তরাষ্ট্র। দুই যুগের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি পূরণের হাতিয়ার হতে পারে এই গৃহযুদ্ধ। আবার শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও লাভের গুড় যুক্তরাষ্ট্রের ভাগেই যাবে।
ইরাক যুদ্ধের পর দেশটির পুনর্গঠনে মার্কিন কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। শান্তি ফিরে এলে পরবর্তী কাজ হলো বিধস্ত দেশের পুনর্গঠন। এর পিছনে অর্থের যোগান নিশ্চিত করতে খনিজ সম্পদ উত্তোলন শুরু হলে মার্কিন কোম্পানিগুলোই এখানে এগিয়ে থাকবে। আবার মধ্য এশিয়া থেকে জ্বালানি পাইপলাইন নির্মাণে আফগানিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহারেও মার্কিন কোম্পানি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে।
গৃহযুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতাসীন সরকারকে সকল ধরণের সহায়তা দিবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। সেনা প্রত্যাহার করে নিলেও যুক্তরাষ্ট্র আশপাশে অবস্থান করতে চায়। মধ্য এশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ওমান প্রভৃতি দেশে ঘাঁটি গড়তে যুক্তরাষ্ট্র কাজ শুরু করেছে এমন খবরও প্রকাশিত হচ্ছে।
এ লক্ষ্যে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গঠন করেছে C5+1 জোট৷ অন্য দেশগুলোর সাথেও আলোচনা চলছে। তবে এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রকে অনেক বেগ হতে হবে। রাশিয়া মধ্য এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে ঘাটি গড়ার সুযোগ দিবে না এটা নিশ্চিত। কিছুদিন আগেও রাশিয়া ও তাজিক সামরিক মহড়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় খারাপই বলা যায়। বাইডেনকে পুতিনকে হত্যাকারী তকমা দিয়েছেন, রাশিয়ার উপর অবরোধ আরোপ করেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ মন্তব্য করেছেন, রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক প্রতিযোগিতার পথ ছেড়ে বিবাদের রাস্তা ধরেছে।
স্মরণ করিয়ে দেই, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনায় মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার মানাস ঘাটি ব্যবহার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানের সহায়তায় উপসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত সামরিক ঘাটি থেকে খোস্ত প্রদেশে মিসাইল হামলা হয়েছিল। বেলুচিস্তান প্রদেশে যুক্তরাষ্ট্রকে ঘাটি বানানোর সুযোগ দিয়েছিল পাকিস্তান।
আগেই বলেছি আফগান সংকটে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে দিয়ে স্বার্থ হাসিল করতে চায়। নতুন খবর হলো যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাথে 'Expeditionary Base' চুক্তি করতে চায়৷
এই চুক্তি হয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনে ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারবে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ভারত এই প্রস্তাবে রাজি হয়েও যেতে পারে।
এই চুক্তি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে চাপের মধ্যে রেখেছে। এক্ষেত্রে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে একটা অস্ত্র তুলে দিয়ছে। টিকা তৈরির সরঞ্জাম আমদানিতে বাইডেন প্রশাসনের অবরোধ আরোপ সেই ইংগিতই প্রদান করছে।
একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে আফগান সংকটে চালকের আসনে বসাতে চায়, অন্যদিকে গলা চেপে ধরতেও কোনো রাখঢাক করছে না। এখন দেখার বিষয় সন্ত্রাস দমনে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় ভূখণ্ড ব্যবহারের সুযোগ পায় কিনা।
যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকেও একই প্রস্তাব দিয়েছে। দেশটি এই প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। বোঝা যায়, ইমরান খানের সরকার কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। এই প্রস্তাবে রাজি হলে পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা বেড়ে যাবে, তালেবানদের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কেরও চরম অবনতি ঘটবে।
সেনা প্রত্যাহার নিয়ে বাইডেনের সাথে পেন্টাগনের মতপার্থক্যের খবরও শোনা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এখনই নিশ্চিত করে বলা যায় না আফগানিস্তান সংকট দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে। সেনা প্রত্যাহারের কাজ শুরু হলেও যেকোনো সময়ই থমকে যেতে পারে। পরিস্থিতি পুনরায় ঘোলাটে হলে নতুন করে সেনা মোতায়েনের ঘোষণা এলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। অতীত ইতিহাসে এমন নজির রয়েছে।
সর্বোপরি দীর্ঘ দিনের আফগান সংকট কবে শেষ হবে তা কেউ বলতে পারেনা। সাম্রাজ্যবাদীদের গোরস্থান খ্যাত দেশটি ঘিরে বিশ্ব রাজনীতি ক্রমেই জমজমাট হয়ে উঠছে। একসময় দেশটিতে যুদ্ধ পরিচালনায় যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করেছে চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তান৷ এবার ওই কাতারে কে শামিল হবে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে?