ইরান-সৌদি নেপথ্য সমীকরণ
ইরান-সৌদি নেপথ্য সমীকরণ - ছবি : সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যে পুনরায় অবস্থান নির্ধারণের সর্বশেষতম উদাহরণ হলো সৌদি আরব ও ইরানে নতুন বোঝাপড়ার প্রচেষ্টা। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) গত সপ্তাহে তার দেশের সরকারি গণমাধ্যমকে জানান যে তিনি ইরানের সাথে 'একটি ভালো ও বিশিষ্ট সম্পর্ক' চান।
পারস্পরিক উপকারী ও ইতিবাচক সম্পর্ক বিকাশের জন্য সৌদি আরব ও তার আঞ্চলিক অংশীদারদের যে সমস্যা রয়েছে তা সমাধানের ইচ্ছাও এমবিএস প্রকাশ করেছেন।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাঈদ খতিবজাদেহ এমবিএসের উষ্ণ বার্তাগুলোকে স্বাগত জানান, যা আলাপ আলোচনা ও সহযোগিতার নতুন যুগের সূচনায় ইরানের আগ্রহের ইঙ্গিত দেয়।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে গোপনে দু'দেশের কর্মকর্তারা বৈঠক করছেন।
এটা কোনো গোপন বিষয় নয় যে বাইডেন প্রশাসনের ইয়েমেন ত্যাগ করার পর সৌদিরাও বিচ্ছিন্নতা থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। ইরানবিরোধী ব্লক নির্মাণের বিষয়টি বাদ দেয়ার ব্যাপারে সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের সিদ্ধান্তের অনেক দিক রয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সর্বাধিক চাপের নীতি, উপসাগরীয় নেতাদের সহযোগিতায় একটি কৌশল তৈরি করা- এসব তেহরানকে আলোচনায় বসাতে ব্যর্থ হয়েছিল। পারমাণবিক চুক্তি পুনর্বহাল করতে আগ্রহী, বাইডেন প্রশাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর ১২টি শর্তে জোর দেয়ার সম্ভাবনাও কম।
দ্বিতীয়ত, উপসাগরীয় অঞ্চলের দুই উচ্চাভিলাষী ক্রাউন প্রিন্সের এ অঞ্চলটিকে নতুন আকার দেয়ার জন্য একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যার কারণে মারাত্মকভাবে ইমেজ সংকটে পড়া এমবিএস 'ভিশন ২০৩০' বাস্তবায়ন এবং চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছেন।
তবুও, ওয়াশিংটন সফরে তিনি এক মাস কাটিয়ে তার যে আন্তর্জাতিক অবস্থানটি তৈরি করেছিলেন ওই অবস্থা এখন নেই। আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ (এমবিজেড) ঘুরে ফিরে বন্ধ দরজার পিছনে সম্পর্ক মেরামত করার চেষ্টা করছেন। একটি নতুন আঞ্চলিকব্যবস্থার জন্য তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে এবং তার দেশ ইরান ও তুরস্ক উভয়কেই কোণঠাসা করার চেষ্টা সফল করতে পারেনি।
আসলে তাদের কাতার অবরোধও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আনতে পারেনি। উপসাগরীয় দেশগুলো ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারী এ মিশন বাতিল করে দেয়, যদিও দোহা তাদের তুরস্কের সামরিক ঘাঁটি বন্ধসহ কোরো দাবিতে রাজি হয়নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃশ্যমান কাজ
তদুপরি, এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চল থেকে প্রত্যাহার অব্যাহত রাখবে। আফগানিস্তান থেকে পশ্চাদপসরণের পরে ইরাকের দিকে তারা মনোনিবেশ করবে এবং সিরিয়ায় বাড়তি কিছু করার পরিবর্তে বিদ্যমান প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার ব্যাপারে ওয়াশিংটন মনোনিবেশ করবে বলে মনে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি কেবল আঞ্চলিক শক্তি নয়, রাশিয়ার মধ্যেও প্রতিযোগিতার ইচ্ছাকে বাড়িয়ে তুলবে।
সর্বশেষে তবে অগুরুত্বপূর্ণ নয়, সমস্ত খেলোয়াড় উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কগুলো পুনরুদ্ধার করতে এবং ক্ষমতার উদীয়মান ভারসাম্যের আলোকে নতুন করে শুরু করার চেষ্টা করছে। রাষ্ট্রগুলো এখনই সাবধানতা অবলম্বন করছে যাতে পরবর্তী ক্ষমতার লড়াইয়ের সময় অসাবধানতায় বৈরি কিছু না ঘটে।
মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) সাথে তুরস্কের সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের প্রচেষ্টার পাশাপাশি সৌদি আরব ও ইসরাইলের সাথে ডি-এস্কেলেশন ব্যাপারে সৃষ্ট গুজব প্রত্যক্ষভাবে এই বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত। একইভাবে, ইসরাইল জানে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়ের পরে আরব দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াটি ধীর হয়ে গেছে এবং তারা এও জানে যে এই নতুন অধ্যায়ে ইরান আরো শক্তিশালী হাত থাকবে।
সম্পূর্ণ নতুন শুরু?
তুরস্ক, সৌদি আরব, মিসর, ইরান ও ইসরাইলের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো তাত্ক্ষণিক ফলাফল পাওয়ার জন্য নতুন করে শুরু করার জন্য সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের প্রচেষ্টা নেবে এমনটি আশা করা যায় না। কোনো পক্ষই বড় ছাড় দিতে রাজি হবে না আর এ কারণে তাদের সাথে আপস করতে হবে, প্রতিটি ক্ষেত্রে অবস্থার আংশিক পরিবর্তন করতে হবে।
সর্বোপরি, কোনো দেশই তার নিজ নিজ নীতিটি পরিত্যাগ করতে চায় না যা শুরু করার পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, সৌদি আরব যৌক্তিকভাবে আশা করতে পারে না যে ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করবে বা ব্যালিস্টিক মিসাইলগুলোর উন্নয়ন বন্ধ করবে। এটি হাউছি শিয়া মিলিশিয়াদের আক্রমণে বিরতির মতো বিষয় নিষ্পত্তি করতে পারে।
তেমনি মিসর প্রত্যাশা করতে পারে না যে তুরস্ক তার সাম্প্রতিক সম্পর্কের অংশ হিসাবে লিবিয়া থেকে সরে আসবে। তুর্কি পররাষ্ট্রনীতির কথাটি বিবেচনা করতে হবে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয় বিবেচনা যখন গুরুত্বপূর্ণ হবে। প্রক্রিয়াটি ধীর হবে, তবে আসল সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য গতিশীলতায় পরিবর্তন আসবে।
আমরা একটি নতুন যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, যার মধ্যে সমস্ত পক্ষ একে অপরকে পর্যবেক্ষণ করবে, যেখানে সমস্ত পক্ষই যাকে খুশি তার সাথে কথা বলতে এবং আলোচনার জন্য স্বাধীন।
লেখক : আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, তুরস্ক
বাংলা অনুবাদ : মাসুমুর রহমান খলিলী