করোনা সময়ে কেন পর্যাপ্ত পানি পান জরুরি?
করোনা সময়ে কেন পর্যাপ্ত পানি পান জরুরি? - ছবি : সংগৃহীত
পানি পান করা যে দরকার, তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু করোনার এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে পানি পান করার প্রয়োজনীয়তা আরো বেড়ে গেছে। এর অন্যতম কারণ, শরীরকে ডিডাইড্রেড হতে দেয়া যাবে না। আমাদের দেশের মতো আর্দ্র ও গরম শহরে শরীর সহজে ডিহাইড্রেড হয়, পর্যাপ্ত পানি খেলে তা হবে না। অসুস্থতার অন্যতম কারণ শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া। দীর্ঘদিন ধরে অভ্যাস না থাকার ফলে পানির অভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রেও বেশি পানি খাওয়া দরকার বলে মনে করেন সেলিব্রিটি পুষ্টিবিদ পূজা মাখিজা।
যথাযথ হাইড্রেশন
পর্যাপ্ত পানি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে সচল রাখে, যা করোনাভাইরাস ঠেকানোর কাজে সহায়তা করে বিস্তর। কাজেই পানি খেতে হবে শরীরের প্রয়োজন বুঝে। কার কতটুকু পানি প্রয়োজন তা জেনে নিতে হবে পরিবারের চিকিৎসকের থেকে। শরীরের ধরণ, ক্রনিক অসুখ, গঠনপ্রকৃতি, হাড় বা হৃদরোগের সমস্যা ইত্যাদি নানা ফ্যক্টর বুঝে চিকিৎসক ঠিক করে দেবেন, কতটুকু পানি শরীরের প্রয়োজন।
পুষ্টিবিদের মতে, এক একজনের শরীরের অবস্থা ও ধরণ অনুযায়ী পানি খাওয়ার পরিমাণ ঠিক করা উচিত। সাধারণ সুস্থ মানুষ ২.৫-৩ লিটার পানি খেতে পারেন। খুব বেশি ব্যায়াম ও ঘরের কাজে করলে প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষ ৩.৫-৪ লিটার খেতে পারেন। তবে তিন লিটারের বেশি পানি খেলে চিকিৎসকরে পরামর্শ নিয়েই খাওয়া উচিত। কারণ অতিরিক্ত পানি পানের কিছু ক্ষতিকর দিকও আছে। এ ছাড়া কোনো রোগের কারণে যদি পানি কম খাওয়ার নির্দেশ থাকে, যেমন কিডনির অসুখ, হার্ট ফেলিওর ইত্যাদি তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া পানি খাওয়া বাড়াবেন না। উল্টে বরং ক্ষতি হয়ে যাবে। তবে শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী পানি খেলে, করোনা ঠেকানো ছাড়া আরো কিছু উপকার মিলবে।
পর্যাপ্ত ঘুম
করোনা এড়াতে দরকার ভালো ঘুম। শুধু করোনা নয়, অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রেও ভালো উপায় ঘুম।
সূত্র : এই সময়
করোনা-পরবর্তী যত সমস্যা
অধ্যাপক ডা: মোহাম্মদ আজিজুর রহমান
করোনা সংক্রমণ থেকে শারীরিকভাবে সেরে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে সাধারণ চ্যালেঞ্জ হলো শ্বাসকষ্ট কাটিয়ে উঠতে পারা। যারা সংক্রমিত হয়েছে, সেটা হালকা বা গুরুতর উপসর্গ যাই হোক না কেন সবার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।
যারা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাচ্ছেন তাদের সবার জন্যই শ্বাসকষ্ট স্পষ্টতই একটা সমস্যা। করোনা মূলত শ্বাসতন্ত্রের একটা রোগ, যা ফুসফুসকে সাময়িকভাবে অকেজো করে দেয়, ক্ষতিগ্রস্ত করে।
ফলে সিঁড়ি ওঠানামার মতো সহজ কাজ তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। বয়স্ক লোকদের জন্য এটা বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করে। যারা নিবিড় পরিচর্যায় থেকেছেন শ্বাস নেয়ার কষ্ট শুধু যে তাদের ক্ষেত্রে তা নয়।
এই ভাইরাসে কমবেশি সংক্রমিত প্রত্যেক রোগীকে এই সমস্যার সাথে লড়তে হচ্ছে। শ্বাসক্রিয়া আবার স্বাভাবিক হতে তাদের বেশ সময় লেগে যাচ্ছে। করোনার সংক্রমণ সেরে যাওয়ার পরও কাশি কয়েক সপ্তাহ থাকতে পারে। শরীরও বেশ দুর্বল থাকে। কোনো কাজ করতে গেলে হাঁপিয়ে ওঠা স্বাভাবিক। অবসাদ আর ক্লান্তি থাকে দীর্ঘদিন। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি হওয়া রোগীদের সেরে উঠতে তুলনামূলক বেশি সময় লাগে। অনেক রোগীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে ১২ থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
এ ছাড়া হাসপাতালের বিছানায় দীর্ঘদিন শুয়ে থাকার কারণে দেহের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, ফিজিওথেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। খাবারে অরুচিও থেকে যায় বেশ কিছুদিন। রোগীর মানসিক অবস্থারও অবনতি ঘটতে পারে।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর দুই সপ্তাহ পর পুরোদমে সামাজিক মেলামেশা ও কাজে যোগদানে কোনো বাধা নেই। তবে অবসাদ, ক্লান্তি রয়ে গেলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে কিছুটা বিলম্ব হতে পারে।
করোনা সংক্রমণ পরবর্তী শারীরিক দুর্বলতা অনুভব হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যাকে বলে পোস্ট ভাইরাল সিন্ড্রোম বা পোস্ট ভাইরাল ফ্যাটিগ সিন্ড্রোম। এ ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে বিরামহীন ক্লান্তি, দুর্বলতা, কোনো কিছু ভালো না লাগা, নিজের যতœ ঠিকভাবে নিতে না পারা ও কোনো কিছুতে সঠিকভাবে মনোযোগ দিতে না পারা। যা সপ্তাহ থেকে মাস পর্যন্ত গড়াতে পারে।
এ সময় প্রতিদিন রাতে অবশ্যই সাত থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমান, দিনের বেলায় প্রয়োজনে পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন, পর্যাপ্ত পানি ও তরল খাবার খান, দিনের নির্দিষ্ট সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে কিছু হালকা ব্যায়াম করুন এবং ভারী কাজ করা থেকে বিরত থাকুন।
ভারী খাবার, চর্বিযুক্ত খাবার, যেমন- ভাজা-পোড়া ও ফাস্টফুড জাতীয় খাবার পরিহার করুন।
করোনা সংক্রমণ পরবর্তী ফুসফুসে যে জটিলতা দেখা দেয় তাকে পোস্ট কোভিড পালমোনারি ফাইব্রোসিস বলে। একে ফুসফুসের ‘অপরিবর্তনীয় ক্ষতি’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে।
পালমোনারি ফাইব্রোসিস এক ধরনের রোগ যেখানে ফুসফুসের নরম অংশগুলো নষ্ট হয়ে যায় এবং সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এতে ফুসফুসের কলাগুলো (টিস্যু) মোটা ও শক্ত হয়ে যায়, ফলে ফুসফুসে বাতাসের থলিগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারে না।
সামগ্রিকভাবে, করোনা আক্রান্ত প্রায় প্রত্যেকেরই হালকা উপসর্গ থাকে। অনেকে আবার একেবারেই উপসর্গহীন হয়ে থাকে। তবে, খুব কম মানুষই মারাত্মকভাবে সংক্রমিত হন।
মারাত্মক সংক্রমিতদের হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হয়। তাদের ভেন্টিলেটরেরও প্রয়োজন হয়। যাদের অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় তারাই পোস্ট কোভিড ফাইব্রোসিসের শিকার হওয়ার উচ্চ ঝুঁঁকিতে আছেন। এদের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ ভাগ রোগীর পালমোনারি ফাইব্রোসিস হয়। বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে কাশি ও হালকা শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হতে দেখা যায়। তারা সুস্থ হয়ে ওঠেন। তবে একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ফুসফুসের অত্যধিক ক্ষতি হয় এবং তাদের মধ্যে কিছু লোক ফাইব্রোসিসের শিকার হন।
পালমোনারি ফাইব্রোসিসের উপসর্গ হতে পারে শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, শুষ্ক কাশি, বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভব করা, খাওয়ার ইচ্ছা কমে যাওয়া, অস্বাভাবিকভাবে ওজন কমে যাওয়া, অবসাদ বা ক্লান্তি অনুভব করা, পেশি এবং জয়েন্টগুলোতে ব্যথা ও ধীরে ধীরে হাতের আঙ্গুল বা পায়ের আঙ্গুল মোটা হয়ে যায়।
এরকমও হতে পারে, পালমোনারি ফাইব্রোসিস রোগের শারীরিক লক্ষণ দেখা না দিলেও তা রোগীর দেহে বিদ্যমান থাকতে পারে।
পালমোনারি ফাইব্রোসিস রোগ শনাক্ত করার জন্য নি¤েœাক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় :
বুকের এক্স-রে, বুকের কম্পিউটারাইজড সিটি স্ক্যান, ইকোকার্ডিওগ্রাম, পালমোনারি ফাংশন টেস্টিং (ফুসফুস কতটা বায়ু ধরে রাখতে পারে এবং কত দ্রুত বাতাস সরাতে এবং বাইরে যেতে পারে তা পরিমাপ করা) ও পালস অক্সিমেট্রি।
পালমোনারি ফাইব্রোসিস রোগের চিকিৎসা না করলে পালমোনারি হাইপারটেনশন (ফুসফুসের উচ্চ রক্তচাপ), ডান পাশের হৃদয়ের ব্যর্থতা (রাইট হার্ট ফেইলিউর), শ্বাসযন্ত্রের ব্যর্থতা (লাং ফেইলিউর), ফুসফুসের ক্যান্সার ও ঘন ঘন ফুসফুসে সংক্রমণ হয়ে শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
পালমোনারি ফাইব্রোসিস রোগের চিকিৎসার জন্য নিম্নোক্ত ধাপগুলো অনুসরণ করা হয় :
ফুসফুসের প্রতিস্থাপন : জীবনের মান উন্নত করে এবং আপনাকে দীর্ঘ জীবন বাঁচাতে দেয়।
অক্সিজেন থেরাপি : শ্বাস সহজ করে তোলে এবং কম রক্ত অক্সিজেন মাত্রা থেকে জটিলতা প্রতিরোধ করে।
পালমোনারি পুনর্বাসন : উপসর্গগুলো পরিচালনা করুন এবং আপনার দৈনন্দিন কার্যকারিতা উন্নত করুন।
পালমোনারি ফাইব্রোসিস রোগের চিকিৎসা অথবা ব্যবস্থাপনায় জীবনধারায় যেসব পরিবর্তন সহায়ক হতে পারে তা হলো- নিয়মিত ফুসফুসের ব্যায়াম করুন ও ধূমপান করবেন না।
লেখক : বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ