রাজনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা : মমতার বিজয়ের তাৎপর্য

গৌতম দাস | May 02, 2021 09:29 pm
মমতা ব্যানার্জি

মমতা ব্যানার্জি - ছবি : সংগৃহীত

 

মুসলমানেরাও হিন্দুদের মতোই সমান মানুষ। সমান নাগরিক। বহু প্রতারণার পরে কখনো কংগ্রেস, কখনো কথিত সেকুলার, কখনো কমিউনিস্ট প্রতিশ্রুতি এমন নানা কিছু দেখে আসছি আমরা সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। এরাই মুসলমানকে মুসলমান পরিচয় লুকিয়ে কথিত সেকুলার জামা পরিয়ে প্রগতির লোভ প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। অথচ কাজের কাজ কিছু হয়নি। কারণ কংগ্রেস-বামেরা আসলে নিজেদের জমিদার-হিন্দুর উত্তরসূরি এই নিরিখে নিজেদের আরেক বর্ণ হিন্দুকর্তাই মনে করে থাকে।

মমতার কৃতিত্ব এটাই- তিনি ওই সেকুলার জামা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্বাভাবিক মুসলমান পরিচয় রেখেই একইসাথে মুসলমানেরা সমান নাগরিক এই স্বীকৃতির জন্য লড়ছেন। মমতার এই বিজয় ফাইনালি পশ্চিমবঙ্গে এক 'রাজনৈতিক সাম্য' প্রতিষ্ঠার রাজনীতির পথে যাত্রা শুরু সুগম করবে। এটাই এবারের মমতার আবার বিজয়ের তাৎপর্য। আর সেই সাথে জমিদার-হিন্দুর শ্রেষ্ঠত্ব চিন্তা যে মিথ্যা ও বিপজ্জনক, আবার মুসলমানেরাও যে রাজনৈতিকভাবে সমান মানুষ, রেস অর্থেও সমান বাঙালি- এসব প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হলো।

বিপরীতে মমতা কলকাতায় মুসলমানদের 'বাড় বাড়ানোর' জন্য দায়ী নন। ওই অভিযোগ আসলে তাকে ঘায়েল করার প্রপাগান্ডা। ওই অভিযোগ তুলে বিজেপি কলকাতায় হিন্দু ভোট মেরুকরণের লক্ষ্যে এই ধোয়া তুলেছিল।

আর কংগ্রেস-বামেরা এনিয়ে বিজেপিকে চ্যালেঞ্জ করতে সাহস পায়নি। কারণ ভেবেছে কী জানি তাতে তাদের হিন্দু ভোট পাওয়া কমে যায় কিনা। ফ্যাক্টস হলো, মমতা মুসলমানেদের লাই দিয়ে মাথায় তোলেননি। মাথায় তোলারই কিছু নেই। বরং প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দেয়া ছিল কর্তব্য। এক ঐতিহাসিক বঞ্চনা থেকে মুক্ত করে মুসলমানদেরকে সমঅধিকারের আলোয় আনতে সরলভাবেই তিনি কাজ করেছেন। কারণ এটা কারো বাড়-বাড়ানির বিষয় নয়- আবার এটা কারো ওপর কারো শ্রেষ্ঠত্বের মামলাই নয়, তাই কারো বাড়-বাড়িয়ে নেয়ার মামলা একেবারেই নয়। এটা রাজনৈতিক সাম্য, সবার সম-অধিকারে পাশাপাশি সমান থাকা ও হবার মামলা।

আমরা দেখেছি জয় শ্রীরাম বলানোর জবরদস্তি, কনষ্টিটিউশন অনুসারে যা এক বিরাট ক্রিমিনাল অফেন্স। অথচ বিজেপির কিছু লোক তা করছে। মুসলমান নাগরিককে মাটিতে ফেলে লাফিয়ে তার বুকের খাঁচার ওপর এরা লাফিয়ে উঠেছে অবলীলায়। আবার, জেলার স্কুল শিক্ষক কলকাতায় এসেছেন অফিসের কাজে। কিন্তু তাদেরকে হোটেলে থাকতে দেয়া হবে না। কারণ ওই শিক্ষকেরা মুসলমান! আবার তারা একই হোটেলে বসে খেতেও পারবে না, মুসলমান বলে। সামাজিকভাবে দল পাকিয়ে তাদের বাধা দেয়া হয়েছে। তাদেরকে 'কম' মানুষ মনে করা হয়েছে। অথচ কেউ প্রতিবাদ করেনি, মজা দেখেছে। যেন বাড় বেড়ে যাওয়া মুসলমানদের ঝেটে ফেলা হচ্ছে দেখে মজা নিয়েছে। অথচ কিছু না বলে এটা দাঁড়িয়ে দেখাটাও হয়েছিল একটা সামাজিক অপরাধ। কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট এটা নিয়ে কথা বলেনি, ভোট কমে যাবার ভয়ে।

এমন প্রসঙ্গের শেষ নেই, গত সাত বছরের মোদির শাসনে এমন বিভেদমূলক ও অসাম্য, অসম-নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষেই মোদীকে আমরা নেতাগিরি করতে দেখেছি।

আর এসবের বিপরীতে একমাত্র মমতা- সরাসরি এই হিন্দুত্ববাদ,এই জবরদস্তি নির্যাতন ও মুসলমানবিদ্বষের বিরুদ্ধে সরাসরি কথা বলেছেন, এমন একমাত্র ভারতীয় রাজনীতিবিদ যিনি জয় শ্রীরাম রাজনীতির বিরুদ্ধে সোজা দাঁড়িয়েছেন।

মমতাই হলেন সবচেয়ে কম তত্ত্ব আউড়ানো রাজনীতিবিদ। না তিনি কংগ্রেসি না তত্ত্ব আউড়ানি কমুউনিস্ট, না কোনো কথিত অসাম্প্রদায়িক বা প্রগতিশীল। অথচ একমাত্র তিনিই মোদির দলের 'জয় শ্রীরাম' শ্লোগান ও এই ক্রাইমের সরাসরি বিরোধিতা করে গেছেন। যা কংগ্রেস বা কমিউনিস্টরা এখনো পারেইনি।

আবার ঐতিহাসিকভাবে বললে, ভারতের উত্তরের আর্য-চিন্তার প্রভাবে সব সময় অন্যদের ওপর প্রভাব চাপানোর চেষ্টা করে গেছে যাতে এমন দাবি করেছে যে বাংলাকে হিন্দু-মুসলমানে ভাগ হতে হবে। মমতার এবারের বিজয়, ওই ভেদ-চিন্তাকেও এবার আরো পরাজিত করবে।

প্রাচীনকালে উত্তরের আর্য-চিন্তা তার অগ্রযাত্রা অখণ্ড ভারতের আমলে দু'জায়গায় প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল। যে প্রতিরোধ সে ভাঙতে পারেনি। এক হলো দাক্ষিণার্তে 'দ্রাবিড়ীয়' প্রতিরোধ আর এদিকে মারাঠা-বিহার পেরিয়ে পুবে 'বাংলার' প্রতিরোধ।

মমতার বিজয়ে ওই পুরনো প্রতিরোধ নবজন্ম পাবে; এবার এখন থেকে প্রতিরোধ তা অনেকটাই আরেক ধাপ স্থায়ী রূপ নিবে। অবশেষে খুব সম্ভবত এটাই আর্য বা হিন্দিবলয়ে তাদের আধিপত্যের শেষ পরাজয় বলে সূচিত হবে।
হিন্দুত্ব বা মোদির বিরুদ্ধে মমতার বিজয় তাই এক বিরাট অর্জন।

যেখানে মূল লড়াইটা হলো 'রাজনৈতিক সাম্য’ প্রতিষ্ঠার লড়াই। যাতে সবাই রাজনৈতিকভাবে সমান, সম-অধিকারের নাগরিক- এই ভিত্তিতে সবাই (সব রেস, সব এথিনিসিটি) এখন থেকে পাশাপাশি বাস করতে সক্ষম হবে।
তবে এ লক্ষ্যে সামনে অনেক কাজ, নিজেদের মধ্যে অনেক বুঝাবুঝি করে নেয়া বাকি! এই কথাগুলো ওই সবেরই এক প্রাথমিক খসড়া, যা নিয়ে আগামীতে বহু আলাপ আলোচনা লাগবে!

মনে রাখতে হবে, আগামীতে মোদির বিরুদ্ধে মমতাই হয়ে উঠবে প্রধান প্রতিরোধের খুঁটি। এটাই মমতার বিজয়ের তাৎপর্য।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us