ভারতে মৃত্যুর পরও করোনা ব্যবসা : সৎকারে দর ১৬ হাজার
ভারতে মৃত্যুর পরও করোনা ব্যবসা : সৎকারে দর ১৬ হাজার - ছবি : সংগৃহীত
‘আপনাদের টোকেন নম্বর ১২২। তার মানে, অন্তত ৭২ ঘণ্টা সময় লাগবে ধরে চলুন।' কথাটা বলেই আপাদমস্তক পিপিই ঢাকা ব্যক্তি করোনায় এক মৃতের নাম ধরে চিৎকার শুরু করলেন। তার পরিবারের লোকজন কাছে এলে বললেন, 'আপনাদের ৯৭ নম্বর টোকেন। আগামীকাল রাতের মধ্যে হয়ে যাবে। এর চেয়ে আগে সম্ভব নয়। প্রচুর চাপ।' কোনো কিছুই কি করা যায় না? মৃতের আত্মীয়দের অনুরোধে এর পরে ওই ব্যক্তি গলা নামিয়ে বললেন, 'আপনাদেরটা তিন-চারটি বডির আগে এনে দিতে পারি। এর বেশি পারব না। তবে আগের প্যাকেজে কিন্তু হবে না। টাকা বাড়বে।'
করোনায় মৃতদের লাশ সৎকার করা নিয়ে এই মুহূর্তে কলকাতায় এমনই নানা অলিখিত ‘প্যাকেজ’ চালু হয়ে গিয়েছে বলে খবর। প্রতিদিন মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে যত বাড়ছে, ততই সেই সব প্যাকেজের খরচ বাড়ছে বলে অভিযোগ। কারো থেকে স্রেফ সরকার নির্ধারিত শ্মশানে লাশ পৌঁছে দিতে ১২ হাজার তো কারো থেকে ১৫ হাজার রুপি নেয়া হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। যদিও গত বছর এই সমস্তটাই করতে তিন হাজার রুপির বেশি নেয়া যাবে না বলে ঘোষণা করেছিল পুরসভা। কিন্তু এখন শুধু বাড়তি টাকা চাওয়াই নয়, প্রিয়জনের শেষকৃত্যের ছবি পাওয়ার বা বিশেষ কিছু জিনিস লাশের সঙ্গে পাঠানোর ইচ্ছে থাকলে সেই সংক্রান্ত খরচও আলাদা করে দিতে বলা হচ্ছে মৃতের পরিবারকে। আবার মোটা টাকার প্যাকেজ নিতে রাজি থাকলে বাড়ি বসেই মিলছে চিতাভস্ম! রয়েছে লাশের সঙ্গে শেষ বার ছবি তোলার ‘ইচ্ছাপূরণের’ সুযোগও!
সূত্রের খবর, এত দিন ধাপার পাশাপাশি বীরজুনালা এবং নিমতলা শ্মশানে কলকাতার কোভিড মৃতদেহ সৎকার করা হচ্ছিল। তবে এই তিনটি জায়গাতেই প্রবল চাপ দেখে শুক্রবার থেকে এর সঙ্গেই সিরিটি ও গড়িয়া বোড়ালের শ্মশানও কোভিড মৃতদেহ দাহ করার জন্য ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। প্রসঙ্গত, গত বারের করোনার সময়ে এই বোড়াল শ্মশানেরই একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। ওই ভিডিওয় দেখা গিয়েছিল, দাবিদারহীন বিকৃত লাশ আঁকশি দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রশাসন অবশ্য লাশগুলো কোভিডে মৃতদের বলে মানতে চায়নি। তবে মৃতদেহেরও যে সম্মান প্রাপ্য, তা আমরা ভুলে গিয়েছি কি না, সেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল ওই ঘটনায়। কলকাতার কোভিড লাশগুলির ডেথ সার্টিফিকেট এত দিন যেখান থেকে দেয়া হতো, সেই পিস ওয়ার্ল্ডের এক কর্মী অবশ্য বললেন, “গত বার যে সম্মানটুকু দেয়া গিয়েছিল, এ বার সেটুকুও দেয়া যাবে কি না সন্দেহ। শুধুমাত্র ধাপাতেই দিনে ১৩০টিরও বেশি মৃতদেহ পৌঁছচ্ছে। বাকি জায়গাগুলোরও ভয়ানক অবস্থা। যে দিন রোগী মারা গেলেন, সে দিনই তার শেষকৃত্য হবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। সেই সুযোগেই কিছুটা আগে কাজ করিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে টাকা তুলছে কিছু সংস্থা।”
জানা গিয়েছে, ‘লাস্ট রাইটস উইশ’, ‘গুডবাই’, ‘সি ইউ ইন দ্য অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড’ নামে বেশ কিছু সংস্থা তৈরি হয়ে গিয়েছে গত কয়েক দিনে। বেসরকারি হাসপাতাল তো বটেই, সরকারি হাসপাতাল থেকেও এই সমস্ত সংস্থা কোভিড মৃতদের লাশ সৎকারের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে হাসপাতাল থেকেই মৃতের পরিবারের ফোন নম্বর তাদের দিয়ে দেয়া হচ্ছে কমিশনের ভিত্তিতে। হাজরা মোড়ের এমনই একটি সংস্থার নম্বরে ফোন করা হলে, মৃতের নাম, ঠিকানা, তিনি কোন হাসপাতাল ভর্তি ছিলেন জেনে নিয়ে বলা হয়, “শেষকৃত্যের ছবি লাগবে? যদি লাগে, তা হলে আলাদা ১৫০০ রুপি। মৃতদেহের সঙ্গে তার পছন্দের কিছু পাঠাতে হলে আরো হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ১৬ হাজার পাঁচ শ'!” এত? এ বার ওই ব্যক্তি বলেন, “অন্য রোগ হলে দু’হাজারও লাগত না। তা ছাড়া, আপনাদেরটা যাতে আগে হয়, সেটা আমরা দেখে দেব।” বিডন স্ট্রিটের এমনই আর একটি সংস্থার আবার দাবি, “ছবি বা চিতাভস্ম না লাগলে আট হাজারে হয়ে যাবে। কিন্তু প্রচুর লাশ আসছে। ফলে কয়েক দিন যদি মৃতদেহটা কোথাও রেখে দিতে হয়, তা হলে কিন্তু আলাদা খরচ।” কোথায় রাখা হবে? সংস্থার দাবি, “পুরসভার কোনো জায়গাই ফাঁকা নেই। রেফ্রিজারেটর বসিয়ে আমরাই একাধিক জায়গা করেছি, যেখানে দিন কয়েক দেহ থাকতে পারে।” আর একটি সংস্থা আবার মৃতদেহের শেষকৃত্য থেকে শ্রাদ্ধের কাজ— সবই ২০ হাজার রুপিতে করে দেয়ার ‘প্যাকেজ’ শোনাল।
এমনই একাধিক প্যাকেজের খবর প্রকাশ্যে আসায় গত বার পুরসভার তরফে তড়িঘড়ি ৯৮৩০০১১০৪১ এবং ৯৮৩০৫৫৫১১১ নম্বর প্রকাশ করে এই ধরনের অভিযোগ থাকলেই দ্রুত জানাতে বলা হয়েছিল। এ দিন এই দুই নম্বরেই বার বার ফোন করা হলেও কেটে দেয়া হয়েছে। কোভিডে মৃতদের সৎকারের জন্য থাকা শহরের নোডাল অফিসারকে ফোন করা হলে তিনিও শুধু “দেখছি”, বলেই ফোন রেখে দেন।
কলকাতা পুরসভা থেকে কোভিড মৃতদেহ শ্মশানে পৌঁছে দেওয়ার অনুমতি পাওয়া এক সংস্থার মালিক অবশ্য বললেন, “মৃত্যুর আগে যেমন রোগ নিয়ে ব্যবসা চলছে, মৃত্যুর পরে মৃতদেহ নিয়েও একই জিনিস চলছে। প্রশাসনের কোনো হুঁশই নেই। আমরা প্রশাসনের বেঁধে দেয়া তিন হাজারের বেশি এক টাকাও নিচ্ছি না। ২২টা ছেলে আমার সংস্থায় কাজ করছে।” ওই ব্যক্তি জানান, হাসপাতাল থেকে প্রতিদিনের মৃতদেহ নিয়ে তারা সরকারি অনুমতির অপেক্ষা করেন। এর পরে সরকার থেকে যে হাসপাতালের মৃতদেহ যে শ্মশানে নিয়ে যেতে বলা হয়, সেখানেই ছোটেন। কথা শেষ করার আগেই ফোন আসে ওই ব্যক্তির কাছে। ফোন রেখে এক মেডিক্যাল কলেজের নাম করে এর পরে তিনি বলেন, “ওখানে ৩৩টা মৃতদেহ পড়ে আছে। এখনই ছুটতে হবে।”
ভুক্তভোগী এক কোভিডে মৃতের আত্মীয়ের মন্তব্য, “রাজধানীর অবস্থা রোজ দেখছি, আর ভয় ধরছে। এখানেও তেমনটা হওয়ার আগে প্রিয়জনকে সসম্মানে বিদায় জানাতে চাই। এইটুকু চাওয়া নিয়েও যারা ব্যবসা করছেন, তারা আর যা-ই হোন, মানুষ নন।”
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা