ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসি ব্যর্থ : ভারতে এখন টিকার জন্য হাহাকার
ভারতে এখন টিকার জন্য হাহাকার - ছবি : সংগৃহীত
এই কিছু দিন আগেও ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসির কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু ভারত এখন অন্য দেশকে টিকা দেবে কী, নিজের দেশেই তো টিকা নিয়ে হাহাকার। অনেক রাজ্যের হাতেই টিকা নেই।
ভারতে এখন চারপাশে একটা কথাই শোনা যাচ্ছে, নেই। হাসপাতালে জায়গা নেই, অক্সিজেন নেই, করোনার ওষুধ নেই, এমনকী গলা ঠিক রাখার জন্য গার্গল করার সলিউশনও নেই। আর করোনার টিকাও নেই। একসময় খুব বড় মুখ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রতিবেশী দেশগুলোকে বিনা পয়সায় করোনার টিকা উপহার দিয়েছিলেন। এখন সেই টিকার জন্য হাহাকার চলছে। ভারতের নেই-রাজ্যে টিকাও নেই।
করোনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতে কম বয়সিরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের শারীরিক অবস্থারও দ্রুত অবনতি হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। তাই সরকার ১ মে থেকে ১৮ বছরের বেশি বয়সী সকলকে টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিটি রাজ্যেই বিপুল পরিমাণ মানুষ টিকা নেয়ার জন্য নাম লিখিয়েছেন। ফলে টিকার চাহিদা আকাশছোঁয়া।
এই অবস্থায় একদিন আগেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানিয়ে দিয়েছেন, দিল্লি সরকারের হাতে কোনো টিকা নেই। ফলে দিল্লি সরকারের হাসপাতালে টিকা দেয়া এখন বিশ বাঁও পানিতে। তিনি জানিয়েছেন, টিকা হাতে এলে জানানো হবে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে তিন কোটি টিকা চেয়েছেন। দুই কোটি রাজ্য সরকারি হাসপাতালের জন্য। বেসরকারি হাসপাতালের জন্য এক কোটি। তিন কোটি টিকা কবে পাওয়া যাবে কেউ জানে না।
এটা মনে করার কারণ নেই যে, এই টিকা কেবল বিরোধী শাসিত রাজ্যে পাওয়া যাচ্ছে না। বিজেপি শাসিত রাজ্য হিমাচলের মুখ্যমন্ত্রীও জানিয়ে দিয়েছেন, তার কাছে টিকা নেই। প্রায় সব রাজ্যই কেন্দ্রকে এসওএস পাঠাচ্ছে, 'টিকা দাও'।
আসলে হঠাৎ করে চাহিদা আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে। ৪৫ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষকে যখন ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছিল, তখন ৩৫ কোটির জন্য টিকা দরকার ছি্ল। এখন ১৮ প্লাসকে টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ায় ৯০ কোটি মানুষ ভ্যাকসিনের আওতায় চলে আসছেন। প্রত্যেককে দুই ডোজ ভ্যাকসিন দিতে হবে।
সেরাম ইনস্টিটিউট এখন মাসে প্রায় সাত কোটি ও ভারত বায়োটেক প্রায় দুই কোটি ভ্যাকসিন বানায় বলে টেলিগ্রাফের রিপোর্ট বলছে। তার উপর ভ্যাকসিন তৈরির জন্য কাঁচামালও কম পড়ে গেছে। ভারত বেশ কিছু দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কাঁচামাল চাইছে। দেরিতে হলেও অবশেষে তারা সাড়া দিয়েছে এবং কাঁচামাল আসছে। ফলে নেই- দেশে করোনার টিকাও যে অনেক রাজ্যের কাছে নেই হয়ে যাবে তাতে আর অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভারতের যা অবস্থা তাতে অবাক হওয়ার শক্তিও এখন অনেকটাই কমে আসছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগে ভারতের একটি সরকারি অবস্থান ছিল, দিল্লি অন্য কোনো দেশের কাছ থেকে সাহায্য নেবে না। দরকার হলে তারা অন্যকে সাহায্য করবে। গরিব ও অনুন্নত দেশের তকমা যাতে না লাগে তার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এটা অবশ্য নেয়া হয়েছিল মনমোহন সিংয়ের আমলে। তাই ভয়াবহ সুনামির পর ভারত অন্য দেশের সাহায্য নেয়নি। পরপর ঘটে যাওয়া অনেক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরেও একই অবস্থান বজায় রাখতে পেরেছিল তারা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তো আত্মনির্ভর ভারত এবং মেড ইন ইন্ডিয়ার নীতি নিয়ে অনেক প্রচার করেছেন। লাদাখ সংঘাতের পর চীনের কাছ থেকে জিনিস নেয়ার নীতি থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরে আসছিল ভারত।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসে সেই সব নীতি উড়িয়ে দিয়েছে। এখন যুক্তরাজ্য, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, পর্তুগাল, নরওয়ে, ইটালি, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, এমনকি ভুটান পর্যন্ত সাহায্য করছে। ভুটানও অক্সিজেন দিতে চেয়েছে।
চীনের কাছেও ২৫ হাজার অক্সিজেন কনসেনট্রেটর অর্ডার দিয়েছে ভারত। সেগুলো যাতে দ্রুত এসে পৌঁছায় তার জন্য যাবতীয় চেষ্টা করা হবে বলে চীন জানিয়েছে। ভারতের তরফ থেকে বলা হয়েছে, কোনো দেশ সাহায্য করতে চাইলে, তা ফেরানো হবে না। ফেরানো সম্ভবও নয়। পরিকল্পনাহীন নেই-রাজ্যে সেই ঔদ্ধত্য দেখানোর অবস্থা এখন আর নেই।
গুপী গায়েন বাঘা বায়েনের শুণ্ডি রাজ্যে উট, ঘোড়া, সৈন্য না থাকলেও মানুষের মনে শান্তি ছিল, সুখ ছিল। করোনাকালে ভারতে সেটাও নেই। তাই দাতা এখন গ্রহীতায় পরিণত হয়েছে। না হলে পরিস্থিতি সামলানো যাবে না।
সূত্র : ডয়চে ভেলে