কী ঘটতে যাচ্ছে মিয়ানমারে?

মাসুম খলিলী | Apr 27, 2021 04:30 pm
কী ঘটতে যাচ্ছে মিয়ানমারে?

কী ঘটতে যাচ্ছে মিয়ানমারে? - ছবি : সংগৃহীত

 

মিয়ানমারের সহিংস অবস্থার অবসানের আসিয়ান- উদ্যোগ নিয়ে আগে থেকেই খুব বেশি প্রত্যাশা করা হয়নি। তবে আঞ্চলিক এই জোট সামরিক জান্তা ও গণতন্ত্রকামীদের মধ্যে সংলাপের একটি কাঠামো দিয়ে উচ্চ মাত্রার সহিংসতায় বিরতি টানা এবং অদূরভবিষ্যতে সঙ্কটের সমাধান সম্ভাবনা সৃষ্টির আশা কেউ কেউ করেছিলেন। তবে আফ্রিকান ইউনিয়নের মতো রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে উদ্যোগী হওয়া এবং এ ব্যাপারে একটি ফল নিয়ে আসার অতীত দৃষ্টান্ত আসিয়ান জোটের নেই। এর পরও জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা জাকার্তার আসিয়ান সম্মেলনের দিকে তাকিয়েছিলেন।

আসিয়ান সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী নেতারা একমত হয়ে পাঁচ দফা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যার সাথে মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থানের নেতা ‘একমত’ হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। এটা শেষ পর্যন্ত কতটা কার্যকর ফল নিয়ে আসবে সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে পরিস্থিতি আরো কিছু দিন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তবে আসিয়ান যে আশার সৃষ্টি করেছে তার যে কোনো ব্যর্থতা মিয়ানমারকে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্ব বলয়ের প্রক্সিযুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত করতে পারে। কেউ কেউ এমনও মনে করেন যে, সেই প্রক্সিযুদ্ধ আসলেই শুরু হয়ে গেছে।

আসিয়ান সম্মেলন ও জান্তা শাসন
গত শনিবার জাকার্তায় আসিয়ান নেতাদের পাঁচ দফায় ঐকমত্য মিয়ানমার সঙ্কটের একটি টেকসই সমাধানের জন্য ‘আঞ্চলিক প্রক্রিয়া’র মোটামুটি একটি রোডম্যাপ দিতে পারে। আগামী সপ্তাহগুলোতে, আসিয়ানকে এ ব্যাপারে দূরদৃষ্টির সাথে কাজ করতে হবে এবং সঙ্কট সমাধানের ব্যাপারে যে গতি সৃষ্টি হয়েছে তার সুযোগ নিতে হবে। আসিয়ান নেতারা শীর্ষ সম্মেলনের দুটি অধিবেশনে খোলামেলাভাবে মতবিনিময় করেছেন।

এতে দুটি ভিন্ন অধিবেশন থাকলেও মূল অ্যাজেন্ডা ছিল মিয়ানমার। জোটকে শক্তিশালীকরণের চলমান প্রচেষ্টা, কোভিড-১৯-এর প্রভাব এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনার অগ্রগতি সম্পর্কে আসিয়ান চেয়ারপারসন ব্রুনেইয়ের সুলতান হাসান আল বলকিয়ার রিপোর্টের মাধ্যমে শুরু হয়ে প্রথম অধিবেশনটি মাত্র ৩০ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। তিনি আসিয়ানের বাহ্যিক সম্পর্কের উপর জোর দিয়ে বলেন, আসিয়ানকে অবশ্যই ব্লকের দুটি প্রধান সংলাপের অংশীদার চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুষম সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে মিয়ানমার নিয়ে আলোচনা হয়। সভাপতির সূচনা বক্তব্য এবং আসিয়ান প্রধানের একটি প্রতিবেদনের পরে মিয়ানমারের অভ্যুত্থান নেতা মিন অং হ্লাইং ৩০ মিনিট ধরে আসিয়ান নেতাদের তার দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি একাধিক ডিজিটাল স্লাইড প্রদর্শন করেন আর ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখল করার পর থেকে তার দেশের প্রশাসনিক কাউন্সিল কী করেছে, সে সম্পর্কে বিশদ বিবরণ দেন।

ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি জোকো উইদোদো সম্মেলনে মিয়ানমারের জন্য আসিয়ানের বিশেষ দূত প্রেরণের আহ্বান জানান। তিনি জরুরি সহায়তা চ্যানেলগুলো উন্মুক্ত করা এবং মিয়ানমারের সব রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানান। তার বক্তৃতার মূল সুর ছিল মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের নেতা সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং যাতে সহিংসতার অবসানের পথে এগিয়ে যান।

আসিয়ান সম্মেলন ছিল মূলত মিয়ানমার সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসার প্রথম সমন্বিত আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা। মহামারী সত্ত্বেও আসিয়ান শীর্ষ নেতাদের অধিকাংশই ব্যক্তিগতভাবে অংশ নিয়েছেন এই সম্মেলনে। আয়োজকরা বলেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ এবং মিয়ানমারকে এই নাজুক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করার জন্য আসিয়ানের দৃঢ অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়েছে এই সম্মেলনে।

মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সর্বোচ্চ নেতার আসিয়ান সম্মেলনে অংশ নেওয়া স্বাভাবিক ছিল না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণত দেশটির নিম্ন স্তরের কর্মকর্তা বা বেসামরিক নাগরিকের দ্বারা প্রতিনিধিত্ব করা হয়। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপতি প্রাসাদের অফিসিয়াল ভিডিও চ্যানেলে ফুটেজে দেখা গেছে, মিয়ানমারের রাজধানী নাইপিত’ থেকে একটি বিশেষ ফ্লাইটে মিন অং হ্লাইং সম্মেলনে অংশ নিতে জাকার্তায় অবতরণ করছেন।

অনেক আসিয়ান নেতা তার নিরাপত্তা বাহিনীকে আটকাতে মিন অং হ্লাইংয়ের প্রতিশ্রুতি চেয়েছিলেন। ফিলিপিন্সের পররাষ্ট্র সচিব টেডি লকসিনের একটি বক্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি টুইটারে বলেছেন, ‘মিয়ানমারের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বিচ্ছিন্নতাপূর্ণ জাতিগত অংশগুলোতে বিভক্ত হওয়া এড়াতে হবে। মিয়ানমারকে অবশ্যই আবার শান্তি খুঁজে বের করতে হবে।’

আসিয়ান নেতাদের একমত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার একটি নীতি রয়েছে। বিতর্কিত সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে এটি বাধা সৃষ্টি করলেও জাতিসঙ্ঘ, চীন এবং আমেরিকা সরাসরি মিয়ানমারে জান্তার কর্মকাণ্ডের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সেরা সংস্থা হিসাবে দেখেছে আসিয়ানকেই।
আসিয়ানে উইদোদো ছাড়া অন্যান্য নেতাও স্পষ্টতই মিয়ানমারের বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করা, রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্ত করা, আলোচনা অনুষ্ঠান এবং পুনর্মিলনের উপায় সন্ধানের প্রয়োজনের বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। বৈঠকে থাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডন প্রমুদ্দিনাই তার চার দফা প্রস্তাবে আটককৃতদের মুক্তি দানের আহ্বান জানান। তিনি সহিংসতা বন্ধ, মানবিক সহায়তা প্রদান ও আলোচনা শুরু করারও আহ্বান জানালেন। অন্য নেতারাও একই ধরনের মতের প্রতিধ্বনি করেন। কোনো আসিয়ান নেতা মিয়ানমারের সিনিয়র জেনারেলকে ‘আঘাত করেননি’।

মিন অং হ্লাইং সহিংসতা বন্ধে নিজের কথা রাখছেন কিনা তা আগামী দিনগুলোতে দেখা যাবে। তিনি আসিয়ান নেতাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। নিরপেক্ষ সূত্রগুলো সম্প্রতি সে দেশে চলমান বিক্ষোভে মৃত্যুর সংখ্যা ৭৫০ এর উপরে বলে উল্লেখ করলেও জান্তাপ্রধান জোর দিয়ে বলেছে যে, ‘কেবল’ ২৭৭ জন মারা গেছে। তিনি অভিযোগ করেছেন, অন্যান্য মৃত্যুর জন্য ‘অজানা শক্তি’ দায়ী ছিল।
কর্মকর্তাদের তদারকি এবং সহিংসতার অবসান করার প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা না করে আসিয়ানকে অবশ্যই সিনিয়র জেনারেলের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করতে হবে। আস্থা স্থাপনের উপায় হিসাবে তার পদ্ধতি এবং ‘দেহের ভাষা’ পর্যবেক্ষণ করার জন্য এই সভাটি ভালো সুযোগ ছিল। এক কর্মকর্তা বৈঠকটিকে ‘তাদের মুখ ও দেহের প্রতিচ্ছবিতে একটি পারিবারিক পরিবেশের জমায়েত’ হিসাবে বর্ণনা করেন।

এরপর কী হবে?
আসিয়ানের সিদ্ধান্তের কী ফল আসবে তার একটি সূচক থাই সীমান্ত থেকে আসবে। এই মুহূর্তে, মিয়ানমার থেকে পালানোর সংখ্যাটি সর্বনিম্ন। এর আগে, থাই কর্তৃপক্ষ শরণার্থীদের ব্যাপক প্রবাহ ঘটবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু তা হয়নি। মিয়ানমারে যদি লড়াই তীব্রতর হয়, তবে লোকেরা সীমান্ত পাড়ি দেবে।

আর যদি তাতমাদাও (সামরিক বাহিনী) জান্তার কথা রাখছে, এমন দৃঢপ্রত্যয়ী প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে আসিয়ান তার যোগাযোগ সম্প্রসারণ করতে এবং সহযোগিতার জন্য ক্ষেত্রগুলো দ্রুত অন্বেষণ করবে। স্পষ্টতই, মানবিক সহায়তা এর একটি ক্ষেত্র হবে, কারণ মিয়ানমার এখন ক্রমবর্ধমানভাবে কোভিড-১৯ সঙ্কটের মুখোমুখি হচ্ছে। যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী করা হয়, দ্রুত আসিয়ান বিশেষ দূত নিয়োগ করা সম্ভব হতে পারে। এটি হলে আসিয়ান অদূরভবিষ্যতে আরো মানবিক কার্যক্রম এবং অন্যান্য অগ্রাধিকারের জন্য কর্মপরিকল্পনা কার্যকর করতে একটি মূল্যায়ন দল সেখানে প্রেরণ করতে সক্ষম হবে।

এর পরও আশা করা যায় না যে, মিয়ানমারে ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফল অনুসারে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সামরিক জান্তা বিদায় নেবে। বর্তমানে যে চতুর্মুখী চাপে সামরিক সরকার পড়েছে তাতে সর্বোচ্চ এটি আশা করা যেতে পারে যে, অদূর ভবিষ্যতে আরেকটি নির্বাচন দিয়ে সেই নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন জান্তা নেতারা। তার আগে আলোচনার মাধ্যমে এনএলডি নেতাদের মুক্তি দেয়া হবে। তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা তুলে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হবে এবং নতুন কোনো ধরপাকড় বা সহিংস অভিযান থেকে বিরত থাকবে সেনাবাহিনী।

এটি যদি না করে তবে যে আশঙ্কা ফিলিপাইনের পররাষ্ট্র সচিব তার টুইটারে করেছেন সেটি বাস্তব হয়ে দেখা দিতে পারে। বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তিগুলো এর মধ্যে তাদের হামলা ও অন্তর্ঘাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা এবং সেনাক্ষয় অনেক বেড়ে গেছে। এমনিতেই বহু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজিত মিয়ানমারে মূল জাতিগোষ্ঠী বামাররা (জনসংখ্যার ৫৮ ভাগ) ছাড়া বাকি সবাই স্বাধিকার বা স্বায়ত্তশাসনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করে আসছে। আর সেই লড়াইয়ে বার্মার অখণ্ডতা ধরে রাখার জন্য বামারদের কাছে গ্রহণযোগ্য শক্তি ছিল তাতমাদাও বা বর্মী সেনাবাহিনী। এবার সেই বামারদের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ সামরিক অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করছে। সামরিক জান্তা গত বছরের নির্বাচনে জালিয়াতির যে অভিযোগ এনে ক্ষমতা দখল করেছে সেটিকে দেশটির সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেনি। এটি স্পষ্ট হয় ব্যাপক প্রতিরোধ আন্দোলন ও রক্তক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে। এর মধ্যে সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদে সাত শতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। সাড়ে তিন হাজারের মতো মানুষ কারাগারে রয়েছে। কিন্তু আন্দোলনকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। আসিয়ানে দেয়া প্রতিশ্রুতি পালনে কোনো সাড়া দৃশ্যমান না হওয়ায় সাথে সাথে আন্দোলনকারীরা নতুন করে অসহযোগের ডাক দিয়েছে।

সামরিক জান্তার শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগ্রামের পাশাপাশি সমান্তরালভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করেছেন আগেই। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সদস্যদের দিয়েই মূলত এই সরকার গঠন করা হয়েছে। ‘জাতীয় ঐক্য’ সরকারের প্রতিনিধিদের জাকার্তা সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে আবেদনও জানানো হয়েছিল; কিন্তু আসিয়ান সম্মেলনে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি প্রতিনিধি বা পর্যবেক্ষক কোনোভাবেই।

সন্দেহ নেই, আসিয়ান নেতারা বুঝতে পেরেছেন, জোটের বিশ্বাসযোগ্যতা ও কার্যকারিতা ঝুঁকিতে রয়েছে। সুতরাং পরিস্থিতিকে আরো জটিল না করে একটি মানবিক বিরতি প্রতিষ্ঠার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা তারা চালিয়েছেন। মিন অং হ্লাইং তার প্রতিবেশীদের কথা শুনতে কার্যকরভাবেই ইচ্ছুক কিনা সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। যদি তাতমাদাওয়ের নারকীয় নির্যাতন অব্যাহত থাকে তবে মিয়ানমারের পরিস্থিতি জটিলতরই হবে।
জান্তাপ্রধান সম্ভবত আসিয়ানকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন, নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং দেশটি নাগরিক শাসনে ফিরে আসবে। সেনাবাহিনী আগেই বলেছে যে দু’বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি থাকতে পারে। অং সান সু চির মুক্তির আহ্বান সত্ত্বেও আসিয়ানের কোনো সদস্য রাষ্ট্রই নভেম্বরের নির্বাচনের ফলাফলকে মেনে নিতে স্পষ্টভাবে কোনো আহ্বান জানায়নি।

জেনারেল মিন অং হ্লাইং যদি নিচে নামতে চান তবে আসিয়ান একটি মই সরবরাহ করার জন্য সেখানে থাকবে, যদিও এরকম কোনো চূড়ান্ত ইঙ্গিত এখনো নেই। যদি মানবিক সরবরাহের অনুমতি দেয়ার জন্য সহিংসতায় বিরতি অর্জন করা যায়, তবে সেটি সাময়িক কিছু অগ্রগতি হবে। বৈঠকের কার্যতালিকাসংক্রান্ত একটি প্রস্তাবের মধ্যে বিশেষ দূত নিয়োগের বিষয়টি রয়েছে। এই ‘তুলনামূলক বিনয়ী’ লক্ষ্যগুলো যদি উপলব্ধি করা যায় তবে এটি কমপক্ষে একটি সূচনা হবে।

বাইরের হস্তক্ষেপের আশঙ্কা
অনেক আঞ্চলিক বিশ্লেষক এবং পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা হলো, আসিয়ানের ব্যর্থতা বাইরের শক্তিগুলোর জন্য হস্তক্ষেপ করার সুযোগ তৈরি করতে পারে। এটি এ জোটের মর্যাদাকেও ক্ষুণ্ন করবে। অবশ্য আরো তাৎক্ষণিক উদ্বেগ হলো একটি মানবিক জরুরি অবস্থা যা ‘শরণার্থীদের তরঙ্গ’ সৃষ্টি করবে এবং এই অঞ্চলের বিশেষত প্রতিবেশী থাইল্যান্ডের কোভিড -১৯ মহামারী পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলবে।

স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক বিকাশকে রাজনৈতিক অধিকারের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য আসিয়ানের খ্যাতি রয়েছে। সেটি চলার অর্থ হলো, এই অঞ্চলে সিরিয়ার মতো সঙ্ঘাতের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হওয়া। মিয়ানমারে অপরিবর্তনীয় স্থিতাবস্থার মুখোমুখি কূটনীতি কিভাবে অগ্রগতি লাভ করতে পারে তার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐক্য সরকার বা এনইউজির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রশ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠবে। সমান্তরাল সরকার যদি জান্তাবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে তার সমর্থনকে আরো বিস্তৃত করতে পারে এবং একটি কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্পষ্টভাবে আবির্ভূত হয়, তবে পশ্চিমা গণতন্ত্র সেটিকে স্বীকৃতি দিতে পারে।

আঞ্চলিক পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অবশ্যই এনইউজির সাথে যোগাযোগের চ্যানেলগুলো বজায় রাখবেন। তবে ক্ষমতায় থাকা ডি-ফ্যাক্টো পার্টির সাথে লেনদেন চালিয়ে যাবেন এবং জান্তাকে বিচ্ছিন্ন করার মতো পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকবেন। আঞ্চলিক পর্যবেক্ষকরা যা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন, সেটি হলো আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের নির্দিষ্ট আহ্বান রয়েছে কিনা সেটি। সংকট যত বেশি স্থায়ী হয়, তত বেশি সম্ভাবনা থাকে যে, বল প্রয়োগের বিষয়টি টেবিলের অন্যতম বিকল্প হিসাবে আসতে পারে।

এটি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আকারে আসতে পারে। সম্ভবত বিষয়টিকে আলোচনার টেবিলে আটকানোর পেছনে এ ধরনের একটি আশঙ্কা কাজ করে থাকতে পারে। অভ্যুত্থান-নির্মাতাদের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞার ব্যবস্থা করা বাদ দিয়ে ওয়াশিংটনের এই সঙ্কটের বিষয়ে ভিন্ন পরিকল্পনার আশঙ্কা করেন অনেকে। তদুপরি, এটি ধারণা করাও কঠিন যে যুক্তরাষ্ট্র তার ‘কোয়াড’ মিত্র যেমন ভারত ও জাপানকে বোর্ডে আনতে সক্ষম হবে কিনা।

বাইরের সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করবে আসিয়ান এবং এটি সম্ভবত মিয়ানমারকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাওয়া ত্বরান্বিত করবে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে ঐতিহাসিকভাবে সাত দশক ধরে জাতিগত সশস্ত্র প্রতিরোধ এবং ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতিকে একত্র করে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। কিন্তু সেটি এখন স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যানের পর্যায়ে পৌঁছেছে।

বিশ্বাসযোগ্য পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বর্তমান সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে ব্যাপক সমর্থন রয়েছে মিয়ানমারের জনসংখ্যার মধ্যে। নতুন মেরুকরণ একটি ফেডারেল আর্মি এবং একটি ফেডারেল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিগত সশস্ত্র দলগুলোকে একত্র করেছে।

তবে প্রতিরোধকারীদের বৃহত্তর লড়াইয়ের শক্তি এবং প্রযুক্তিগত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। এনইউজি ধীরে ধীরে এমন চাপ সৃষ্টি করতে চায় যাতে জান্তার নেতৃত্বে ফাটল ধরে হয়, পুলিশের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, নিরাপত্তা বাহিনী থেকে প্রস্থান ত্বরান্বিত হয় এবং অবশেষে, জান্তার পতন ঘটে।
ফেডারেল বাহিনীর দ্বারা এনইউজির একটি সামরিক বিজয় যে কোনো পরিমাপে দীর্ঘ মেয়াদী বিষয়। তাতমাদাও ঐতিহাসিকভাবে কখনই মিয়ানমারের সব অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি এবং যে জাতিগত সশস্ত্র দলগুলো এখন এক হয়েছে তারা অতীতে প্রমাণ করেছে, তারা অচলাবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। তবে মিয়ানমার স্বাধীনতার পর থেকে যে গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তা এখন নতুন রূপ নিতে যাচ্ছে, যা উভয় পক্ষের জন্যই মারাত্মক, অস্থিতিশীল এবং ক্ষতিকর।

প্রক্সিযুদ্ধের ক্ষেত্র হবে?
আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো মিয়ানমার বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার প্রক্সিযুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত হওয়া। এই প্রক্সি যুদ্ধের প্রধান দুটি পক্ষ হলো চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র। চীন অনেকটা এককভাবে মিয়ানমারে সামরিক জান্তাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে মিয়ানমারের চীনা বিনিয়োগ স্থাপনাগুলো আন্দোলনকারীদের ক্ষোভের শিকার হয়েছে। পাশ্চাত্য সমর্থনপুষ্ট গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সহজ বিজয় চীন চাইবে, এটি মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ মিয়ানমারে চীনের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ অনেক ব্যাপক। মিয়ানমারের আরেক প্রতিবেশী, ভারত আসিয়ান উদ্যোগে সমর্থন জানালেও জান্তাবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এখনো সেভাবে সমর্থন জানায়নি।

অন্য দিকে, যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের এবারের জান্তা শাসনকে কোনোভাবেই বৈধতা দিতে চাইবে না। বিচ্ছিন্নতাকামী দলগুলোর সাথে জাতীয় ঐক্য সরকারের যে জোট তৈরি হয়েছে সেটি ভবিষ্যতে অহিংস থেকে সহিংস রূপ নিতে পারে আসিয়ান সিদ্ধান্তকে জান্তা কার্যকর না করলে। সে ক্ষেত্রে বৈশ্বিক স্নায়ুযুদ্ধের শক্তি পরীক্ষার স্থানে পরিণত হবে মিয়ানমার। এই পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই অতীতের ইতিহাস দিয়ে ব্যাখ্যা করলে হবে না। এ কারণে মিয়ানমারের পরিস্থিতিতে সিরিয়ার অবস্থার সাথে তুলনা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, জান্তা জিতলে দেশটিতে উত্তর কোরিয়া যুগের সূচনা হতে পারে। তখন মানুষের মতপ্রকাশের বা স্বাধীন চিন্তার কোনো অধিকার সেখানে থাকবে না।

mrkmmb@gmail.com


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us