মিয়ানমারে কি বাইরের হস্তক্ষেপ হবে?

ক্যুবিরোধী বিক্ষাভ - ছবি : সংগৃহীত
অনেক আঞ্চলিক বিশ্লেষক এবং পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা হলো, আসিয়ানের ব্যর্থতা বাইরের শক্তিগুলোর জন্য হস্তক্ষেপ করার সুযোগ তৈরি করতে পারে। এটি এ জোটের মর্যাদাকেও ক্ষুণ্ন করবে। অবশ্য আরো তাৎক্ষণিক উদ্বেগ হলো একটি মানবিক জরুরি অবস্থা যা ‘শরণার্থীদের তরঙ্গ’ সৃষ্টি করবে এবং এই অঞ্চলের বিশেষত প্রতিবেশী থাইল্যান্ডের কোভিড -১৯ মহামারী পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলবে।
স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক বিকাশকে রাজনৈতিক অধিকারের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য আসিয়ানের খ্যাতি রয়েছে। সেটি চলার অর্থ হলো, এই অঞ্চলে সিরিয়ার মতো সঙ্ঘাতের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হওয়া। মিয়ানমারে অপরিবর্তনীয় স্থিতাবস্থার মুখোমুখি কূটনীতি কিভাবে অগ্রগতি লাভ করতে পারে তার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় ঐক্য সরকার বা এনইউজির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রশ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠবে। সমান্তরাল সরকার যদি জান্তাবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে তার সমর্থনকে আরো বিস্তৃত করতে পারে এবং একটি কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্পষ্টভাবে আবির্ভূত হয়, তবে পশ্চিমা গণতন্ত্র সেটিকে স্বীকৃতি দিতে পারে।
আঞ্চলিক পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা অবশ্যই এনইউজির সাথে যোগাযোগের চ্যানেলগুলো বজায় রাখবেন। তবে ক্ষমতায় থাকা ডি-ফ্যাক্টো পার্টির সাথে লেনদেন চালিয়ে যাবেন এবং জান্তাকে বিচ্ছিন্ন করার মতো পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকবেন। আঞ্চলিক পর্যবেক্ষকরা যা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন, সেটি হলো আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের নির্দিষ্ট আহ্বান রয়েছে কিনা সেটি। সংকট যত বেশি স্থায়ী হয়, তত বেশি সম্ভাবনা থাকে যে, বল প্রয়োগের বিষয়টি টেবিলের অন্যতম বিকল্প হিসাবে আসতে পারে।
এটি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আকারে আসতে পারে। সম্ভবত বিষয়টিকে আলোচনার টেবিলে আটকানোর পেছনে এ ধরনের একটি আশঙ্কা কাজ করে থাকতে পারে। অভ্যুত্থান-নির্মাতাদের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞার ব্যবস্থা করা বাদ দিয়ে ওয়াশিংটনের এই সঙ্কটের বিষয়ে ভিন্ন পরিকল্পনার আশঙ্কা করেন অনেকে। তদুপরি, এটি ধারণা করাও কঠিন যে যুক্তরাষ্ট্র তার ‘কোয়াড’ মিত্র যেমন ভারত ও জাপানকে বোর্ডে আনতে সক্ষম হবে কিনা।
বাইরের সামরিক হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করবে আসিয়ান এবং এটি সম্ভবত মিয়ানমারকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাওয়া ত্বরান্বিত করবে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে ঐতিহাসিকভাবে সাত দশক ধরে জাতিগত সশস্ত্র প্রতিরোধ এবং ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতিকে একত্র করে নিয়ে যেতে দেখা গেছে। কিন্তু সেটি এখন স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যানের পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বিশ্বাসযোগ্য পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বর্তমান সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে ব্যাপক সমর্থন রয়েছে মিয়ানমারের জনসংখ্যার মধ্যে। নতুন মেরুকরণ একটি ফেডারেল আর্মি এবং একটি ফেডারেল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিগত সশস্ত্র দলগুলোকে একত্র করেছে।
তবে প্রতিরোধকারীদের বৃহত্তর লড়াইয়ের শক্তি এবং প্রযুক্তিগত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। এনইউজি ধীরে ধীরে এমন চাপ সৃষ্টি করতে চায় যাতে জান্তার নেতৃত্বে ফাটল ধরে হয়, পুলিশের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, নিরাপত্তা বাহিনী থেকে প্রস্থান ত্বরান্বিত হয় এবং অবশেষে, জান্তার পতন ঘটে।
ফেডারেল বাহিনীর দ্বারা এনইউজির একটি সামরিক বিজয় যে কোনো পরিমাপে দীর্ঘ মেয়াদী বিষয়। তাতমাদাও ঐতিহাসিকভাবে কখনই মিয়ানমারের সব অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি এবং যে জাতিগত সশস্ত্র দলগুলো এখন এক হয়েছে তারা অতীতে প্রমাণ করেছে, তারা অচলাবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। তবে মিয়ানমার স্বাধীনতার পর থেকে যে গৃহযুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তা এখন নতুন রূপ নিতে যাচ্ছে, যা উভয় পক্ষের জন্যই মারাত্মক, অস্থিতিশীল এবং ক্ষতিকর।
প্রক্সিযুদ্ধের ক্ষেত্র হবে?
আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো মিয়ানমার বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার প্রক্সিযুদ্ধের ক্ষেত্রে পরিণত হওয়া। এই প্রক্সি যুদ্ধের প্রধান দুটি পক্ষ হলো চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র। চীন অনেকটা এককভাবে মিয়ানমারে সামরিক জান্তাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে মিয়ানমারের চীনা বিনিয়োগ স্থাপনাগুলো আন্দোলনকারীদের ক্ষোভের শিকার হয়েছে। পাশ্চাত্য সমর্থনপুষ্ট গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সহজ বিজয় চীন চাইবে, এটি মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ মিয়ানমারে চীনের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ অনেক ব্যাপক। মিয়ানমারের আরেক প্রতিবেশী, ভারত আসিয়ান উদ্যোগে সমর্থন জানালেও জান্তাবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এখনো সেভাবে সমর্থন জানায়নি।
অন্য দিকে, যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের এবারের জান্তা শাসনকে কোনোভাবেই বৈধতা দিতে চাইবে না। বিচ্ছিন্নতাকামী দলগুলোর সাথে জাতীয় ঐক্য সরকারের যে জোট তৈরি হয়েছে সেটি ভবিষ্যতে অহিংস থেকে সহিংস রূপ নিতে পারে আসিয়ান সিদ্ধান্তকে জান্তা কার্যকর না করলে। সে ক্ষেত্রে বৈশ্বিক স্নায়ুযুদ্ধের শক্তি পরীক্ষার স্থানে পরিণত হবে মিয়ানমার। এই পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই অতীতের ইতিহাস দিয়ে ব্যাখ্যা করলে হবে না। এ কারণে মিয়ানমারের পরিস্থিতিতে সিরিয়ার অবস্থার সাথে তুলনা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, জান্তা জিতলে দেশটিতে উত্তর কোরিয়া যুগের সূচনা হতে পারে। তখন মানুষের মতপ্রকাশের বা স্বাধীন চিন্তার কোনো অধিকার সেখানে থাকবে না।
mrkmmb@gmail.com