এবার জার্মান মুসলিমরা যেভাবে রোজা রাখছে
সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে জার্মানির কোলন কেন্দ্রীয় মসজিদে তারাবির নামাজ আদায় করছেন মুসল্লিরা - ছবি : সংগৃহীত
জার্মানিতে রোজার মাস চলছে তা বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই৷ আর এ দেশে রোজা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক লম্বা, পরিবেশও দেশের মতো নয়৷ তবে পবিত্র রোজার মাসে অনেকেই রোজা রাখেন, নামাজ পড়েন৷ যাদের বাড়ির কাছাকাছি মসজিদ রয়েছে তাদের কেউ কেউ তুর্কি বা অন্যান্য মুসুল্লির সাথে তারাবি পড়েন৷ এখানে দেরিতে সূর্য ডোবায় ইফতার দেরিতে হয়৷ তাই কেউ কেউ হয়তো ইফতারের পর একটু দেরি করে রাতে খেয়ে শুয়ে পড়েন সেহরির জন্য আর আলাদাভাবে ওঠেন না৷ আবার কেউবা ইফতারের পর ডিনার না করে শুয়ে পড়েন, পরে সেহরির জন্য ওঠেন৷ আসলে সকালে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার তাড়া থাকে বলেই হয়তো কাউকে এমনটা করতে হয়৷ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মনের জোরেই প্রবাসে নিজের ধর্মকে এভাবে লালন করে থাকেন৷ বেশ উৎসাহ নিয়ে অনেকে বাঙালি ইফতারির আয়োজন করেন৷ রোজা রাখা হোক বা না হোক বন্ধুবান্ধবদের জন্য বাড়িতে মজার মজার খাবার তৈরি করেন৷ ইফতারের পর বাড়িতে একসাথে মিলে অনেকে নামাজও আদায় করেন৷ মসজিদে আজান কিংবা সেহরির জন্য সাইরেন না বাজলেও কিন্তু বাঙালি বাড়ির ইফতারের এরকম আয়োজন অনেকটাই দেশের রোজার কথা মনে করিয়ে দেয়৷ তবে এসবই কিন্তু করোনার আগের কথা, পৃথিবী যখন স্বাভাবিক ছিলো৷
মহামারি করোনা এবারের রমজান মাসের ইবাদত, আনন্দ সবকিছুই একেবারে পাল্টে দিয়েছে৷ হৈচৈ করা বাঙালিদের একেবারে নীরব করে দিয়েছে এই ভাইরাস৷ উপায় যে নেই! জার্মানির সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য নর্থরাইন ওয়েস্টফালিয়া৷ এখানে করোনা সংক্রমণের হারও সবচেয়ে বেশি৷ আমার শহর কোলনে রাত নয়টা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কারফিউ৷ এখন ইফতার হয় রাত সাড়ে আটটার পর৷ কয়েক দিন পরে হবে আরো দেরিতে মানে রোজা হবে আরো লম্বা৷ করোনার কঠোর বিধিনিষেধ অনুযায়ী বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি পরিবার অন্য পরিবারের শিশুবাদে শুধু একজনের সাথে মিলিত হতে পারেন৷ কাজেই করোনার বিধিনিষেধ মেনে অন্যদের সাথে নিয়ে ছোলা, মুড়ি খাওয়া একেবারেই সম্ভব নয়৷
কেন যেন রোজা এলেই আমার সেই ছোট্টবেলার কথা মনে পড়ে! ইস্ কী আগ্রহ নিয়েই না চোখ দুটি কচলাতে কচলাতে কনকনে শীতকে উপেক্ষা করে সেহরি খেতে উঠতাম৷ আর সেহরিতে একদিন না ডাকলে সকালে উঠে সে কী কান্না! যা কেবলই মধুর স্মৃতি৷
জার্মানিতে আমার পরিচিত যারা প্রতিবছর রোজা রাখেন তারা এবারো রাখছেন তবে প্রায় সবার কাছেই এবারের রোজার মাস প্রাণহীন বলে জানালেন৷ অনেক দিন জার্মানিতে আছেন আজিজুল হক ভূঁইয়া, রোজা রাখার পাশাপাশি প্রায় নিয়মিতই বাসার কাছেই মসজিদে নামাজ পড়েন৷ কোলন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী কন্যা জুলিয়াও রোজা রাখছে বাবার সাথে৷ ভূঁইয়া জানালেন, বর্তমান লকডাউন পরিস্থিতিতে মসজিদে নামাজ পড়তে হলে আগে থেকেই মসজিদে জানিয়ে দিতে হয়৷ তাছাড়া জায়নামাজ নিয়ে যেতে হয় এবং দুই মিটার দূরত্ব রেখে জামাতে নামাজ পড়তে হয়৷ সারা দিন রোজা রেখে মসজিদে যাওয়ার চেয়ে এই পরিস্থিতিতে ঘরে নামাজ পড়াই নিরাপদ বলে মনে করেন তিনি৷
কোলনের আরেক পুরনো বাসিন্দা জিয়াউদ্দিন আহমেদ প্রতি শুক্রবারই মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন৷তিনি বলেন, সারাদিন কাজ করেও প্রতি বছরের মতো এবারও রোজা রাখছি, নামাজ পড়ছি, ইফতার, সেহরি সবই হচ্ছে কিন্তু করোনার কারণে আনন্দ নেই মনে৷ তার এলাকার মসজিদের ইমাম সাহেব করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় দুই সপ্তাহ যাবত মসজিদ বন্ধ রাখা হয়েছে৷
জার্মানির ছোট শহর ভের্লের বাসিন্দা মামুন আহমেদ ও তার স্ত্রী অন্যদের মতো প্রায় একই কথা বললেন এবারের রমজান নিয়ে৷ তাদের বাড়ির একদম কাছেই গুম্বুজসহ ছোট একটি মসজিদ রয়েছে৷ করোনার সীমাবদ্ধতার কারণে রমজান মাস নিরবে কাটছে৷
জার্মানির দক্ষিণে এরলাংগেন শহরের বহু পুরনো বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল ওয়াহেদ ও তাঁর স্ত্রী দুজনই রোজার মাসে নিয়মিত নামাজ কোরান পড়ছেন৷ জার্মানিতে সংক্রমণ বাড়ায় ঘরবন্দি জীবন হয়েছে দীঘায়িত৷ আর এর কারণ হিসেবে জনগণের অসচেতনতাই দায়ী বলে মনে করছেন তারা৷ আসলে ঘরবন্দি জীবন সবার জন্যই কষ্টকর হয়ে উঠছে দিনদিন৷ নিজের কথা বলতে গেলে বলতে হয় সবই করা হচ্ছে কিন্তু ছন্দহীনভাবে৷
এদেশের জনসংখ্যার শতকরা ছয় ভাগ মুসলমানের বেশিরভাগই এসেছেন তুরস্ক থেকে৷ বেশ দাপটের সাথেই তারা জার্মানিতে হালাল মাংসের অসংখ্য রেস্তোরা, গ্রোসারি, জুয়েলারিসহ নানা দোকান চালাচ্ছেন৷ রোজার মাসে সাধারণত ছোলা, হালাল গোশত, খেজুর, হালুয়া, বরফির মতো খাবারের চাহিদা বেশি থাকায় তুর্কি গ্রোসারিগুলোতে থাকে বাড়তি ভিড়৷ তবে এবারের রোজায় ওইসব দোকানেও ক্রেতার সংখ্যা তূলনামূলকভাবে কম৷
করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবা থেকে সারা বিশ্বের মানুষ মুক্ত হোক৷ আল্লাহর কাছে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার প্রার্থনা থাকলো পবিত্র রমজান মাসে৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে