করোনায় কমছে মোদির জনপ্রিয়তা!
নরেন্দ্র মোদি - ছবি : সংগৃহীত
কিন্তু পরাক্রমশালী করোনাভাইরাস মোদির মতো যারা হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্ববাদী তাদেরকেও সোজা করতে পারে। অনেক কিছুই করতে বাধ্য করতে পারে, তাই মনে হচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় মুখে স্বীকার না করেও মিডিয়া রিপোর্ট হাজির হতে দিচ্ছে যে ভারত-পাকিস্তান আলোচনা হচ্ছে কখনো গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই আর ‘র’-এর মধ্যে। অথবা প্রশাসনিক কর্তা পর্যায়ে এবং মিডিয়া থেকে দূরে থেকে। এমন আলাপ আগের কংগ্রেস বা বিজেপি আমলেও হয়েছে, আর সেসব হয়েছে মূলত ব্যাংককে। এবারো তা ব্যাংককে বা দুবাইয়ে হচ্ছে বলে মিডিয়া রিপোর্ট দিচ্ছে।
কিন্তু কেন তারা এত লুকোচুপি করে আবার দেখাও করছে? এবং তা নিজ নিজ দেশের বাইরে করছে?
একমাত্র কারণ, মোদির ‘ভোটবাক্স’ প্রায়োরিটি, যা আগে বলেছি। ভারতের কল্পিত বিরাট শত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মোদি একাই লড়ে ভারতের হিন্দুস্বার্থ রক্ষা করে চলেছেন, এই ইমেজ মোদির ভোটবাক্সের জন্য খুবই দরকারি। কিন্তু এর অবস্থা এখন খুবই সঙ্গীন। যেমন কাশ্মিরে লাদাখ সীমান্তে যখন চীনের সাথে ভারতের সামরিক টেনশন চলছিল তখন মোদি-সেনাদের টেনশন বাড়ছিল যে, কখনো যেন ভারতকে চীনের পাশাপাশি পাকিস্তান- এই দুই দেশের সাথে তাদের নিজ নিজ সীমান্ত দুটি যুদ্ধক্ষেত্রে লড়তে না হয় এটা নিশ্চিত করা। তাই সে সময় চীনের পাশাপাশি পাকিস্তানের সাথেও কথা বলে ভারত ধারণা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যে, ভারত পাকিস্তানের সাথেও সঙ্ঘাত চায় না। এটা অবশ্যই দুদেশের জন্যই লাভজনক ছিল। কারণ, যুদ্ধের ফ্রন্ট খুললে তা পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য কোনো ইতিবাচক ঘটনা ভাবার কারণ নাই। আর এই বাস্তবতার সুবিধাটাই ভারত উঠিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু পাবলিকলি দেখা করলে মোদির ভোটবাক্সে টান পড়বে। আর সে কারণে এত লুকোচুরি।
এখানে কোভিডের আরেক সুবিধা বা অসুবিধার কথাও বলা দরকার। গত দেড় দু’বছরে মিডিয়া প্রশ্নে মোদির সরকার বিরাট সুবিধা ভোগ করে চলেছে। ভারতের লিডিং প্রায় সব মিডিয়া এখন মোদির অনুগত, পায়ের কাছে ঘুরঘুর করার অবস্থা! কেন? কারণ প্রতিটি মিডিয়া কোভিডের ঠেলায় বিক্রি ও বিজ্ঞাপন কমে এক অর্থনৈতিক টানাটানিতে ডুবে গেছে। ফলে কর্মীদের ৪০ শতাংশ বেতন দেয়ার প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করতে মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থাটাই বুঝা যাবে এটা দেখলে যে, ধনী-গরিব প্রত্যেক মিডিয়াই এখন পাবলিক ডোনেশনের চাঁদা চেয়ে নোটিশ টাঙ্গিয়ে রেখেছে। কাজেই সবাই এখন একমাত্র ও সহজ উপায় হিসেবে দেখছে বিজেপির রাজনীতির পক্ষে সাফাই দেয়ার কাজকে। এমন মিডিয়া হয়ে যাওয়ার বিনিময়, সরকারি দল বা সরকারি ফান্ড হাতিয়ে নেয়া- এভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টাই এখন সব মিডিয়ার প্রধান ট্রেন্ড বা ধারা। মিডিয়াগুলো আরেক নয়া কৌশল ধরেছে। তারা বলতে চাচ্ছে, তারা আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্ববাদের প্রমোটর নয়। কিন্তু তারাই আবার দাবি করছে, তারা আসলে সেটা করেনি। তারা বরং হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রের সরকার, সরকার যেই হোক তাকে সমর্থন দেয়া দ্য হিন্দুর সুহাসিনী হায়দারের কর্তব্য, অথবা দ্য প্রিন্টের শেখর গুপ্তের কর্তব্য- এরা এই আড়াল টেনে কাজ করে যাচ্ছে।
কিন্তু সম্প্রতি আরো উইকেটের পতন ঘটেছে। এটা শ্রুতি কপিলা নামে একজনের দ্য প্রিন্ট পত্রিকায় এক মন্তব্য-রিপোর্ট। তিনি বলছেন, টুইটারে ‘রিজাইন মোদি’ এই হ্যাশট্যাগ পপুলার ভিত্তি পেয়ে উঠছে। তিনি দাবি করেছেন, এটা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, কোভিড মহামারী এবার এই প্রথম ‘রাজনৈতিক’ হয়ে উঠছে। মানে, রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠছে।
গত বছরের এ নিয়ে বিপর্যয়ের সময়ও চির-স্ট্রং মোদি মহামারী ছাপিয়ে ওঠা সত্ত্বেও নিজ পপুলারিটি নিয়ে সেসবের ঊর্ধ্বে ছিলেন। বহু সার্ভেতেই দেখা গেছে, তিনি উপরে আছেন। মিস কপিলা এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলতে চান, গত বছরের কোভিড পরিস্থিতি কোনোভাবেই কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। কিন্তু জনগণ এর পরও সম্মিলিতভাবে মোদির উপর (তার হিন্দুত্বের উপর) আস্থা রেখেছিলেন যে, তাদের ঐক্যবদ্ধতার কারণে মোদি সবাইকে রক্ষা করে নেবেন।
মিস কপিলা লিখছেন, ‘ভারতে এখন প্রতিদিন নতুন আক্রান্ত রোগী তিন লাখ; এমন সংখ্যা এটাই সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীকে কম করে মাফ করা শুরু করেছে। টুইটারে প্রকাশিত ট্রেন্ড, ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া হতাশা, এগুলোই সম্ভবত মোদির হিন্দুত্বের সমর্থন হারানোর প্রথম ইঙ্গিত! এখন ক্রমশ ভয়ের ওপর প্রাধান্য দিতে দেখা যাচ্ছে ‘বিক্ষুব্ধ’ হয়ে উঠাকে। সম্ভবত এদিকটা খেয়াল করেই, মোদি সম্প্রতি পাবলিককে ডিসিপ্লিন থাকার জন্য আকুল আবেদন করেছেন।’
তাহলে এবারে মোদির হিন্দুত্ব- এটা আর কোনো মহামারীর বিপর্যয় ঠেকাতে পারছে না? কোভিডের মহামারীতে চিকিৎসার অভাব আর পেটের টানের বিরুদ্ধে এবার ‘হিন্দুত্ব’ আর সব ঢেকে ফেলতে পারছে না! হিন্দুত্বের জোশ আর কি কাজ করছে না? মোদি এবার সব আগলে রাখতে কি ফেল করবেন! মোদি আস্থাহীন নেতা হবেন কি?
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com