ইমরান-মোদি দ্বৈরথের ফলাফল
ইমরান খান ও নরেন্দ্র মোদি - ছবি : সংগৃহীত
আমাদের প্রসঙ্গ মোদি-ইমরানের মধ্যে সীমিত করব। ভারত-পাকিস্তানের অবস্থা এখন এমন যে, সবাই ন্যূনতম এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চায় হয়তো; সব পক্ষেরই কাম্য এটা কিন্তু একই সাথে এর সমস্যা অন্যখানে। কারণ, এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এমনকি বিজেপি-আরএসএসের মোদিরও হয়তো অকাম্য নয়। পেয়ে গেলে তা মোদির জন্য খারাপ কিছু হতো না। কিন্তু সমস্যা হলো, প্রায়োরিটির। অর্থাৎ মোদিও পাকিস্তানের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চান না অথবা কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী ইমরান ক্ষমতায় এসেছেন তার সাথে নতুন উদ্যোগ নেবেন, তা করতেও মোদির কোনো আপত্তি আছে- ব্যাপারটা তা নয়, তা একেবারেই নয়। সমস্যা হলো প্রায়োরিটির।
মোদির প্রায়োরিটি হলো, ভারতের নির্বাচনে ‘হিন্দু-ভোটের মেরুকরণ’ হতে হবে, পরিস্থিতিকে এমন হতে বাধ্য করতে হবে যাতে সব হিন্দু-ভোট তাদের বাক্সমুখী হয়, এমন এক উত্তেজনা সৃষ্টি করা। কারণ ইমরান ক্ষমতায় আসার পরের বছর ২০১৯ সালের মে মাসে মোদিকে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার নির্বাচনে জিততে হবে। তাই পাকিস্তানের সাথে মিথ্যা করে হলেও সীমান্ত-উত্তেজনা সৃষ্টি করা, সেভাবে ভারতের সেনা ও সিভিল প্রশাসনকে সাজানো আর ঠিক নির্বাচনের আগে এই বিবাদকে চরমে তোলা- এটাই হয়ে পড়েছিল মোদির প্রায়োরিটি। পাকিস্তানের ইমরানের সাথে সম্পর্কের চেয়ে বরং ভোটের বাক্সে হিন্দু মেরুকরণের ভোট, এটাই মোদির সবার উপরের প্রায়োরিটি হয়ে পড়েছিল। তাই, ছদ্ম যুদ্ধ লাগানো, পাকিস্তানে মিথ্যা বোমা ফেলে আসার ছলনা তৈরি, ইত্যাদিই খুবই টপ প্রয়োরিটি ছিল মোদির কাছে। আর ৩৬ ইঞ্চি ছাতি দিয়ে মোদিই একমাত্র ভারত রক্ষাকারী নায়ক- এই ইমেজ ছিল ভোটে মোদির ‘তুরুপের তাস’!
অন্য ভাষায় বললে, মোদির হিন্দুত্ব মানে হিন্দু জাত-ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব- এমন দাবি করে যে রাজনীতি মোদি খাড়া করতে চান, অর্থাৎ কেউ হিন্দু হলেও বাস্তবত বরং সে হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার নাও হতে পারে, এমন হিন্দুত্বের রাজনীতির বাহক তিনি নাও হতে চাইতে পারেন- মোদি এটা হতে দিতেই চান না। পরিষ্কার ভিন্নতাটা অস্পষ্ট করে, মানে দিতে চান উল্টা। বলতে চান, কেউ হিন্দু মানেই সে মোদির হিন্দুত্ব রাজনীতির বাহক- এই একমাত্র অর্থ এবং ব্যাখ্যা ও বয়ানে তা আটকে রাখতে চান। এটাই বিজেপি-আরএসএসের রাজনীতি ও হিন্দু-শ্রেষ্ঠত্ববাদ। এটাই হিটলারের জার্মান আর্য-নীল চোখের শ্রেষ্ঠত্ববাদ অথবা ট্রাম্পের সাদা শ্রেষ্টত্ববাদ- এদের সবারই আরেক ভাই হিসেবে মোদির হিন্দুত্বের উত্থান ঘটেছে।
মনে রাখতে হবে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাসে ইমরান খানই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী- যিনি পাকিস্তানের তরুণ; নতুন করে যারা পাকিস্তানকে নিয়ে চিন্তা করতে চান এরই প্রতীক হলেন ইমরান। যিনি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, পাকিস্তানি নাগরিক সে যে ধর্মেরই হোক- তার সব নাগরিকের মতোই সমান অধিকার আছে। ব্লাসফেমি আইন- যেটা এতদিন মূলত জমিজমার দখলের সঙ্কীর্র্ণ স্বার্থ উদ্ধারের কাজে করা মামলা হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে, এমন আসামিদের মামলার বিচারে সুপ্রিম আদালত যাকে খালাস দিয়েছে, নির্বাহী সরকার প্রধান হিসেবে ইমরান নিশ্চিত করেছেন তার মুক্তি; ইচ্ছামতো দেশ-বিদেশ যাওয়া বা চলাচলের। ইমরান এটা তার প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য কর্তব্যজ্ঞান করেছেন।
অথচ চরম সঙ্কীর্ণ এবং হিন্দুত্বের ভোট জোগাড়ে ব্যস্ত বিজেপির মোদি এমন ইমরানের কাছ থেকে ভারতের জন্য কোনো সুবিধাই নিতে পারেননি। কারণ মোদির লক্ষ্য অন্য কিছু। তাই ভারত-পাকিস্তানের বিবাদের ইস্যুগুলোর কোনো একটার বেলায় কিছু হাল করা, উদ্যোগী হতে পারেননি মোদি। ভৌগোলিকভাবে পাকিস্তানে পড়েছে যে কার্তারপুর-এর শিখ গুরুদুয়ারা, তা ভারতের পাঞ্জাবের শিখেরা এখন যেকোনো ভ্রমণকারীর মতো ২০ ডলার ফি দিয়ে ভ্রমণ করে আসতে পারেন। মানে, গুরুদুয়ারা তীর্থ করে আসতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী ইমরানের কারণে এটা সহজেই বাস্তব হয়ে গেছে।