রাজা রামমোহন রায় ও বিদ্বেষের সূচনা

রাজা রামমোহন রায় - ছবি : সংগৃহীত
রাজনীতিবিদ অপেক্ষাকৃত তরুণ কেউ হলে একটা বাড়তি সুবিধা কখনো পেতে বা নিতে দেখা যায়। সেই হলো অ্যাপ্রোচ, মানে কোনো মনোভাব থেকে বসে একটা সমস্যাকে সে দেখবে? আগের রাজনীতিক নেতারা যেভাবে দেখে এসেছেন সেভাবেই? নাকি নয়া উদ্যোগে? কোনো নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা বিকল্প পথ খুঁজে দেখে তাতে সমাধান বা অবস্থা বদলের চেষ্টা করবেন? দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতা বা প্রধানমন্ত্রী নতুন বা অপেক্ষাকৃত কম বয়সী হলে তিনি অনেক ভিন্ন দিক থেকে সমাধান খুঁজতে চাইছেন যা আগে ভাবা হয়নি। সমস্যা বা বিরোধগুলোকে বিপক্ষ অংশের সাথে মানে তাদের চোখেও দেখে এক নয়া অ্যাপ্রোচে নতুন পথে সমাধান বা বিপক্ষকে মানানোর বা পরস্পরের সমস্যাটা ঠিক কোথায় তা ঠিকঠাক বুঝে এগোনোর পথ এক্ষেত্রে খুঁজে থাকেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তেমনই একজন!
ইমরান যখন ২০১৮ সালের আগস্টে প্রধানমন্ত্রীর শপথ নেন, তখন ভারতে বিজেপির মোদির প্রথম টার্মে ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে চার বছর পার করে ফেলেছেন। কারণ, মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালের মে মাস থেকে। মানে পরের বছর ২০১৯ সালের মে-তে মোদি আবার নির্বাচনে দাঁড়াবেন। মোদি দ্বিতীয়বার দাঁড়িয়েছিলেন এবং তিনিই ‘বিজয়ী’ বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু ইমরান খান পাকিস্তানের আগের যেকোনো প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে নয়া অ্যাপ্রোচ, নয়া উদ্যোগ নেয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন অপেক্ষাকৃত কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই। সার কথায়, নয়া উদ্যোগের প্রধানমন্ত্রী ইমরানের থেকে মোদির ভারত নয়া উদ্যোগ বা অ্যাপ্রোচের সুবিধা পেতে বা নিতে চান বা নিয়েছেন; এমন তো আমরা দেখিনি। কেন?
প্রথমত এটি ঠিক মোদির বিরুদ্ধে যতটা অভিযোগ, এর চেয়ে বরং বলতে হবে মোদির পক্ষে এমন কোনো আশা দেখানো বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার নয়া উদ্যোগ এগোনো বা ইমরানকে উৎসাহ দেয়া ইত্যাদি আসলে মোদির পক্ষে সম্ভবই ছিল না। সেই প্রসঙ্গেই এখানে বলব।
তবে এর আগে, সাধারণভাবে, ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান এই তিন দেশের দুর্ভাগ্য যেখানে আটকে গেছে ও শুরু হয়েছিল তা নিয়ে দুটি সাদা কথা বলে নেবো। ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় বিরোধের ইস্যু এমন যে, এর অন্তত কিছু গূঢ়-ইস্যু নিয়েই অনন্তকাল বিবাদ চালিয়ে দেয়া সম্ভব। মানে কোনো সমাধানের দেখা পেতে এখানে কতগুলো প্রজন্ম লাগবে এর হদিস কেউ জানে না। কাশ্মির ছাড়াও জন্ম থেকেই বিরোধের সূত্রপাত এমন ইস্যু অনেক আছে।
কিন্তু এই বিরোধগুলোর আসল উৎস কী তা স্বল্প কথায় বললে- এর প্রধান উৎস হলো, ব্রিটিশরা কলোনি-ইন্ডিয়া ত্যাগ করে চলে গেলে কলোনিমুক্ত ভারত কেমন রাষ্ট্র হবে এ নিয়ে অপরিপক্ব জবাব দেয়ার চেষ্টা এবং রাষ্ট্র নিয়ে খাটো চিন্তা-ধারণা হাজির করা থেকেই আজকের ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান- এই তিন দেশ সেই থেকে সাফার করে আসছে, ধুঁকে মরছে।
কোনো একদল নিজ ধর্মীয় বা যেকোনো আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্র করবে বলে, বুঝে বা না বুঝে গোঁ-ধরলে এর পরিণতিতে তা বাকি সব পক্ষই আরেকটা করে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম বা ভাষা অথবা অন্য যেকোনো ভিন্নতার আইডেনটিটির ভিত্তিতে জাতি-রাষ্ট্র গড়তে চাইবেই। সব বিবাদের শুরু এখান থেকে, নানান দিকে তা যাবেই। এটা অনিবার্য। এই সরল সত্য ও বাস্তবতা বোঝার যোগ্যতা কারো ছিল না। বরং সবাইকে একটা আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্রে আনতেই হবে আর সেটা হতে হবে হিন্দু-জাতিরাষ্ট্রই; এভাবে তা বাকি সবার উপরে চাপিয়ে দিয়ে হলেও যেন ‘এটাই হতে হবে’। কংগ্রেসের এই জবরদস্তি, এ থেকেই সব বিরোধের আরো ডালপালায় বিস্তার এখনো চলছে। এর শুরু বা আদিপাপের রচয়িতা-কর্তা মুসলিম লিগ বা জিন্নাহ নয়। এরা নিরুপায় অনুসারী মাত্র। সেই মূল রচয়িতা-কর্তা হলেন ১৮১৫ সাল থেকে শুরু করা রাজা রামমোহন রায় ও তার ব্রাহ্মসমাজ। তিনি বোকা নাকি ইসলামবিদ্বেষী? যাই হোক, কমিউনিস্টদের চোখে রামমোহন নাকি ‘বেঙ্গল রেনেসাঁর আদিগুরু’! এখন তাহলে কমিউনিস্টরা ব্যাখ্যা করে দিন যে, কমিউনিস্টদের চোখে ধর্মচর্চা তো এখনো খুবই খারাপ কাজ। এই বহু-কথিত রেনেসাঁর আদিগুরু রামমোহন, তিনি কী করে নতুন একটা ধর্ম- ব্রাহ্মধর্ম চালু করেন? এ কোনো বিপ্লবীপনা? আর এটা নিয়েই বা সব রেনেসাঁবাদী কমিউনিস্টরা বেমালুম চুপচাপ নির্বিকার কেন? কিভাবে? এর সাফাই কী এবং কৈ?
আমাদের অনেকের মনে হতে পারে, ভারত-পাকিস্তানের ক্যাঁচাল থেকে বাংলাদেশ এখন স্বাধীন হয়ে অনেক দূরে গিয়ে বেঁচেছে। কিন্তু না। এমন মনে হলেও এটা তা নয়। কারণ অখণ্ড ভারতে আমাদের মূল বিবাদ ছিল, ভাষা বা ধর্মীয় আইডেনটিটির জাতিরাষ্ট্র খাড়া করে সমাধা পাওয়ার খায়েশ থেকে শুরু হওয়া লড়াই। তাতে বাংলাদেশে আমরা এখন ভৌগোলিকভাবে ভারত-পাকিস্তানের কেউ না বলে তাদের ক্যাঁচালের কেউ না- এই আত্মপ্রসাদ পেতে চাইলেও যা আমরা সাথে নিয়েই হাঁটছি তা হলো, বাংলাদেশ এখনো একটা ভাষা বা ধর্মীয় আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্রই। সেই আদিপাপ আমরা ত্যাগ করতে পারিনি। বাংলা ভাষাভিত্তিক আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্র কেন ধর্মীয় আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্র থেকে কোনো অর্থেই আলাদা কিছুই না? মূল কারণ, যেকোনো আইডেনটিটির জাতি-রাষ্ট্র মাত্রই একটা অস্থিতি ও বিবাদের উৎস হয়ে থাকবে বলে এ থেকে বের না হতে পারার বিবাদ থাকবে। এ কারণে, হিন্দু-মুসলমান নিয়ে বিবাদে আমরা এখনো সবাই প্রায়ই আক্রান্ত হই, আর এতে সামাজিক-অর্থনৈতিক সব অর্জন ম্লান হয়ে যায়।