চল মিনি আসাম যাবো

জয়নাল হোসেন | Apr 24, 2021 03:31 pm
আসাম

আসাম - ছবি : সংগৃহীত

 

আজকে ভারতের সেভেন সিস্টার হিসেবে পরিচিত এলাকাটি একসময় ছিল বার্মার নিয়ন্ত্রণে। ব্রিটিশরাজ আসামসহ ওই এলাকা দখলে নেয়। কবি কালি দাশগুপ্তের ‘চল মিনি আসাম যাব’ গানটি স্মরণ করিয়ে দেয় ওই আসামের কথা, যেখানে বলা হয়েছে আসামের চা বাগানের শ্রমিকদের ধোকা দিয়ে নিয়ে কষ্টে ফেলার কথা।

চল মিনি আসাম যাবো, দ্যাসে বড় দুখরে
আসাম দ্যাসে রে মিনি চা বাগান হরিয়াল
আসাম দ্যাসে রে মিনি চা বাগান হরিয়াল
কোঁড় মারা যেমন তেমন বাকাতলা টান গো
হায় যদুরাম, ফাঁকি দিয়া পাঠাইলি আসাম
হায় যদুরাম, ফাঁকি দিয়া পাঠাইলি আসাম
এক পয়সার পুঁটিমাছ, কায়া গোলার তেল গো
মিনির বাপে মাঙ্গে যদি আরোই দিব ঝোল গো
মিনির বাপে মাঙ্গে যদি আরোই দিব ঝোল গো
চল মিনি আসাম যাবো, দ্যাসে বড় দুখরে
আসাম দ্যাসে রে মিনি চা বাগান হরিয়াল
আসাম দ্যাসে রে মিনি চা বাগান হরিয়াল
সরকার বলে কাম-কাম, বাবু বলে ধইরা আন
সাহেব বলে লিব পিঠের চাম
হায় যদুরাম, ফাঁকি দিয়া পাঠাইলি আসাম…

উল্লেখ্য, চা উৎপাদনের জন্য আসামের খ্যাতি দুনিয়া জোড়া। আসামের এ চায়ের বৈজ্ঞানিক নাম হলো ক্যামেলিয়া আসামিকা (Camellia assamica)। চা ছাড়াও হাতি, বাঘ ও এক শিংওয়ালা গন্ডারের জন্যও আসামের খ্যাতি রয়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীন ও এশিয়ার মধ্যে প্রথম আবিষ্কৃত তেলকূপ (১৮৮৯) আসামের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় জেলা তিনসুকিয়ার ডিগবৈ-এ অবস্থিত।

আসাম নামকরণ
পর্বতভূমি ও অসমতল (অসমভূমি) হওয়ায় রাজ্যটি অসম (অপভ্রংশে আসাম) নামে অভিহিত- এ মত কেউ কেউ প্রকাশ করে থাকেন। অপর মতে, অসম প্রতাপবিশিষ্ট আহম জাতির হাতে একসময়ে অধিকৃত হওয়ায় প্রদেশটির নাম আসাম হয়েছে। বিখ্যাত ব্রিটিশ ভাষাতাত্ত্বিক জর্জ গ্রিয়ারসনের মতে, আসাম নামটির উদ্ভব হয়েছে সান শব্দ থেকে। সানরা বাস করত বর্তমান চীনের উন-নান (Yun-Nan) প্রদেশে। এখনো তারা সেখানে বাস করে। তাদের একটি শাখা উত্তর বার্মায় (মিয়ানমার) এসে উপস্থিত হয়। উত্তর বার্মায় উপস্থিত সানদের এক নেতা এসে জয় করেন পূর্ব-আসাম; যা এখন শিব সাগর ও ডিব্রুগড় জেলা। এরপর তারা সারা আসামে অর্থাৎ কামরূপ অঞ্চলও দখল করতে সক্ষম হয়।

সানরা তিব্বতি চীনা পরিবারভুক্ত (Sino-Tibetan) ভাষায় কথা বলে; আর্য পরিবারভুক্ত ভাষায় নয়। সানদের রাজা চুচেন জাফা (Chuchen Jpha) খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতকে হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেন। তার রাজত্বকাল থেকে আসামি বা অহমিয়া ভাষা সমগ্র আসামের রাজভাষা হয়ে উঠতে আরম্ভ করে এবং অষ্টাদশ শতকের মধ্যে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

আসামের জনসংখ্যা অনেকাংশেই নানাধর্মী। এখানে অসমীয়া, বাঙালি, নেপালি, বিহারি, মারোয়াড়ি সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। চা-উপজাতির মতো বিভিন্ন উপজাতির লোকেরা (ছোট নাগপুর মালভূমি অঞ্চল থেকে উপনিবেশিক চা রোপণকারীরা চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক হিসেবে নিয়ে এসেছিল) যেমন, বোড়ো, মিশি ইত্যাদিরা এই অঞ্চলকে তাদের বসতিতে পরিণত করেছে।

আসামের একসময়ের নিয়ন্ত্রণকারী ছিল বার্মা। বার্মা নামটি সংস্কৃত ব্রহ্মদেশ নামের সঙ্গে সম্পর্কিত। বর্মী ভাষায় দেশটিকে মিয়ানমার নামে ডাকা হয়। চৈনিক ভাষায় (মান্দারিন) এর নাম মিআন বা মিআনদিআন। আসামে একে মান দেশ বলে। ১৮৮৬ সালে রেঙ্গুনকে বার্মার রাজধানী করা হয়। ১৯৪৬ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল, তখন আরকানের রোহিঙ্গা মুসলিম নেতারা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হবার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আরাকানের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা পাকিস্তানের সাথে একীভূত করতে আগ্রহ দেখাননি। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬২ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে। সামরিক জান্তার প্রধান ছিলেন জেনারেল নে উইন। সেখানকার সামরিক সরকার ১৯৮৯ সালে বার্মার নতুন নামকরণ করে মিয়ানমার এবং প্রধান শহর ও তৎকালীন রাজধানী রেঙ্গুনের নতুন নাম হয় ইয়াঙ্গুন। তবে গণতান্ত্রিক দলগুলোর অনেক অনুসারীই এই নামকরণের বিপক্ষে। ২০১০সালের ২১ অক্টোবর থেকে দেশটির জাতীয় সংগীত ও নতুন জাতীয় পতাকা প্রবর্তন করা হয়। আজ মিয়ানমারের নতুন রাজধানী নেপিডো। উল্লেখ্য, ২০০২ সালে পিনমানা শহরের কাছে, দেশের প্রাক্তন রাজধানী রেঙ্গুন বা ইয়াঙ্গুন থেকে ৩২০ কিলোমিটার উত্তরে নেপিডো শহরের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১২ সালে নেপিডো শহরটির নির্মাণকাজ শেষ হয়।

উত্তরপূর্ব ভারতের গুরুত্বপূর্ণ আসাম বা অসম রাজ্যটি হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত এবং এর অভ্যন্তরে রয়েছে ব্রহ্মপুত্র নদ, বরাক উপত্যকা ও উত্তর কাছাড় পর্বতমালা। উত্তর পূর্ব ভারতের আরো ছয়টি রাজ্য, যথা অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে বেষ্টিত এই আসাম। আসামসহ সাতটি রাজ্যই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি বিভাগের কোচবিহার ও আলীপুরদুয়ার জেলাদ্বয়ের পূর্বাংশের মাধ্যমে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে সংযুক্ত। এছাড়াও আসামের আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভূটান ও বাংলাদেশের সঙ্গে।

প্রথম অ্যাংলো-বার্মা যুদ্ধ

বার্মা যা বর্তমানে মিয়ানমার নামে পরিচিত তা ১৮২৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম অ্যাংলো-বার্মা যুদ্ধ শেষে ১৮২৬ সালে ঐতিহাসিক ইয়াণ্ডাবু (Yandabo) চুক্তির মাধ্যমে আসাম প্রথম ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। যুদ্ধ সমাপ্তির পর ১৮২৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তিপত্রের নাম ইয়াণ্ডাবু সন্ধি বা ইয়াণ্ডাবু চুক্তিপত্র (Treaty of Yandabo)। ব্রিটিশ বাহিনীর তরফ থেকে স্যার আর্চিবল্ড ক্যাম্পবেল আর ব্রহ্মদেশের তরফ থেকে লেগাইংগয়ের রাজ্যপাল মহামিন লা কিয় টিন এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার সময় ব্রিটিশ বাহিনী বার্মার তৎকালীন বার্মার রাজধানী আভা থেকে ৪০ কি.মি. দূরত্বে ইয়াণ্ডাবু নামক স্থানে উপস্থিত ছিল। এই সময়ে তাদের শর্ত মেনে নিয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করার জন্য বর্মিদের বাধ্য করেছিল ব্রিটিশ বাহিনী।

ইয়াণ্ডাবু সন্ধির শর্তগুলো ছিল নিম্নরূপ

(১) অসম, মণিপুর, আরাকান ও টেনাসেরিমসহ শালউইন নদীর দক্ষিণ উপত্যকা ব্রিটিশদের হাতে ন্যস্ত করা।
(২) কাছাড় ও জৈন্তিয়া অঞ্চলে হস্তক্ষেপ না করা।
(৩) যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০ লক্ষ ব্রিটিশ পাউন্ড চার কিস্তিতে ব্রিটিশদেরকে দিতে হবে।
(৪) আভা ও কলকাতার মাঝে স্থায়ী ব্রিটিশ প্রতিনিধি নিয়োগ করা।
(৫) ব্রিটিশদের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করা।

ব্রিটেনের ইতিহাসে এই যুদ্ধটি ছিল সবচেয়ে ব্যয়বহুল যুদ্ধ। চুক্তি স্বাক্ষরের পরে যুদ্ধের অবসান ঘটে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৫ হাজার ভারতীয় ও ইংরেজ সৈন্য প্রথম ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধে নিহত হয়েছিল। এই যুদ্ধে ব্রিটেনের সর্বমোট ৫০ লক্ষ পাউন্ড খরচ হয়েছিল যা ১৮৩৩ সালের দিকে ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থাকে তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে নিক্ষেপ করেছিল।

এই চুক্তির পর থেকে ব্রহ্মদেশের মানদের স্বাধীনতার অবসান ঘটে। চুক্তিমতে ১০ লক্ষ ব্রিটিশ পাউন্ড পরিশোধ করার ফলে মান সাম্রাজ্যে তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়। এরপর ব্রিটিশরা মান সাম্রাজ্যের সঙ্গে আরো দু'বার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৮৮৫ সালের মধ্যে ব্রিটিশরা সমগ্র ব্রহ্মদেশ নিজেদের অধিকারে নিয়ে নেয়।

আসাম প্রদেশকে প্রথমে বাঙ্গালার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে রাখা হয়েছিল। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গব্যবচ্ছেদ উপলক্ষে এই রাজ্যকে পূর্ববঙ্গের সাথে একত্রিত করে জনৈক নতুন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে নেওয়া হয় এবং পশ্চিম বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা পুরাতন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের শাসনাধীন থাকে। দিল্লির করোনেসন দরবার উপলক্ষে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর সম্রাট যে ঘোষণা পাঠ করেন, এর ফলে দুই বঙ্গ মিলে একটি প্রদেশ; আর বিহার, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুর নিয়ে একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হয়। প্রথমটি একজন গভর্নর এবং দ্বিতীয়টি একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে দেয়া হয়।

আসাম প্রদেশকে আগের মতো জনৈক চিফ কমিশনারের শাসনাধীন করা হয়। ১৯১২ সালের এপ্রিল মাস থেকে এই ঘোষণা কাজে পরিণত হয়েছিল। ওই সময় আসামের রাজধানী করা হয় শিলং। পরে ১৯২১ সালের নতুন সংস্কার বিধি অনুসারে বড় প্রদেশগুলোর মতো আসামও একজন গভর্নরের শাসনাধীন হয়েছে। আসাম ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা নিযুক্ত একজন রাজ্যপালের মাধ্যমে শাসিত হয়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর আসাম রাজ্যের পুনর্গঠন হয়। ১৯৬৩ সালে আসামের নাগা পার্বত্য জেলা নিয়ে গঠিত হয় নাগাল্যান্ড (রাজধানী কোহিমা)। ১৯৭০ সালে গারো, খাসিয়া ও জৈন্তিয়া নিয়ে মেঘালয় অন্তরাজ্য গঠিত হয় যা ১৯৭২ সালে পূর্ণ রাজ্যের রূপ লাভ করে। তখন থেকে শিলং শহর মেঘালয়ের রাজধানী হিসাবে থাকলেও আসামের রাজধানী করা হয় গৌহাটি শহরে। ১৯৭২ সালে অরুনাচল ও মিজোরাম কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চল ঘোষিত হয়। ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরে অরুণাচল (রাজধানী ইটানগর) ও মিজোরাম (রাজধানী আইজল) পূর্ণ রাজ্যের রূপ পায়।

আসামের অন্যতম নগর কামরূপের প্রাচীন নাম প্রাগজ্যোতিষপুর। এখানে পৌরাণিক যুগে জনৈক রাজার ছেলে ছিলেন মহাভারত বর্ণিত ভগদত্ত। তার পরবর্তী রাজাদের কীর্তি গৌহাটি প্রভৃতি স্থানে এখনো কিছুটা দেখা যায়। এছাড়াও খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দে কামরূপ নামে এই অঞ্চলের পরিচিতি ছিল। এই অঞ্চলে আহোম সাম্রাজ্য (১২২৮-১৮৩৮) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে এই রাজ্য আসাম নামে পরিচিত হয়।

আহমরাজগণের মধ্যে রুদ্রসিংহ অধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। অষ্টাদশ শতকে আহমরাজরা অন্তর্বিদ্রোহ ও বহিরাক্রমণবশত হীনবল হয়ে পড়েন। ১৭৯২ সালে রাজা গৌরীনাথ সিংহ, দারাংয়ের কোচ রাজা ও মোয়ামারিয়া নামক ধর্মসম্প্রদায়ের নেতাদের হাতে সিংহাসনচ্যূত হন। ভারতের ইংরেজ সরকার দেশীয় রাজ্যে হস্তক্ষেপ করা হবে না- এ নীতি অবলম্বন করে উদাসীন থাকাতে, আহম রাজা ব্রহ্মরাজকে মধ্যস্থতা করতে আহ্বান করেন। এর ফলে ব্রহ্মবাসীরা রাজ্য অধিকার করে এবং কঠোরভাবে শাসনদণ্ডের পরিচালনা করতে থাকে। ১৮২৪ সালে ব্রহ্মরাজের সাথে ইংরেজদের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৮২৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রহ্মরাজের সাথে ইংরেজের যে সন্ধি হয়, তার ফলে ইংরেজরা এ প্রদেশটি লাভ করে। নিম্ন আসাম তখনই প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজের শাসনাধীন হয়। ১৭৬৫ সালে বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভের সাথে সাথেই শ্রীহট্ট ও গোয়ালপাড়া ইংরেজদের অধিকারভুক্ত হয়। অপুত্রক রাজা গোবিন্দচন্দ্রের মৃত্যুর পর ১৮৩০ সালে কাছাড় ইংরেজের হস্তগত হয়। পরে গারো পর্বত, খাসিয়া পর্বত, জয়ন্তী পর্বত, নাগা পর্বত প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশ ইংরেজের অধীনতা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়।

ভারতের তেল শহর
আসামের ডিগবৈ (Digboi) ভারতের তেল শহর হিসেবে খ্যাত। বিশ্বের দ্বিতীয় ও এশিয়ার প্রথম তেলকূপ এখানে খনন করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, ডিগবৈ হলো ভারতের আসাম রাজ্যের উত্তর-পূর্ব অংশের তিনসুকিয়া জেলার একটি শহর। ১৯ শতকের শেষদিকে এখানে অপরিশোধিত তেলের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল। ১৯০১ সালে এখানে প্রথম তেল শোধনাগার চালু হয়েছিল। ডিগবৈ প্রাচীনতম তেলকূপ থেকে এখনো তেল পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের স্বাধীনতার পরের দশক পর্যন্ত অসম তেল সংস্থার হয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্রিটিশ পেশাদার কাজ করেছেন। ডিগবৈয়ে একটি উন্নত অবকাঠামো ছিল এবং শহরে বেশ কিছু অসাধারণ বাংলো রয়েছে। এখানে ডিগবৈ ক্লাবের অংশ হিসেবে আঠারোটি গর্তের গলফ কোর্স রয়েছে। উচ্চ আসামে পর্যটন প্রচারের জন্য ইতালিয়ান স্থাপত্য পরিকল্পনার ভিত্তিতে গেস্ট হাউস ও পর্যটক আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য, বিশ্বে প্রথম তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় আমেরিকায়। এডউইন এল. ড্রাক ১৮৫৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ার টাইটাসভিলি নামক স্থানে বিশ্বের প্রথম তেল কূপটি খনন করার মাত্র সাত বছরের মাথায় ভারতের আসামে ‘কালো তরল সোনা’ অর্থাৎ খনিজ তেলের খোঁজ মেলে। এক শতাব্দীরও বেশি আগে, আসামের প্রত্যন্ত এলাকায় ম্যালেরিয়া আক্রান্তদের মাঝে ইতিহাস তৈরি হয়েছিল ‘কালো তরল সোনার’ সন্ধান পাওয়ার মাধ্যমে। ১৮৬৭ সালে, ডিব্রুগড় থেকে মারঘেরিতা (আসাম রেলওয়ে এবং ট্রেডিং কোম্পানির সদর দফতর) পর্যন্ত একটি রেলপথ নির্মাণের সময়, অসম রেলওয়ে ও ট্রেডিং সংস্থার দায়িত্ব প্রাপ্ত ইতালীয় প্রকৌশলীরা মারঘেরিতা থেকে প্রায় ১০ মাইল দূরে তিনসুকিয়ার ডিগবৈতে তেল আবিষ্কার করেছিল। ইংরেজ প্রকৌশলী, মিঃ ডাব্লু এল লেক বলেছিলেন, ‘ডিগবৈতে (খনন করো ছেলে, খনন করো- Dig, boy, Dig)’। পায়ে তেলের দাগ নিয়ে ঘন অরণ্য থেকে হাতি বের হয়ে এসেছিল। তৈলাক্ত পদচিহ্নগুলোর সন্ধান করে তারা দেখতে পায় যে ভূমিতে তেল চুঁইয়ে এসেছে। ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে একজন, ইংরেজ উইলি লিওভা লেক, ছিলেন ‘তেল উৎসাহী’ এবং তিনি সংস্থাকে সেখানে একটি কূপ খনন করতে রাজি করিয়েছিলেন। অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড প্রকল্পটি অনুমোদনের পরে তেলকূপ খননের সরঞ্জাম এবং স্থানীয় শ্রমিকদের একত্রিত করেন এবং হাতিদের দিয়ে সব খনন সরঞ্জাম ঘটনাস্থলে নিয়ে যান। প্রথম কূপটির খনন ১৮৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয়েছিল, তবে ১৭৮ ফুট খোঁড়ার পরই প্রথম আশাব্যাঞ্জক কিছু দেখতে পাওয়া যায়, এবং আরো খনন করা হয়। এ খনন ১৮৯০ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। মোট ৬৬২ ফুট গভীর খননের পর কূপটি সম্পূর্ণ হয়েছিল।

গৌহাটি
আসামের সবচেয়ে বড় শহর গৌহাটি। এখন গৌহাটির শহরতলির দিসপুর নামক স্থানে আসাম প্রদেশের বর্তমান রাজধানী স্থানান্তরিত হয়েছে। আমরা বাংলায় যে শহরটিকে বলি গৌহাটি, আসামি ভাষায় তার নাম গুয়াহাটি। এর আগের নাম ছিল গুবাক-হাটি। নামটা আসলে ফারসি। ফারসিতে গুবাক বলতে সুপারিকে বোঝায়। আর গুবাক-হাটি বলতে বোঝায় সুপারি ক্রয়-বিক্রির হাট। বাংলার স্বাধীন সুলতানেরা গৌহাটি পর্যন্ত দখল করেছিলেন। সম্ভবত ওই সময়েই এই ফারসি নামটি দেয়া। বাংলার সুলতান শাম্স-উদ-দীন ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকন্দার শাহ্ ১৩৬৭ সালে কামরূপে একটি টাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার পুত্র গিয়াস-উদ-দীন আজম শাহ্ গৌহাটিতে একটি দুর্গ নির্মাণ করিয়েছিলেন। গৌহাটিতে প্রাপ্ত আরবি ভাষায় লিখিত একটি শিলালিপি থেকে এ তথ্য জানা গেছে। শিলালিপিটি কামরূপ অনুসন্ধান সমিতির জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। বাংলার বিখ্যাত সুলতান হোসেন শাহ কামরূপ অধিকার করেছিলেন। কামরূপ বলতে বোঝাত, বর্তমান আসামের পশ্চিম ভাগকে। ব্রিটিশ শাসনামলে কামরূপ বলতে বুঝিয়েছে আসামের একটি জেলাকে। গৌহাটি ছিল কামরূপ জেলার সদরদপ্তর এবং আসামের সর্বপ্রধান শহর।
একসময় কামরূপ বলতে বোঝাত বর্তমান আসমের পশ্চিম ভাগ এবং বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর ভাগের কিছু অংশকে একত্রে। কামরূপের আরেকটি নাম ছিল প্রাগজ্যোতিষপুর। মোগলরা পশ্চিম আসামকে বলত কামরূপ। তারা আসাম বলতে বোঝাত কেবল বর্তমান আসামের পূর্ব ভাগকে। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে তার নিযুক্ত বাংলার সুবাদার (সেনাপতি) মীর জুমলা (১৫৯১-১৬৬৩) আসাম জয় করতে গিয়ে গরগ্রাম পর্যন্ত জয় করেছিলেন। গরগ্রাম তখন ছিল আসামের রাজধানী। কিন্তু বন্যা, বৃষ্টি ও খাদ্যাভাবের ফলে সৈন্যদের অসুস্থতার কারণে মীর জুমলা ঢাকায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। এই যুদ্ধে ব্যবহৃত মীর জুমলার একটা কামান এখনও ঢাকার ওসমানী উদ্যানে রক্ষিত আছে।

এখানে উল্লেখ্য, মীর জুমলাকে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবেদার করে পাঠান সম্রাট আওরঙ্গজেব। মীর জুমলা ১৬৬১ সালে আসাম অভিযানকালে বেশ কয়েকটি ভারী কামান ব্যবহার করেন। বিবি মরিয়ম ছিল এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। মীর জুমলা যুদ্ধে বিজয় লাভ করে ফিরে এসে বিবি মরিয়মকে বড় কাটরার দক্ষিণে সোয়ারি ঘাটের পাশে স্থাপন করেন। তখন থেকে এটি 'মীর জুমলার কামান' নামে পরিচিতি লাভ করে। 'কালে খাঁ জমজম' কামানটি তখনো রাখা ছিল মোগলাই চরে। কিন্তু নদী ভাঙনে একদিন 'কালে খাঁ জমজম' বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে যায়।

বিবি মরিয়মকে সোয়ারী ঘাট থেকে সরিয়ে নেয়া হয় পুরান ঢাকার চকবাজারে। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে এ কাজটি করেন ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ালটারস। তবে চকবাজার ক্রমে ঘিঞ্জি বা ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়। তখন কামানটি সেখান থেকে স্থানান্তর করা হয় সদরঘাটে। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে এ কাজটি করেন ঢাকা যাদুঘরের কিউরেটর নলিনী কান্ত ভট্টশালী। অতঃপর গত শতকের পঞ্চাশের দশকে বিবি মরিয়মকে গুলিস্তানে স্থাপন করা হয়। ওই সময়ও বেশ জমজমাট থাকতো গুলিস্তান। এরপর এই কামানটি ১৯৮৩ সালে স্থাপন করা হয় ঢাকার ওসমানী উদ্যোনে । এখন পর্যন্ত বিবি মরিয়মকে সেখানেই দেখতে পাওয়া যায়।

আসামের ৩৩টি জেলার মধ্যে ৯টি জেলা হলো মুসলিম প্রধান। জেলাগুলো হলো ধুবড়ি, গোয়ালপাড়া, বড়পেটা, মরিগাঁও, নগাঁও, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, দাবাঙ্গ ও বঙ্গাইগাঁও। অনেক মুসলমানকে চেহারার দিক থেকে আসামিদের থেকে আলাদা করে চেনা যায় না। কাছাড় জেলায় অনেক মুসলমানের বাস। তারা সেখানে গিয়েছেন সিলেট থেকে। ধুবড়ি ও গোয়ালপাড়া ব্রিটিশ আমলে রংপুর থেকে কেটে আসামের সাথে যোগ করা হয়েছে। এ দুজেলার লোকের ভাষা বাংলা। বঙ্গভঙ্গের পর আসামের সাথে জুড়ে দেয়া হয় সিলেট জেলাকে। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ জুলাই তারিখে অনুষ্ঠিত গণভোটের মাধ্যমে সিলেট জেলার করিমগঞ্জ বাদে বাকি সিলেট অর্থ্যাৎ সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার যোগ দেয় পাকিস্তানের সাথে।

ইন্টারনেটে অনুসন্ধানে জানা যায় যে ইউরোপীয় ভারততত্ত্ববিদ জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন (১৮৫১-১৯৪১)-এর মতে বাংলা ও আসামি ভাষার উদ্ভব হয়েছে একই মাগধী প্রাকৃত ভাষা থেকে। এদের সম্বন্ধ খুবই কাছাকাছি। আইসিএস গ্রিয়ারসন (১৮৫১-১৯৪১)-এর মতে, ভোজপুরী, মাগধী, মৈথিলী, উড়িয়া, আসামি ও বাংলা এতই কাছের ভাষা যে এদের সবার জন্যইএকটি ব্যাকরণ রচনা করা যেতে পারে। আগে মৈথিলী, বাংলা ও অহমিয়া ভাষা একই অক্ষরে লিখা হতো। কিন্তু এখন বিহারে মৈথিলী ভাষা লিখা হচ্ছে নাগরিতে। তবে বাংলা ও অহমিয়া আগের মতোই এখনও লিখা হচ্ছে একই অক্ষরে যার উদ্ভব হয়েছিল বর্তমান বিহারের ত্রিহুতে(মিথিলা)। বাংলা ও অহমিয়া অক্ষরের মধ্যে পার্থক্য হলো অহমিয়া ‘ব’ অক্ষর হলো অন্তস্থ 'ব’ এবং অহমিয়া ভাষায় “র’ লেখা হয় এই অন্তস্থ 'ব'-এর পেট কেটে। অহমিয়া ভাষায় 'খ’-এর উচ্চারণ হয় কতকটা ফারসি খে’ অক্ষরের মতো। আসামের প্রাচীন বোড়ো ভাষাও এখন বেশ প্রসার লাভ করেছে।

ভারতের ‘সেভেন সিস্টার’ হিসেবে খ্যাত এলাকার বিশেষ করে আসামের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উদ্যোগে ১৯৮০ এর দশকে উলফা (ULFA- United Liberation Front of Assam) নামের একটি সংগঠন সৃষ্টি হয়েছিল। উলফা সংগঠকদের উদ্দেশ্য ছিল আসাম (রাজধানী দিসপুর), নাগাল্যান্ড (রাজধানী কোহিমা), মেঘালয় (রাজধানী শিলং), মিজোরাম (রাজধানী আইজল), মণিপুর (রাজধানী ইম্ফল), অরুনাচল (রাজধানী ইটানগর) ও ত্রিপুরা (রাজধানী আগরতলা) প্রদেশগুলো নিয়ে একটি স্বাধীন ফেডাশেন গঠন করা। বর্তমানে উলফার ওই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে রয়েছে।

লেখক : গবেষক


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us