১০ রমজান : মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের দিবস
১০ রমজান : মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের দিবস - ছবি : সংগৃহীত
উমাইয়া খিলাফতের শাসনামলে মুসলমানরা পুরো বিশ্বের দরবারে সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে অবির্ভূত হয়েছিল। তারা বহু বছর ধরে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে ছিল। তাদের দাপুটে শাসকালে খিলাফতের সীমানা জাজিরাতুল আরব ছাড়িয়ে পৌঁছে যায় ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু নদীর অববাহিকায়।
ওই সময় মুসলমানদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে খলিফা প্রথম ওয়ালিদের আমলে। প্রকৃত অর্থে ওয়ালিদের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কৃতিত্বে উমাইয়ারা সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে ফুলে ফেঁপে উঠে।
বাণিজ্যের সুবাদে ওই সময়ের সিংহল রাজ্যের সাথে বেশ সুস্পর্ক গড়ে উঠেছিল হাজ্জাজ তথা উমাইয়া খিলাফতের। ফলে ব্যবসার সুবাদে অনেক আরব মুসলিমের বসবাস ছিল সিংহলে।
একবার সিংহলের রাজা বেশ কয়েকটি জাহাজে করে উপহার সামগ্রী পাঠিয়েছিলেন খলিফাকে। কিন্তু নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও সেগুলো রাজধানী দামেস্কে পৌঁছায়নি। কারণ পথিমধ্যে জাহাজগুলো জলদস্যুদের কবলে পড়ে। কিছু দিন পর আবারো বেশ কয়েকটি জাহাজে লুটপাট করে জলদস্যুরা। এবার জাহাজগুলোতে ধনসম্পদের সাথে ছিল হজযাত্রীসহ নারী ও শিশুরাও। কথিত আছে, ডাকাত দলের কবলে পড়া এক নারী নিজের রক্ত দিয়ে লেখা একটি চিঠি পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে।
একদিকে বন্দী নারীর করুণ সেই চিঠি, অন্যদিকে তদন্ত করেও ডাকাতির সাথে যোগসাজশ মেলে সিন্ধু রাজ দাহিরের। এমন পরিস্থিতিতে হাজ্জাজ একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন দাহিরের কাছে, ডাকাতিসহ নারী ও শিশুদের উপর নির্যাতনের কৈফিয়ত চাইতে। এতে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়, কারণ হাজ্জাজের বেশির ভাগ প্রতিনিধিকেই হত্যা করেন দাহির।
খলিফা ওয়ালিদ সব শোনার পর সিদ্ধান্ত হয় সিন্ধু আক্রমণের। এর আগেও সিন্ধু জয়ের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো সবই ছিল ব্যর্থ অভিযান। তাই এবার আর ভুল করা যাবে না। এমন কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে যার ওপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করা যায়।
হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মতো চতুর ব্যক্তি রত্ন চিনতে ভুল করেননি। খলিফার অনুমতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওই অভিযানের দায়িত্ব অর্পণ করলেন তারই ভাতিজা মুহাম্মাদ বিন কাসিমের ওপর। যদিও বয়সে তরুণ বলে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিন্ধু অভিযানের সেনাপতি হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল ১৭ বছর বয়সী মুহাম্মাদ বিন কাসিমকেই।
সর্বসাকুল্যে মোট ১২ হাজার সৈন্য নিয়ে সিন্ধুর উদ্দেশে রওনা হন মুহাম্মাদ বিন কাসিম। প্রথম লক্ষ্য দেবল দুর্গ। টানা কয়েক মাসের অবরোধে মুসলিম বাহিনীর হাতে চলে আসে দুর্গটি। সেই সাথে রাজা দাহিরের নিপীড়নে অতিষ্ঠ স্থানীয় বৌদ্ধরাও যোগ দেয় বিন কাসিমের কাফেলায়।
দেবল থেকে পালিয়ে সিন্ধুরাজ আশ্রয় নেন রাওর দুর্গে। মুহাম্মাদ বিন কাসিমের ঘোড়াও ছুটে চলে ওই দিকে। দুর্গের কাছেই টানা কয়েক দিনের সম্মুখ লড়াইয়ে পরাজিত হয় সিন্ধু রাজের সুসজ্জিত বাহিনী, রাজা দাহির যুদ্ধেই নিহত হন। ১০ রমদান ৭১২ সাল, মুহাম্মাদ বিন কাসিম চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেন।
এরপর তিনি কাসিম পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোও খিলাফতের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালিয়ে যান। ৭১২-১৫ সালের মাঝে মুলতান জয় করেন। কিন্তু খুব বেশি দিন তার এই বিজয় অভিযান অব্যাহত থাকেনি। শুরু হয় ঘৃণ্য এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র।
৭১৪ সালে ইন্তেকাল করেন হাজ্জাজ। পরের বছর পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন খলিফা প্রথম ওয়ালিদ; যার আদেশে এই অভিযানে এসেছিলেন মুহাম্মদ বিন কাসিম।
নতুন খলিফার দায়িত্ব নেন সুলাইমান ইবনে আব্দুল মালিক। মসনদে বসেই তিনি অপছন্দের সব লোকেদের দমনপীড়ন শুরু করেন। হাজ্জাজকেও পছন্দ করতেন না সুলাইমান। কিন্তু তিনি তো আর বেঁচে নেই। তাতে কী? হাজ্জাজের ভাতিজা মুহাম্মদ বিন কাসিম তো আছেন। তাকেও ছাড় দেয়া হবে না বলে ঠিক করলেন।
ইয়াজিদ বিন আবি কাবশাকে সিন্ধুর নতুন গভর্নর নিয়োগ করেন খলিফা সুলাইমান। দায়িত্ব বুঝে নিয়েই মুহাম্মাদ বিন কাসিমকে আটক করেন ইয়াজিদ। এরপর তাকে পাঠানো হয় ইরাকের গভর্নরের কাছে। ধারণা করা হয়, বন্দী অবস্থায়ই অসহ্য নির্যাতন সইতে না পেরে ওয়াফাত লাভ করেন মুসলিম ইতিহাসের এই বীর সেনানায়ক।
ভাবা যায়? রাজা দাহিরের শক্তিশালী বাহিনী যাকে পরাজিত করতে পারেনি, সেই পরাক্রমশালী যোদ্ধা কী-না ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন! তবুও নিজেদের লোকের হাতেই!