সু কি ও মিয়ানমারের জাতিসত্তাগত বিদ্বেষ
সু কি - ছবি : সংগৃহীত
মিয়ানমার আবারো উত্তপ্ত।
নোবেল লরিয়েট অংসান সু কি, যিনি সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়ে, জেল-জুলুম খেটে বৈশ্বিক প্রশংসা ও নানা দেশের, সংস্থার পদক পেয়েছেন। তাকে সম্প্রতি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গ্রেফতার করে এবং মিয়ানমারে সামরিক শাসন পুনর্স্থাপিত হয়। এই অং সান সুকি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা এথনিক গোষ্ঠীকে চিরতরে মুছে ফেলার সকল কার্যক্রমের সহযোগী ছিলেন। আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়ার করা মানবতাবিরোধী মামলায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে সশরীরে ডিফেন্ড করেছেন সু কি। সারা বিশ্বের ঘৃণা, প্রতিবাদ, বিবৃতিকে পরোয়া না করে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তথ্য গোপন, মিথ্যা বয়ান দিয়ে সামরিক বাহিনীকে মহিমান্বিত করার কম চেষ্টা তিনি করেননি। স্বৈরশাসনের সহযোগী হয়েও যে শেষ রক্ষা হয় না- সেটার জ্বলন্ত প্রমাণ তথাকথিত গণতন্ত্রের মানসকন্যা অং সান সু কি।
বর্তমানে সারা দুনিয়া মিয়ানমারের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলছে, কিন্তু ওই বক্তব্যে আগের মতো সিমপ্যাথি পাচ্ছেন না সু কি। বরং মিলিটারি পুলিশের খোলা গুলিতে নিহত সাধারণ নাগরিকেরাই হয়ে উঠছে গণতন্ত্রের হিরো।
মিয়ানমার নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে গ্লোবাল মিডিয়ায়। কিন্তু সংকট উত্তরণের কোনো সহিহ তরিকা কি দিতে পারছেন কেউ? সম্ভবত না। গত সাত দশক ধরে ঘুরে ফিরে একই চরিত্রের মিয়ানমারকে দেখছে দুনিয়া। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার উত্তর কোরিয়া হলো আজকের মিয়ানমার। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও কৌশলগত স্বার্থের জন্য অন্যতম বড় থ্রেট এই মিয়ানমার। সামরিকভাবে শক্তিশালী জনবিচ্ছিন্ন সামরিক সরকার পরিচালিত রাষ্ট্রটি কখনোই স্থিতিশীল হতে পারবে না। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড ও বঙ্গোপসাগরের সার্বভৌমত্ব অটুট রাখতে বর্তমান মিয়ানমার অঞ্চলকে যেকোনোভাবে স্থিতিশীল হওয়া প্রয়োজন। ওই স্থিতিশীলতার জন্য এথনিক পরিচয়ের ভিত্তিতে পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসন অথবা আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতাই উত্তম ও একমাত্র উত্তরণ-পথ। মিয়ানমারের জাতিবিদ্বেষ এমন একপর্যায়ে আছে যেখান থেকে অখণ্ডতা বজায় রেখে স্থিতিশীলতা অসম্ভব। মিয়ানমারকে অন্য যেকোনো দেশের সাথে তুলনায় এনে মূল্যায়নের চেষ্টা করলে সেটা কখনোই সঠিক হওয়ার কথা না। এই দেশটির আভ্যন্তরীণ স্বরূপ না জেনে কোনো অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছানোও সম্ভব না। তাই আমার বক্তব্যের স্বপক্ষে মিয়ানমারের স্বরূপ তুলে ধরছি। যা দেখে পাঠক সহজেই অনুমান করতে পারবেন স্থিতিশীল মিয়ানমার দেখতে সুপ্রতিবেশী হিসেবে আমাদের কেমন চিন্তা ও ভূমিকা থাকা প্রয়োজন।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অবস্থা
মিয়ানমারের আদমশুমারি অনুযায়ী জনসংখ্যা প্রায় ৫ কোটি (২০১৪ সালের)। তবে আন্তর্জাতিক মহল মনে করে প্রথম আদমশুমারির (১৯৩৮) ধারাবাহিকতায় জনসংখ্যা হওয়ার কথা প্রায় আট কোটি। মিয়ানমার সরকার বেশ কয়েকটি জনগোষ্ঠীকে ওই দেশের নাগরিক মনে করে না, স্বীকৃতিও দেয় না। ফলে তাদেরকে আদমশুমারির আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। ওইসব ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাখাইন, শ্যান, চিন, কাচিন অন্যতম।
মায়ানমারে সরকারিভাবে প্রায় ১৩৪টি জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। যার মধ্যে বামারদের সংখ্যা প্রায় ৬৫ ভাগ, শ্যান ৯ ভাগ এবং কারেন ৭ ভাগ বলে দাবি করে মিয়ানমারের সেনাপ্রভাবিত সরকার। তবে সেটা সঠিক না হওয়াটাই স্বাভাবিক। তারপরে সংখ্যার বিচারে গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠীর নাম চিন, কাচিন, কায়ন, কায়াহ, মঙ, রাখাইন ও শ্যান। তবে রোহিঙ্গা, বার্মিজ চাইনিজ, বার্মিজ ইন্ডিয়ান, গুর্খাদের মিয়ানমার স্বীকার করে না। যদি নিরপেক্ষভাবে ধর্মের ভিত্তিতে মিয়ানমারে আদমশুমারি করা হতো তবে মুসলিম হতো দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনগোষ্ঠী।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে মিয়ানমারে প্রায় ২৫টি জাতিগোষ্ঠী স্বায়ত্ত্বশাসন ও স্বাধীনতার জন্য সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। যার মধ্যে চীন সীমান্তঘেঁষা শ্যান ও কাচিন এবং থাইল্যান্ড সীমান্তঘেঁষা মঙ, কারেন, কারেননি উল্লেখযোগ্য।
মিয়ানমারে ছোট বড় বিভিন্ন বিদ্রোহী ও স্বাধীনতাকামী গ্রুপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-
১.আরাকান লিবারেশন পার্টি (এএলপি),
২. ডেমোক্রেটিক কারেন বেনিভোলেন্ট পার্টি (ডিকেবিপি),
৩. কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ),
৪.কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি-পিস কাউন্সিল (কেএনএলএ-পিসি)
৫. পাও ন্যাশনাল লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএনএলও),
৬. রেস্টোরেশন কাউন্সিল অব শ্যান স্টেইট (আরসিএসএস),
৭.অল বার্মা স্টুডেন্ট ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (এবিএসডিএফ),
৮.কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট অর্গানাইজেশন (কেআইও),
৯. ইউনাইটেড ওয়া স্টেইট আর্মি (ইউডব্লিউএসএ),
১০. মঙ নিউ স্টেইট আর্মি,
১১. মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক এলায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ),
১২. তাঙ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ),
১৩. আরাকান আর্মি (এএ),
১৪. কারেননি ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ পার্টি,
১৫. শ্যান স্টেইট আর্মি নর্থ (এসএসএএন)
১৬. নিউ মন পার্টি,
১৭. লাহু ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন প্রভৃতি।
মিয়ানমারকে অফিসিয়ালি ডাকা হয় ইউনিয়ন অব মিয়ানমার নামে। সাতটি রিজন এবং সাতটি রাজ্য নিয়ে গঠিত এটি। রাজ্যগুলোর নাম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর নামে। উল্লেখিত সশস্ত্র গ্রুপের নাম আর রাজ্যের নামের মিল দেখে বিদ্রোহী এলাকা সম্পর্কে সাধারণ ধারণা নেয়া সম্ভব।
রাজ্যগুলো হচ্ছে
১. চিন স্টেইট,
২. কাচিন স্টেইট,
৩. কায়িন স্টেইট,
৪. কারেননি স্টেইট,
৫.মঙ স্টেইট,
৬, রাখাইন,
৭. শ্যান স্টেইট।
মিয়ানমারের বেশিরভাগ প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ চোরাইপথে চলে যায় চীনে ও থাইল্যান্ডে। সম্প্রতি ভারতও সেখানে ঢুকতে পেরেছে বলে অনেকে ধারণা করে থাকেন। এতগুলো রাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থও মিয়ানমারকে আরো বেশি অকার্যকর করে রাখছে।
টাটমা ড (TATMADAW)
মিয়ানমারের সেনা, নৌ, বিমান ও পুলিশ বাহিনীকে একসাথে বলা হয় টাটমা ড। টাটমা ড নিজেদেরকে স্বৈরাচারী কায়দায় পরিচালিত করে থাকে। মিয়ানমারের প্রত্যেক রাজনৈতিক দল, প্রতিষ্ঠান, জনগোষ্ঠী সবকিছুই টাটমা ড-এর অনুমোদন সাপেক্ষে পরিচালিত হয়। টাটমা ড-এর সিদ্ধান্তই শেষ কথা।
টাটমা ড-এর পেছনে মোট জিডিপির ৩ থেকে ৫ শতাংশ খরচ করা হয়। যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সম্মিলিত খরচের বেশি। ২০১৭ সালে মোট বাজেটের প্রায় ১৩ শতাংশ তাদের পিছনে খরচ হয় যা দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি। এসব অর্থ তারা সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ক্রয়, নির্মানে ব্যায় করে। তারা বেশিরভাগ অস্ত্র ক্রয় করে মূলত ইসরাইল, চীন, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, জাপান, পাকিস্তান, ভারত ও ব্রিটেনের কাছ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসায়ীরাও চায় এই উদীয়মান আর্মস বায়ারের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে। এছাড়াও টাটমা ড-এর প্রায় ২৫টি সামরিক সরঞ্জাম নির্মাণ কারখানা রয়েছে। টাটমা ড-এর হেডকোয়ার্টার রাজধানী নেপিদো। ওয়েবসাইট http:// www.mod.gov.mm
মিয়ানমারের অ্যাকটিভ সেনা প্রায় ৫ লাখ। রিজার্ভ প্রায় ৩০ লাখ। বাজেট ২.৪ বিলিয়ন ডলার (২০১৪)। পার্লামেন্টে ২৫ শতাংশ আসন তাদের জন্য নির্ধারিত।
মিয়ানমারের উগ্র বৌদ্ধ ও সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের মুখে টিকতে না পেরে দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আসে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান। এই রোহিঙ্গা মুসলমানের কবে কত দিনে স্বদেশে ফিরে যেতে পারবেন সে নিশ্চয়তা নেই।
দেশটিতে প্রায়ই বিদ্রোহী স্বাধীনতাকামীদের সাথে টাটমা ড মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। তবে সেই সব সংঘর্ষে অন্যান্য বিদ্রোহীগ্রুপের একতাবদ্ধ হওয়ার তেমন খবরও পাওয়া যায় না। প্রত্যেকেই নিজস্ব এথনিক গোষ্ঠীর জন্য লড়াই করে। তাদের স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখতে অন্যান্য জাতিসত্তার প্রতি লালিত বিদ্বেষ এটাই প্রমাণ করে অখণ্ড মিয়ানমারের চেয়ে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভিত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্র ও আইন কাঠামো তাদের চাহিদামতো স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিত করবে।