শিক্ষাব্যবস্থা : সুইডেন বনাম বাংলাদেশ
সুইডেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয় - ছবি : সংগৃহীত
সুইডিশ ফ্রিসোর (Frisör) শব্দটির বাংলা অর্থ হলো নাপিত। এখানে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার বাধ্যতাবাধকতা রয়েছে সবার জন্য। নবম শ্রেণির শিক্ষা শেষে সবাই সিদ্ধান্তে আসে কে কী পড়তে চায়। এই পড়তে চাওয়াটা শিক্ষার্থীর ভালো লাগার ওপর নির্ভর করে, যার ফলে এদের জীবনে মনঃপূত বা আশানুরূপ ফলাফল পেতে সমস্যা হয় না। কারণ প্রেসার বা প্রভাব ফেলে কিছু করলে ফলাফল সব সময় মনঃপূত হয় না। সেক্ষেত্রে ব্যক্তির পছন্দের ওপর সবাই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। এমনও দেখা গেছে যে চাহিদার তুলনায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নাপিত হতে অ্যাপ্লাই করেছে। কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের মেধাতালিকায় যারা এ প্লাস পেয়েছে শুধু তারাই নাপিত হতে পারবে- এমনটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ শিক্ষার্থীর পছন্দ ও চাহিদা এর জন্য দায়ী। এখন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে সাধারণত ভালো ফলাফল যাদের তারাই সেখানে অ্যাপ্লাই করে। অনেক সময় দেখা যায় তেমন মনঃপূত শিক্ষার্থী না পাওয়ার কারণে সুইডেন দেশের বাইরের অনেককে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে পড়ার সুযোগ দিয়ে থাকে।
আমার এ বর্ণনায় অনেকে হয়তো মনে মনে ভাবতে শুরু করেছেন, আমি নিশ্চিত জোক করছি। না জোকস নয়, এটা সত্য। সুইডেনে সত্যিকারার্থে দেখা যায়, যে কর্মই করুক না কেন তাতে কোনো সমস্যা নেই। সমাজে কাউকে কর্মের কারণে ছোট করে দেখা হয় না, তবে কুকর্মের কারণে ঘৃণা করা হয়, হোক না সে প্রধানমন্ত্রী বা রাজা, কিছুই তাতে যায় আসে না।
আমাদের সমাজব্যবস্থা বেশ উল্টো। এই উল্টো সমাজ ব্যবস্থাকে সিধা করে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হলে দরকার পরিবর্তনের আর সেই পরিবর্তন নিজ থেকে শুরু করতে হবে।
প্রশিক্ষণে যদি মজা না থাকে বা শিক্ষার্থী যদি তার পছন্দনীয় শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ না পায় তখন সে শিক্ষা কখনো ভালো ফলন দেয় না তার প্রমাণ বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ঘরে ঘরে শিক্ষিত বেকার যুবক। যারা শিক্ষা গ্রহণ করেছে, হয়তো কারো প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নয়তো কিছু একটা করতে হবে ওই কারণে। যারা নিজের ভালো লাগা থেকে শিক্ষার বিষয় বেছে নিয়েছে, তারা মনপ্রাণ দিয়ে সেই শিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছে এবং শিক্ষা গ্রহণ শেষে তারাই বেকারত্ব কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। একজন ভালো নাপিত হতে হলে তাকে মন দিয়ে সেই কাজটির উপর প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এখন যদি পাছে লোকে কিছু বলে বা পরিবারের মান মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় নাপিত হলে, কী প্রত্যাশা পেতে পারে সে, তার পরিবার, তার সমাজ সবশেষে তার দেশ থেকে?
দুর্নীতি, ঘুষ এসবে মানমর্যাদা যায় না। তবে মানমর্যাদা যায় রিক্সা চালালে, কৃষক হলে, নাপিত বা ধোপা হলে। এর নাম বাংলাদেশ।
এত কিছুর পরও একজন সচেতন নাগরিকের মতে আমাদের বর্তমান যে অবস্থা, তাতে কি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ওপর জোর দেয়া ঠিক হবে? বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক লোক বেকার। তাদের বড় অংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী। কিন্তু কাজের লোক নেই।
বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত ও ধনী লোকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় গৃহকর্মী (রান্নাও জানবে) ও নার্সের (পুরুষ ও নারী, বিশেষ করে বৃদ্ধদের পরিচর্যা করতে সক্ষম) চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। কিন্তু এই কাজের লোক পাওয়া যাচ্ছে না। জাপানসহ বিভিন্ন ধনী দেশে এসব পেশার চাহিদা ব্যাপকভাবে থাকার কথা।
অনেকেই বলবে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার তৈরি করা নয়, মেরামতের লোক দরকার। আমরা এখন কোনোভাবেই মাইক্রোসফট, গুগল, ফেসবুকের সাথে পারবো না। তাদের ওইদিকে মেধা, সময়, অর্থ ব্যয় করা কোনোভাবেই ঠিক হবে না। আমাদের উচিত, চলতি প্রজন্মকে টেকনিশিয়ান, নার্স, গৃহকর্মী ইত্যাদি পেশায় দক্ষ হয়ে কাজ করে গরিব থেকে নিম্ন মধ্যবিত্তে যাওয়ার রাস্তা দেখানো। তারাই তাদের সন্তানদের আরো ভালোভাবে শিক্ষিত করতে পারবে ইত্যাদি।”
আমি ভদ্রলোকের সব বিষয়ের উপর একমত পোষণ করতে পারিনি। কারণ অন্যেরা পারলে আমরাও পারব, পারতে আমাদের হবেই।
তবে যে জিনিসটা আমাকে বেশি চিন্তিত করছে সেটা হলো দেশের মানুষের নৈতিকতার অবক্ষয়! সে আবার কী? আমারে চেনোস? আমি কে জানস?
এ ধরণের প্রশ্ন বাংলাদেশের সমাজের সব জায়গায় লতাপাতার মতো জড়িয়ে আছে। দেশের তরুণ সমাজ পুঁথিগত বিদ্যার সাথে সামাজিক যে আচরণ সেটাও শেখে।
একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা শুধু সার্টিফিকেটধারী কিছু গ্রাজুয়েট তৈরি করে। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি করে না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সমাজে সঠিক সামাজিক আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা এবং সেইভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। এখন রাষ্ট্র্রের কুকর্মের দায়ভারও শিক্ষাব্যবস্থার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
কেউ এখনো বলছে না আমাদের নৈতিকতার বিসর্জনের কারণেই সকল সেক্টরে অভিশাপের ধোয়া লেগেছে। এই অন্ধকার ধোয়া গ্রাস করে চলছে জাতির মনুষ্যত্বকে।
এখন কিভাবে নিজ থেকে পরিবর্তন আসবে যদি শিক্ষিত সমাজ অশিক্ষিত মুর্খের মতো আচরণ করতে শুরু করে? এতদিন শুনেছি মন্ত্রী বা আমলাদের ছেলে/মেয়েরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে বা নিয়ম অমান্য করে। এখন শুনছি নতুন কাহিনী। সেটা হচ্ছে ন্যায়-অন্যায় যাই করি না কেন কিছুই বলা যাবে না কারণ বাবা, চাচা, মামা বা চৌদ্দগোষ্ঠীর মধ্যে হয়তো বা কেউ ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল, সেক্ষেত্রে সাত খুন মাফ করতে হবে। পুলিশ তার কাজ করতে পারছে না কারণ অন্যায়কারীর বাবা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। গত কয়েক দিন আগে তেমন একটি ঘটনা চোখে পড়লো যেখানে পুলিশ, ডাক্তার ও ম্যাজিস্ট্রেটের মধ্যে দ্বন্দ্ব, যা দেখার পর বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজের ওপর কিছুটা বীতশ্রদ্ধা এসেছে। এটা যদি দেশের শিক্ষিত সমাজের সভ্যতা হয়, তবে বাকিদের কী অবস্থা? কী হবে পুঁথিগত শিক্ষা দিয়ে যদি নৈতিকতা ও নির্মমতার অধঃপতন এভাবে ঘটতে থাকে?
আমি সত্যিই ভাবছি আমাদের কী ধরনের শিক্ষার প্রয়োজন, কী ধরনের শিল্প আমরা গড়ে তুলছি, কোন ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমাদের প্রয়োজন ইত্যাদি।
বর্তমানে দেশের শিক্ষাঙ্গনে যা শিখানো হচ্ছে, তা একটি নতুন দেশের সমস্যার বহির্ভূত শিক্ষা। দেশের জনশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে কী দরকার? ডাক্তার, বিচারক, অধ্যাপক, শিক্ষক, কারিগর, প্রকৌশলী প্রভৃতি গড়ে তোলার দিকে নজর দেয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কার কোন বিষয়ে ঝোঁক রয়েছে, তা যাচাই করার চেষ্টা করা হচ্ছে কি? দেশে আজ সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আরো বেশি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার কথাও ভাবা হচ্ছে। কারণ কেবলমাত্র সাধারণ শিক্ষার ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের মাধ্যমে ডিগ্রি লাভ করে কখনোই সমাজের এবং দেশের মঙ্গল করা যায় না তাও সবাই বলছে। আমরা সামন্তবাদী অবস্থা ও পরিবেশ থেকে এখনো গণতান্ত্রিক অবস্থায় পৌঁছাতে পারিনি। সামন্তপ্রথা যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সামন্ত মনোবৃত্তিও। এই মানসিকতার আগে পরিবর্তন করতে হবে। নতুন মানসিকতা ছাড়া দেশের উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। নিজ নিজ জায়গা থেকে নিজেদের কর্তব্য পালন করতে পারলে জাতীয় কর্তব্য পালন করা হবে।
গত ৫০ বছরে জনসংখ্যা হয়েছে আড়াই গুণ বা তার বেশি। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ দেশের পরিকাঠামোর কি সেইভাবে উন্নতি হয়েছে? অনেকের অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে তবে অবনতি হয়েছে মনুষ্যত্বের সব জায়গায়ই। সারাদেশে ‘নেই’-এর তালিকা দীর্ঘ। অসহায় বোধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে নজর দিলে অনেক কিছুতেই হতাশার বন্যা বয়ে যাবে। তারপরও খুব সহজেই, শুধু আন্তরিকতা থাকলেই পুরো দেশের সকল সমস্যার সমাধান করা সম্ভব যদি মনুষ্যত্বকে ফিরে পাই।
আমি প্রতিদিন বাংলাদেশের অগণিত মানুষের অসহায় মুখ দেখি। আমি তাদের হাসিমুখ দেখতে চাই। সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে অনুরোধ, আর দেরি নয়, বিশেষজ্ঞ প্যানেল করুন। যারা বোঝেন ও জানেন, তাদের মতামত এবং কাজ করার বিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত দেয়ার সুযোগ দিন। সময় কারো জন্য বসে থাকে না। আমাদের চরিত্রের পরিবর্তনের সময় এখনই। এ এক নতুন সময়, একে কাজে লাগান।
লেখক : সুইডেনপ্রবাসী, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার rahman.mridha@gmail.com