ইকবালের দর্শন : ইমরান খানের দৃষ্টিতে
ইকবালের দর্শন : ইমরান খানের দৃষ্টিতে - ছবি : সংগৃহীত
ইমরান খানকে পাশ্চাত্য মিডিয়া সব সময় প্লেবয় বলে উপস্থাপন করেছে। ওই ইমরান খানই কিভাবে নয়া পাকিস্তানের পথ প্রদর্শক হয়ে ওঠলেন ওই ব্যাপারে সত্যিকার অর্থেই সবার মধ্যে বেশ কৌতূহল আছে। আমারও বেশ কৌতূহল ছিল এ নিয়ে। টুকটাক কিছু পড়াশোনাও শুরু করলাম এ বিষয়ে। তাকে নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে দেখলাম, মায়ের দিক-নির্দেশনা ও ইকবালের সাহিত্যকর্মই আজকের এই ইমরান খানকে তৈরী করেছে। এর বদৌলতেই ইমরান খান সঠিকভাবে ইসলামী জীবনযাপনে ধীরে ধীরে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেন।
কিন্তু মা মারা যাবার আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে তেমন যত্নবান ছিলেন না। ১৯৮৫ সালে যখন তার মা মারা যান তখন তিনি নিজেকে প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলেন বিষণ্ণতার আঁধারে। তারপর ধীরে ধীরে ইসলামের আলো তার জীবনকে উজ্জ্বল করে তোলে। তিনি ইসলামের বিষয়ে তুলনামূলক নানা ধরনের জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। তবে আল্লামা ইকবালের দর্শনেই সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হন। আর এভাবে ইমরান খান ইকবালের দর্শন ও চিন্তাধারা লালন করতে করতে আস্তে আস্তে আজকে নিজেকে নয়া পাকিস্তানের পাঞ্জেরি করে গড়ে তোলেন।
ইমরান খান আল্লামা ইকবালের দর্শনে এমনভাবে প্রভাবিত হয়েছেন যে তিনি শুধু নিজের নয়, সমগ্র পাকিস্তানি যুবসমাজ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের সমগ্র মুসলিম যুবসমাজকে নিজের জীবন ও কর্মপদ্ধতি আল্লামা ইকবালের সাহিত্যে উপস্থাপিত ইসলামের যে সঠিক মূল্যবোধ তার আলোকে গড়ে তোলার আহ্বান জানান। সততা, মানবিকতা, একনিষ্ঠতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান। আল্লামা ইকবালের দর্শনই অতীতের ওই প্লেবয় ইমরান খানকে আজকের পাকিস্তানের সবচেয়ে সফল ও যোগ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিণত করেছে।
২০১২ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফের পিটিআইয়ের ইয়থ পলিসির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আল্লামা ইকবালের নাতি ওয়ালিদ ইকবাল বলেন, 'আমি আল্লামা ইকবালের নাতি হলেও দেশের রাজনৈতিক দিগন্তে আমার প্রকৃত প্রতীকী উত্তরসূরি হলেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খান।'
আল্লামা ইকবালের নাতি ওয়ালিদ ইকবাল ইমরান খানের পিটিআইয়ে যোগ দেয়ার পর তাকে যখন বলা হয় আল্লামা ইকবালের কবিতার বার্তা প্রসারে আপানার কাজ করা উচিৎ কি না? তিনি ওই প্রশ্নের উত্তরে বলেন, 'ইকবালের বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেয়ার কাজের এখন আর দরকার নেই। কারণ কাজটি পিটিআইয়ের চেয়ারম্যান নিজেই করেছেন।'
'পাকিস্তান : অ্যা পারসোন্যাল হিস্টোরি'- এর বাংলায় অনূদিত বই 'পাকিস্তান : আমার ইতিহাস' বইয়ের প্রকাশক বলেন, 'অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সুদর্শন ইমরান খানকে রমণীপ্রিয় প্লেবয় হিসেবে উপস্থাপন করতে বেশি স্বচ্ছন্দ্যবোধ করতেন পশ্চিমের সাংবাদিক-বিশ্লেষকরা। তিনি ক্রিকেট খেলার অন্ধি-সন্ধি যেমন জানতেন, তেমনি চিনতেন লন্ডনের নাইট ক্লাবগুলো। মিডিয়ায় দেখানো ইমরান ভেতরে ভেতরে যে অন্য কিছুর পরিকল্পনা আঁটছিলেন সংগোপনে-তা টের পায়নি অনেকেই।'
সত্যি বলতে কী, প্রাথমিক পর্যায়ের ইমরান আর আস্তে আস্তে ইসলামের সঠিক মূল্যবোধের আলোকে নিজেকে ঢেলে সাজানো ইমরানের মধ্যে রয়েছে আকাশ পাতাল পার্থক্য।
তবে এই ইমরান রাজনৈতিক চিন্তা ধারার দিক থেকে মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহকেও অনেক পছন্দ করতেন। আর বছরের পর বছর ধরে তার জীবনধারা, কর্মপদ্ধতি ক্রমাগত প্রভাবিত হয়ে এসেছে ইকবালের চিন্তা, আদর্শ ও দর্শনে। তিনি সমাজসেবাকে নিজের জীবনের ব্রত করে জীবনে ও সমাজে সততা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেমে পড়েন।
সমাজসেবার অংশ হিসেবে মা মারা যাবার পর তার মা শওকত খানমের নামে 'শওকত খানম মেমোরিয়াল ক্যান্সার হাসপাতাল ও গবেষণা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে এই হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে কেন তিনি আগ্রহী হয়েছিলেন এই বিষয়ে একটা গল্প আছে।
মাকে নিয়ে যখন তিনি ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ছিলেন তখন দেখেন, এক বৃদ্ধ লোক তার হাতের ওষুধের প্রেসক্রিপশন ও কেনা ওষুধ একজন ডাক্তারকে দেখিয়ে বলেন, সব ওষুধ কেনা হয়েছে কিনা। ডাক্তার তার কেনা ওষুধগুলো ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রের সাথে মিলিয়ে বলেন, সব কেনা হয়নি। সবচেয়ে দামী ও প্রধান ওষুধটি বাদ আছে। লোকটার কাঁদতে থাকেন। দিনমজুর লোকটি তার নিজের কষ্টের সব টাকা দিয়েও ক্যান্সারে আক্রান্ত ছোট ভাইয়ের জন্য সব ওষুধ কিনতে পারেননি। এটা দেখে ইমরান খান লোকটার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন।
ওই লোক ওখান থেকে চলে গেলে দূর থেকে ইমরান খান এটা খেয়াল করে ডাক্তারকে ওই লোকের কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। কারণ শুনে ইমরান খানের বুক ব্যথায় চিনচিন করে উঠে। এই ঘটনা তাকে ক্রমাগত ভাবায়। তিনি ভাবতে থাকেন, আমাদের মতো উচ্চবিত্ত লোকেরা যেখানে ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠছি সেখানে অসহায় গরিব মানুষের কী অবস্থা!
ইমরান খানের মা ১৯৮৫ সালে ক্যান্সারে মারা যাবার পর এই ঘটনায় ইমরান খানকে ক্যান্সার হাসপাতাল করতে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন বিশ্বমানের এমন একটা ক্যান্সার হাসপাতাল পাকিস্তানে করবেন যেখানে গরিব রোগীদের বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে ক্যান্সারের চিকিৎসা দেয়া হবে। কিন্তু তার গরিবদের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে ক্যান্সার হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত সবাই নাকচ করে দেয়। কিন্তু মানবসেবায় যার জীবনের মূল লক্ষ্য তাকে দমাতে পারেনি কেউ। ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর আস্তে আস্তে তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এই হাসপাতালের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৯১ সালে, ১৯৯৪ সালে তা দরিদ্র মানুষের সেবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ইমরান খানের সততা, মানবিকতা ও নৈতিকতাবোধের প্রতি পাকিস্তানের জনগণের আস্থা বাড়তে থাকে। তিনি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন দলে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পান। কিন্তু দুর্নীতি ও লুটপাট করা রাজনৈতিক দলে তিনি যোগ না করে ইমরান খান ১৯৯৬ সালে তেহরিক-ই-ইনসাফ (ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন) গড়ে তোলেন।
ইমরান খানের চোখে আল্লামা ইকবাল হিরো। তিনি তার জীবনে ইকবালের যে ধারায় পাকিস্তানি জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস পেতেন তিনি ওই ধারার উপর আস্থা স্থাপন করে পাকিস্তানি জনগণকে ইসলামী আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া উন্নত জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেন।
ইমরান খান তার 'পাকিস্তান : অ্যা পারসোন্যাল হিস্টোরি' নামক গ্রন্থে মুসলিম জাতির অনগ্রসরতার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে আল্লামা ইকবালের দর্শন ও সাহিত্য সম্পর্কে বলেন : 'ইকবালের মতে, ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাধারার অবক্ষয় ও পতন শুরু হয় এখন থেকে পাঁচ শ' বছর আগে; যখন ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন থেকেই। আমাদের ধর্ম ও ঐতিহ্যবিষয়ক পাণ্ডিত্যপূর্ণ যুক্তি-তর্কের নাম ইজতিহাদ। কুরআনের নীতিমালা মুসলমানদের জন্য চিরস্থায়ী কর্মনীতি। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন অগ্রগতির আলোকে এসব নীতিমালার ক্রমাগত ও যুগোপযোগী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ একান্ত প্রয়োজন।'
তিনি আরো বলেন, 'দি রিকনস্ট্রাকশন অব রিলিজিয়াস থট ইন ইসলাম' বক্তৃতায় মুসলিম জাতির বর্তমান স্থবরিতার তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন-
১) প্রথম কারণ, দশম শতাব্দী নাগাদ কুরআনের অবিনশ্বরতার মতো বিষয় নিয়ে যুক্তিবাদী ও রক্ষণশীলদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয় এবং আব্বাসীয় রাজবংশ রক্ষণশীলদের সমর্থন দান করেন। তাদের ভয় ছিল অনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ বিধিবদ্ধ সমাজ হিসেবে ইসলামের স্থিতিশীলতা বিপন্ন করে তুলতে পারে।
২) দ্বিতীয় কারণ, বৈরাগ্যবাদী সুফিবাদের উত্থান। ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রমবর্ধমান রক্ষণশীলতা সুফিবাদ প্রসারের অংশত দায়ী। কুরআনের আমলের (কর্মের) ওপর জোর দেয়ার প্রতি ইকবাল আঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন দুনিয়ার বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যাওয়া ইসলামের সত্যিকারের মূল্যবোধের বিপরীত, যে কাজ কিছু সুফি করেছেন। তিনি অনুভব করেন, বৈরাগী বা সন্ন্যাসী হওয়ার মানে হচ্ছে বাস্তব জীবনের আনন্দ ও সংগ্রাম এড়ানোর চেষ্টা। ইসলাম শিক্ষা প্রদানের দায়িত্বে নিয়োজিত লোকদের উদ্দেশ্যে বলতেন-
'দুনিয়ায় দ্বীন শেখাতে যদি চাও, হে আলিম
উম্মাহকে দিও না কভু সংসার ছাড়ার তালিম।'
৩) তৃতীয় ও সম্ভবত চূড়ান্ত কারণ, ১২৫৮ সালে মঙ্গোল আক্রমণে মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজধানী বাগদাদ নগরী ধ্বংস হওয়া। একসময় বাগদাদ ছিল ইসলামী বিশ্বের সম্পদ, বাণিজ্য ও শিক্ষা কেন্দ্র। এখানকার বিখ্যাত লাইব্রেরিগুলো ধ্বংসের সাথে সাথে কয়েক শ' বছর ধরে অর্জিত জ্ঞানরাজি হারিয়ে যায়। এই বিশাল সাংস্কৃতিক আঘাত মুসলমানদের অনিবার্যভাবে আরো রক্ষণশীলতার দিকে ধাবিত করে। কারণ তারা তাদের সভ্যতা বিলীন হবার ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে। যদিও চতুর্দশ শতাকের প্রথমভাগে মঙ্গোলরা ইসলাম গ্রহণ করে, কিন্তু তাদের স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় ওলামাদের (মুসলিম আইন বিশেষজ্ঞ) স্বাধীন বিচার বিভাগ পরিচালনার পথ বন্ধ হয়ে যায়। ইজতিহাদের দরজা বন্ধ ঘোষণা করা হয়, মতবিরোধ নিরুৎসাহিত করা হয় এবং পরদেশীদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়।
তবে পাকিস্তানি তথা মুসলিম জাতির ঘুরে দাঁড়ানোর পথ যে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে তা মনে করেন না ইমরান খান। তিনি বলেন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, জ্ঞান অন্বেষণ, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, সততা ও মানবিকতা নির্ভর ইসলামী জীবনযাপনের মাধ্যমে মুসলিমরা এখনো তাদের হারনো ঐতিহ্য ফিরে পেতে পারে। এ জন্য কঠোর অধ্যবসায় দরকার। ইমরান তার 'পাকিস্তান : অ্যা পারসোন্যাল হিস্টোরি' বইয়ে লিখেন ইকবাল একবার লিখেন-
'জ্ঞান অনুসন্ধানের সব চেষ্টাই মূলত ইবাদতের একটা ধরণ।'
ইকাবালের মতে- 'আইনের বাহ্যিক দিকগুলো মেনে চলার ব্যাপারে অতিরিক্ত জোর দেয়ার ফলে অন্ধভাবে ইসলাম অনুসরণের চর্চা (তাকলিদ) গড়ে উঠে, যার অবস্থান প্রকৃত ইসলামে বর্ণিত স্বাধীনতা থেকে অনেক দূরে।'
ইমরান খান আবার বলেন-
‘ইকবালের চিন্তাধারার চিরায়ত মূল্য বুঝতে হলে আমাদের প্রয়োজন সতেজ অকৃত্রিম মানসিকতা, যাদের রয়েছে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে এখানকার আদি সুশাসন ব্যবস্থার সমন্বয় সাধনের ক্ষমতা। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে অবশ্যই অনেক কিছু সেখার আছে; সবার আগে এর শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো, জ্ঞান অন্বেষণের অব্যাহত প্রচেষ্টা এবং বাকস্বাধীনতা রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা আমাদের গ্রহণ করতে হবে। এগুলোর ফলেই সেখানে সৃজনশীলতা ও গতিময়তা জন্ম নিয়েছে। পাশ্চাত্য বিশ্বের বেশির ভাগ স্থানে গণতন্ত্র মানুষের জন্য মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছে। এখান থেকেও আমরা শিক্ষা নিতে পারি।
কিন্তু আমরা পাশ্চাত্যের ভালোটা গ্রহণ না করে বরং তাদের মধ্যে যা আছে বিশেষ করে অবাধ মেলামেশা, বস্তুবাদী চিন্তাধারা, পুঁজিবাদ- এগুলোকে পশ্চিমাদের উন্নয়ন ও অগ্রতির চালিকাশক্তি মনে করে আমাদের মুসলিম সমাজে আমদানি করছি যা চরম মাত্রায় মুসলিম সমাজের অধঃপতনের কারণ।'
ইমরান খান আরো উল্লেখ করেন-
'ইকবাল মুসলমানদের প্রতি উন্মুক্ত মন নিয়ে কুরআনের বাণী ও ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা পুনর্বিবেচনার আহবান জানান, যাতে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা সম্ভব হয়। তিনি কল্পকাহিনী বলা মোল্লাদের কঠোর সমালোচনা করেন। সমসাময়িক বিষয়ে মুসলমানদের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার যোগ্যতা তাদের নেই। বিজ্ঞান, কলা ও মৌলিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে তাদের কুসংস্কার ও অসহিষ্ণুতা তার জন্য চরম উদ্বেগের বিষয়।'
ওলামা ও ধর্মীয় পণ্ডিতদের আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের উপকরণে সজ্জিত করতে আল্লামা ইকবাল একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। হয়তো এরই ধারাবাহিকতায় ইমরান খান পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকা খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশে ২০১৩ সালে প্রাদেশিক সরকার গঠন করার পর বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলেন। দেশের যুব সমাজকে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিধা দিতে চেয়েছেন তিনি।
২০১৩ সালের ১১ মে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে পিটিআই বেশ ভালো ফলাফল করে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসাবে আবির্ভূত হয়। এসময় পিটিআই উগ্রবাদী সমস্যা কবলিত খাইবার-পাখতুনখোয়ায় ব্যাপক বিজয় অর্জন করে,জামায়াতে ইসলামি ও জমিয়ত উলেমার (এফ) সাথে জোটবদ্ধভাবে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে। এখানে সরকার গঠন করেই পিটিআই অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করতে থাকে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত উগ্রবাদী এলাকাকে মাত্র তিন বছরে এক ধরণের শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত করে ফেলেন। তার প্রাদেশিক সরকার সেখানে বিশ্বমানের ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হচ্ছে-
Abbotabad University of Science and technology, Abbotabad, Women university, Sawbi, Shahada-e-Army Public School University of Technology, Nowshere
Women University, Mardan, University Of Bunner, University of Chitral
University of Agriculture D.I.Khan, University of Engineering and technology, Mardan; University of Science and Technology, Lakki Marwat
ইমরান খান তার 'পাকিস্তান : অ্যা পারসোন্যাল হিস্টোরি' বইয়ে বলেন, "ইকবাল বিশ্বাস করতেন যে আধুনিক আবিষ্কারকে ‘অনৈসলামি’ গণ্য করে সেগুলো পরিত্যাগ করার পরিবর্তে মুসলিম বিশ্বের উচিৎ নিজেকে পশ্চিমা মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির আজ্ঞানুবর্তী না করে তাদের প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনগুলো ব্যবহার করা।"
এক কবিতায় তিনি ভারতীয় মুসলমানদের পাশ্চাত্যের অনুকরণ না করে সৃজনশীল হওয়ার আহ্বান জানান-
‘পুলকিত তুমি হয়ো না যেন ফিরিঙ্গিকারীর কাচ দেখে
সৃজন করো পেয়ালা ও কটোরা স্বদেশের মৃত্তিকা ছেঁকে।’
- ইকবাল
ইমরান খান তার 'পাকিস্তান : অ্যা পারসোন্যাল হিস্টোরি' বইয়ে আরো বলেন, 'দুর্ভাগ্যবশত মুসলিম ধর্মীয় গোঁড়াদের সবচেয়ে খারাপ দিকগুলোর একটি হলো- তারা সংখ্যা লঘু বা অন্যান্য ইসলামী দল-উপদলের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছাড়ানো নিয়ে নিজেদের কর্মকাণ্ডের ন্যায্যতা প্রমাণের স্বার্থে অপ্রাসঙ্গিকভাবে কুরআনের আয়াতের উদ্ধৃতি প্রদান করে। অথচ একথা ভুলে যায় বা উপেক্ষা করে যে নবী সা.-এর জীবনে অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শনের বহু নজির রয়েছে।'
নির্বিশেষে বলা যায় যে ইমরান খান মূলত আজকের পাকিস্তান গড়ে তুলছেন ইকবালের দর্শন ও চিন্তাধারাকে ভিত্তি করে। তার দৃষ্টিতে এটা হচ্ছে নয়া পাকিস্তান। যে পাকিস্তান দুর্নীতি ও অনগ্রসরতায় খুবই পিছিয়ে পড়েছিল ওই পাকিস্তানকে আস্তে আস্তে ইমরান খান ইকবালের দর্শনের আলোকে নয়া পাকিস্তানে রূপ দিচ্ছেন।
Source
1) Pakistan: A Personal History by Imran Khan
2) www.tribune.com.pk
3) https://www.facebook.com/ImranKhanOfficial
লেখক : সাহিত্যিক; অনুবাদক; সম্পাদক, মহীয়সী (www.mohioshi.com)