ডায়াবেটিস এবং রোজা
ডায়াবেটিস এবং রোজা - ছবি : সংগৃহীত
রোজাদার ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ইফতারিতে গ্লুকোজ বা চিনি ও গুড়ের শরবতের পরিবর্তে ডাবের পানি, লেবুর শরবত খাওয়া উচিত। এছাড়া শশা, জাম্বুরা, আমড়া, পেয়ারা ও কামরাঙ্গা ইত্যাদি টক ফল পরিমাণমতো খেতে পারেন অধ্যাপক ডা: মো. ফয়জুল ইসলাম চৌধুরী
একজন রোগী যখন ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞের কাছে রোজায় তার চিকিৎসার জন্য যান। তখন তার মধ্যে অনেক প্রশ্ন থাকে আমি তো ডায়াবেটিস রোগী। আমি কি রোজা রাখতে পারব? রোজা রেখে আমি কি ইনসুলিন নিতে পারব? রোজা রেখে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে পারব? এ রকম অনেক প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর একজন ডায়াবেটিস হিসেবে এক কথায় দেয়া ঠিক হবে না।
কারণ একজন ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার আগে বিভিন্ন দিক চিন্তা-ভাবনা করতে হয়। যেমন- কোন ধরনের ডায়াবেটিস- টাইপ-১, টাইপ-২? উচ্চতা অনুযায়ী রোগীর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম না বেশি? রোগী বর্তমানে ডায়াবেটিস কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন? শুধু খাদ্য বা ব্যায়ামের সাহায্যে না খাদ্য ব্যায়াম ও ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে? তার ডায়াবেটিস কি অনিয়ন্ত্রিত? কখনো অজ্ঞান বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছে কি? তাছাড়া ডায়াবেটিসের সঙ্গে কি কোন জটিল রোগ আছে? (অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ, প্যারালাইসিস ইত্যাদি)। মহিলা হলে গর্ভবতী কিনা। অন্য ধরনের ইনফেকশান ভুগছেন কি-না? রোগী খুব অল্প বয়সী? না খুব বেশি বয়সী? এসব বিভিন্ন দিক বিচার বিবেচনা করেই বলা যাবে তার রোজা রাখা যাবে কি যাবে কি-না? তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সুব্যবস্থা প্রণয়ন করে রোজা রাখা সম্ভব হয়।
ওজন বেশি এমন ডায়াবেটিস রোগীর রোজা একটি সুবর্ণ সুযোগ বলা যেতে পারে। কারণ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে শরীরের ওজন কমানো সম্ভব হয়। কিন্তু যাদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস অর্থাৎ যাদের বেঁচে থাকার জন্য ইনসুলিন অত্যাবশ্যক এবং যারা কিশোর ডায়াবেটিস, যাদের শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা ঘনঘন ওঠানামা করে তাদের রোজা রাখা ঠিক নয়। ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হলে সব সময় একজন গর্ভবতী মায়েরও রোজা রাখা ঠিক নয়।
অন্য দিকে একজন টাইট-২ ডায়াবেটিস রোগী বাইরে থেকে যারা ইনসুলিন দেওয়া ছাড়া বেঁচে থাকতে পারেন এমন বা ইনসুলিনের প্রয়োজনও হতে পারে এমন গ্রুপের ডায়াবেটিস রোগী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মতো সুন্দরভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণসহ রোজা রাখতে পারেন। রোজা থেকে দিনের বেলায় অধিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম না করা উচিত। এতে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। ইফতার বা খাবার দেড়-দুই ঘণ্টা পর হাল্কা ব্যায়াম করা যেতে পারে। রোজাতে ওষুধের পরিমাণও কিছু কম লাগতে পারে। যে ওষুধ রোগী দিনে একবার সকালে খেত তা রোজায় সন্ধ্যায় ইফতারির সঙ্গে খেয়ে নিতে পারেন। তবে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে ওষুধের মাত্রা ঠিক করা উচিত। রোজা রেখে প্রয়োজনে রক্তে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা যেতে পারে, এতে রোজা নষ্ট হয় না।
একজন ডায়াবেটিস রোজাদারকে ওষুধ সেবন ও খাওয়ার পরিমাণের দিকে বিশেষ সতর্ক থাকতে হয়। সবচেয়ে সতর্ক থাকতে হয় যিনি ওষুধ সেবন বা ইনসুলিন নিয়ে চিকিৎসা নেন এবং তার কোনো ধরনের অসুস্থতার লক্ষণ বা হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয় কি-না? এ অবস্থা হলে রোগীর বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে, যেমন- শরীর কাঁপা, শরীর ঝিমঝিম করা, অস্থির লাগা, মাথা ধরা, মাথা ব্যাথা হওয়া, বুক ধড়পড় করা, গা ঘেমে যাওয়া, কোনো কিছু মনে না পড়া ইত্যাদি। এসব হলে বুঝতে হবে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে গ্লুকোজের পানি বা হাতের কাছে থাকা খাবার যা পাওয়া যায় তা খেয়ে নেয়া এবং কাছের হাসপাতালে যাওয়া বা সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া ভালো।
রোজাদার ডায়াবেটিস রোগীর জন্য ইফতারিতে গ্লুকোজ বা চিনি ও গুড়ের শরবতের পরিবর্তে ডাবের পানি, লেবুর শরবত খাওয়া উচিত। এছাড়া শশা, জাম্বুরা, আমড়া, পেয়ারা ও কামরাঙ্গা ইত্যাদি টক ফল পরিমাণমতো খেতে পারেন। একজন রোজাদার ডায়াবেটিস রোগীর মোট খাদ্য ক্যালরি ১৩০০ থেকে ১৮০০ এর মধ্যে থাকলে ভালো হয়। এ খাদ্য ক্যালরি তিন ভাগে বিভক্ত। যথা- ইফতারি, সন্ধ্যারাত এবং সেহরির সময় সঠিক বণ্টন করে খেতে পারলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক হয়।
ইফতারির জন্য ভুনাবুট, পেঁয়াজু, মুড়ি, বেগুনি, ফল ইত্যাদি পরিমাণমতো খাওয়া যায়। উল্লিখিত টক ফল, ডাবের পানি, চিনি ছাড়া লেবুর শরবত ইচ্ছামতো খেতে পারেন। সন্ধ্যারাতে ও সেহরির খাবার পরিমাণ মতো হতে হবে, তাতে মাছ, মাংস, ডাল, ভাজি, শাকসব্জি, আটার রুটি বা ভাত সবই পরিমাণ মতো থাকতে পারে। কিন্তু চাই সঠিক পরিমাণ ও নিয়ন্ত্রিত খাবার, তবেই আপনি আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সফলতা আনতে পারেন। এ নিয়ন্ত্রণ আপাতদৃষ্টিতে কষ্টকর হলেও এর পেছনে আছে সুখ ও শান্তি।
লেখক : অধ্যাপক ও ইউনিট প্রধান (অব:)
মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।
চেম্বার : মেডিনোভা মেডিক্যাল সার্ভিস, রোড নং: ৫/এ, ধানমন্ডি, ঢাকা।