'আলাক' এবং ‘জমাট বাঁধা রক্ত’

অধ্যাপক কর্নেল ডা: জেহাদ খান অব: | Apr 20, 2021 03:17 pm
'আলাক' এবং ‘জমাট বাঁধা রক্ত’

'আলাক' এবং ‘জমাট বাঁধা রক্ত’ - ছবি : সংগৃহীত

 

কুরআনে অবতীর্ণ প্রথম পাঁচটি আয়াত সম্বন্ধে শিক্ষিত ধর্মপ্রাণ মুসলমান অনেকেই জানেন : “পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ থেকে। পড়ো, আর তোমার রব মহামহিম। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।” ( আল কুরআন ৯৬ : ১-৫)

এ আয়াতগুলোতে লেখাপড়া বা জ্ঞান অর্জনের জন্য যে কত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। এই আয়াতগুলোর একটিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভ্রূণবিদ্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, যা সাম্প্রতিককালে মানুষ জানতে পেরেছে। আয়াতটি হচ্ছে : তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক’ থেকে। ‘আলাক’ শব্দটির অর্থ এবং তাফসির সংক্ষেপে আলোচনা করছি :

তাবারি, ফখরুদ্দীন রাজী, কুরতুবী, ইবনে কাছির, মুফতি মুহাম্মদ তকী উসমানী র: ‘আলাকের’ অর্থ করেছেন ‘জমাট বাঁধা রক্ত’। মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ শফি র: তার মারেফুল কুরআনে ‘আলাকের’ অনুবাদ করেছেন ‘জমাট বাঁধা রক্ত’। এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন : ‘জমাট বাঁধা রক্ত উল্লেখ করার কারণ সম্ভবত এই যে, এটা একটি বরযখী অবস্থা। এর আগে রয়েছে বীর্য এবং পরে রয়েছে মাংসপিণ্ড।’
সাইয়েদ কুতুব শহীদের তাফসিরে ‘আলাকের’ অনুবাদ করা হয়েছে ‘জমাট বাঁধা রক্ত’। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে ৫টি সূরায় ‘আলাক’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। ‘আলাক’ শব্দ থেকে প্রথম অবতীর্ণ সূরাটির নামকরণ করা হয়েছে সূরা আল আলাক। বাকি চারটি সূরায় ‘আলাকের’ উল্লেখ হচ্ছে নিম্নলিখিত আয়াতে :

আল হাজ্জ ২২:৫, আল মুমিনুন ২৩:১৪, আল গাফির ৪০:৬৭, আল কিয়ামাহ ৭৫:৩৭-৩৮। আয়াতগুলো পাঠ করলে ভ্রূণবিদ্যার একটি বৈজ্ঞানিক ধারণা পাওয়া যায় এবং ‘আলাক’ ভ্রূণের কোন পর্যায় তাও জানা যায়। যেমন- ‘তারপর শুক্রকে আমি আলাকায় পরিণত করি। তারপর আলাকাকে গোশতপিণ্ডে পরিণত করি।’ ( আল মুমিনুন ২৩:১৪) অথবা সূরা আল হাজ্জ এর ৫নং আয়াতটি : ‘আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে, তারপর শুক্র থেকে, তারপর আলাক থেকে, তারপর গোশত থেকে।’ সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী র: তার বিখ্যাত তাফসিরে এ আয়াতগুলোর ব্যাখ্যায় বলেন : এখানে মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করার কথা বলা হয়েছে।

আজকাল শুধুমাত্র শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে তাদের বিভিন্ন স্তরের যে বিস্তারিত বিষয়াবলি দৃষ্টিগোচর হতে পারে সেগুলো বর্ণনা করা হয়নি। বরং সেকালের সাধারণ বদ্দুরাও যেসব বড় বড় সুস্পষ্ট পরিবর্তনের কথা জানত সেগুলো এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ শুক্র গর্ভাশয়ে প্রবেশ করে স্থিতি লাভ করার পরে প্রথমে জমাট রক্তের একটি পিণ্ড হয়। তারপর তা একটি গোশতের টুকরায় পরিণত হয় ... । গর্ভপাতের বিভিন্ন অবস্থায় যেহেতু মানব সৃষ্টির এসব পর্যায় (জমাট রক্ত) লোকেরা প্রত্যক্ষ করত, তাই এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। (তাফছিমুল কুরআন, খণ্ড ৮ পৃষ্ঠা : ১৩৭)

প্রশ্ন হচ্ছে, শুক্রের গর্ভাশয়ে স্থিতিলাভের পরবর্তী স্তরেই রক্ত জমাট বাঁধা কি সম্ভব?

এ ব্যাপারে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. মরিস বুকাইলি বলেন : ‘আলাক’ এর অর্থ করা হয় জমাট বাঁধা রক্ত বা রক্তপিণ্ড এবং অনেক অনুবাদে এ অর্থ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এ ব্যবহার ভুল এবং এ সম্পর্কে সতর্ক থাকাটা জরুরি। কারণ মানুষের জন্ম প্রক্রিয়ায় কখনই ‘জমাট রক্ত’ বা ‘রক্তপিণ্ড’ স্তর আসে না ( বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান পৃষ্ঠা : ২৬৭)। এই বিজ্ঞানী তার বিখ্যাত বইয়ে এ উক্তিটি করেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরীক্ষিত এবং প্রমাণিত জ্ঞানের ভিত্তিতে। আমরা জানি যে, রক্ত শরীর থেকে বের হলেই শুধু জমাট বেঁধে যায়। স্বাভাবিক অবস্থায় শরীরের ভেতরে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে না রক্তনালীর মধ্যে অবস্থিত বেশ কিছু উপাদানের কারণে। কোনো কারণে রক্ত শরীরের ভিতরে জমাট বেঁধে গেলে তা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। হৃদপিণ্ডের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধলে মানুষ হার্ট অ্যাটাক করে মারা যেতে পারে। মস্তিষ্কের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধলে শরীরের অর্ধেক অংশ প্যারালাইসিস বা অবশ হয়ে যেতে পারে। হার্টে প্রতিস্থাপিত কৃত্রিম ভালবে রক্ত জমাট বাঁধলে তা জীবনের জন্য খুবই মারাত্মক হতে পারে। পায়ের রক্তনালীতে রক্ত জমাট বাঁধলে পা কেটে ফেলতে হতে পারে। গর্ভপাতের সময় ভ্রূণ ও Placenta (ফুল) স্থানচ্যুত হওয়ায় জরায়ুতে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয় সেখান থেকে রক্তক্ষরণ হয়, যা শরীরের বাইরে এসে জমাট বেঁধে যায়। তাহলে ভ্রূণের ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বাঁধা নিশ্চয়ই কোনো উপকারী বিষয় হতে পারে না। তাহলে মানুষের সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় ‘জমাট রক্ত’ বা রক্তপিণ্ডের ধারণা কোথা থেকে এলো?

‘আলাক’ শব্দটি অতীতে বা বর্তমানে কী কী অর্থে ব্যবহার হয়েছে বা হচ্ছে তা পর্যালোচনা করা যাক : ‘আলাক’ হচ্ছে বহুবচন। এর একবচন হচ্ছে আলাকা। মিসবাহুল লুগাত আরবি বাংলা অভিধানে এর অর্থ করা হয়েছে : জমাট রক্ত, জোঁক। আল মুজামুল ওয়াসীত অভিধান : যা কিছু লেগে থাকে বা ঝুলে থাকে, জমাট রক্ত।

LaneÕs Arabic-English Lexicon : Anything Hung or suspended.

আরবি ভাষার সমগোত্রীয় হিব্রু ও আরামিক ভাষায় ‘আলাক’ এর কাছাকাছি শব্দ হচ্ছে ‘উলুকা’ যার অর্থ রক্তচোষা পোকা (জোঁক) বা লেগে থাকা, ঝুলে থাকা। জাহেলী যুগে আলাকা শব্দটি ঝুলে থাকা অর্থে ব্যবহার করা হতো। যেমন আরবের বিখ্যাত কবিদের ৭টি বা ১০টি কবিতা কাবায় ঝুলিয়ে রাখা হতো যেগুলোর নাম ছিল ‘মু আল্লাক’।

অধিকাংশ তাফসিরকারকের ‘আলাকের’ অর্থ ‘জমাট রক্ত’ গ্রহণ করার কারণ হচ্ছে তৎকালীন চিকিৎসাবিজ্ঞানের সীমিত জ্ঞান। গর্ভপাত হলে জমাট বাঁধা রক্ত পরিলক্ষিত হতো। তা থেকে এ ধারণা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক যে, মানুষের সৃষ্টি জমাট বাঁধা রক্ত থেকে। গ্রিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ভ্রূণবিদ্যা অধ্যয়নের জন্য মুরগির ডিম পর্যবেক্ষণ করতেন। তাতেও এক পর্যায়ে জমাট বাঁধা রক্তের মতো মনে হতো। অ্যারিস্টটলের ধারণা ছিল যে, নারীর ডিম্বাণু পুরুষের শুক্রাণুর সাথে মিলনে জমাট বেঁধে যায়। হিপোক্রেটিস, গ্যালেনেরও ধারণা ছিল যে, গর্ভাশয়ে শুক্রাণুর স্থিতি লাভের পর জমাট রক্তের স্তর আসে।এসব কারণে অধিকাংশ তাফসির কারকের পক্ষে ‘আলাকের’ অন্য অর্থ ঝুলে থাকা বা লেগে থাকা গ্রহণ করা কঠিন ছিল।

সাম্প্রতিক কালে ভ্রূণবিদ্যার প্রমাণিত তথ্য হচ্ছে নিম্নরূপ : আধুনিক মাইক্রোস্কোপে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর ভ্রূণের প্রতিদিনের ক্রমবিকাশ পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। শুরুতে ডিম্বাণু গোলাকৃতি থাকে। শুক্রাণুর মিলনে ডিম্বাণু দ্রুত ভাগ হতে থাকে। প্রথমে দুই ভাগ তারপর চার, আট, ষোল, বত্রিশ, চৌষট্টি এভাবে ভাগ হতে থাকে। উর্বর ডিম্বাণু ২৩-২৪ দিনের মাথায় দীর্ঘাকৃতি ধারণ করে যা জরায়ুতে জোঁকের মত ঝুলে থাকে এবং তা থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে (জোঁকের মতোই)। এই তথ্য সাম্প্রতিককালে আধুনিক মাইক্রোস্কোপ দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৪০০ বছর আগে আধুনিক মাইক্রোস্কোপের অভাবে এ তথ্য প্রমাণ করা ছিল অসম্ভব।

একটি মানব ভ্রূণচিত্র
উপরের আলোচনার ভিত্তিতে ড. মরিস বুকাইলি সূরা আলাকের প্রথম আয়াত দুটির অনুবাদ করেছেন এভাবে : ‘পড়ো, তোমার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তা থেকে যা লেগে বা ঝুলে থাকে।’ (সূরা আলা আলাক ১-২)

ডা. জাকির নায়েক ‘আলাক’ শব্দের অনুবাদ করেছেন, জোঁকের মতো বস্তু বা যা ঝুলে থাকে/লেগে থাকে। কানাডার টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্রূণবিদ্যার বিখ্যাত প্রফেসর Keith Moore বিজ্ঞানের আধুনিক আবিষ্কারের সাথে কুরআনের বর্ণিত ভ্রূণবিদ্যার অপূর্ব মিল দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তার মতে, ভ্রূণ যখন চর্বিত গোশতের পর্যায়ে (মুদ্গা) উপনীত হয় তার দৈর্ঘ্য হয় ১.০ সে. মি. যা সত্যি দাঁত দিয়ে চিবানো সম্ভব আর ভ্রূণ যখন আলাকা স্তরে থাকে তার দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৩.৫ মি. মি. যা চিবানো সম্ভব নয়। এভাবে তার বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে ১৪০০ বছরের পুরনো কুরআন মানুষের রচনা হতে পারে না। এটা নিশ্চয়ই মহাজ্ঞানী আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে যিনি অসীম জ্ঞানের অধিকারী ।
তিনি মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না। (আল কুরআন ৯৬ : ৫)

লেখক : মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us