করোনাভাইরাস : ভারতে রেমডিসিভি আর অক্সিজেনের জন্য হাহাকার
করোনাভাইরাস : ভারতে রেমডিসিভি আর অক্সিজেনের জন্য হাহাকার - ছবি : সংগৃহীত
ভারতে কোভিড সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েভে প্রতিদিন নতুন রেকর্ড ভাঙছে। সারা দেশে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় দু’টি জিনিসের জন্য হাহাকার দেখা যাচ্ছে। এই দু’টি জিনিস হলো রেমডেসিভির ড্রাগ ও মেডিক্যাল অক্সিজেন।
রেমডেসিভির জোগাড় করার জন্য রোগীর পারিবারের মানুষ দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। সরকার এই ওষুধটির দাম নির্ধারণ করে দিয়েও চাহিদা মেটাতে পারছেন না।
কোভিড রোগীদের জন্য অক্সিজেনের জোগান নিয়ে রাজনীতি, আইন আদালত কিছুই বাদ যাচ্ছে না। হাসপাতালগুলোয় অক্সিজেন পেতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেক করোনা রোগী শুধু অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠছে। বস্তুত কোভিড রোগীর প্রিয়জনরা একটা প্রেসক্রিপশন নিয়ে রেমডেসিভির জোগাড় করার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন কিংবা অক্মিজেন সিলিন্ডার পেতে নানান জায়গায় ঘুরছেন। এই মর্মান্তিক দৃশ্যগুলো এখন ভারতে সেকেন্ড ওয়েভের ‘ডিফাইনিং ইমেজ’ বা নির্ণায়ক ছবি হয়ে উঠেছে।
মুম্বাইতে একাধিক কোভিড হাসপাতালের পরিচালক আফজল শেখ স্বীকার করছেন, ‘এই ওষুধটির তীব্র আকাল আছে। সহজেই ওষুধটি মিলছেই না। বড় হাসপাতালগুলোয় কোনোক্রমে পেলেও ছোট হাসপাতালে রেমডেসিভির নেই। সেখানে ভর্তি রোগীর আত্মীয়স্বজন রাস্তায় দিশেহারা হয়ে ঘুরছেন।’
রেমডেসিভির চড়া দামে কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে, এই খবর প্রকাশের পর কেন্দ্রীয় সরকার-এর দাম বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু তাতে জোগান বাড়েনি।
ওষুধটি যাতে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা যায়, তার জন্য ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন কেন্দ্রের অনুমতি চেয়ে চিঠিও লিখেছেন।
কলকাতার সুপরিচিত চিকিৎসক দ্বৈপায়ন ঘটক বলছিলেন, এই ওষুধটি কতটা কার্যকরি তা এক শ’ ভাগ নিশ্চিত না হলেও রোগীরাই এটি প্রেসক্রাইব করার জন্য ডাক্তারদের জোরাজুরি করছেন।
ডা: ঘটক বলেন, ‘এটি একটি অ্যান্টি-ভাইরাল ড্রাগ। ফার্স্ট ওয়েভে যে রোগীদের ওপর এটি প্রয়োগ করা হয়েছিলো দেখা গেছে অনেক ক্ষেত্রে তাদের রোগের সিভিয়ারিটি বা তীব্রতা কম ছিলো। তবে এটাকে বড়জোর বলা যেতে পারে একটা ক্লিনিক্যাল ওপিনিয়ন। কেস কন্ট্রোল স্টাডি ছাড়া নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় রেমডিসিভির আদৌ কোভিড রোগীদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে কি না!’
ভারতে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের নির্দেশিকাও বলছে, রোগীরা কোভিড আক্রান্ত হওয়ার তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে রেমডেসিভির দিলে হয়তো রোগীর অবস্থার উন্নতি হতে পারে। কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার সাত দিন বা ১০ দিন পরেও রোগীদের রেমডেসিভির দেয়ার জন্য চিকিৎসকদের ওপর চাপ আসছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা লিখছেনও। ফলে এই ওষুধ বা ইনজেকশনটির চাহিদাও হু হু করে বাড়ছে।
এই বহুল আলোচিত ওষুধটি ছাড়াও আর একটি পরিচিত ও সাধারণ চিকিৎসা সরঞ্জাম এখন চাহিদার তুঙ্গে। সেটি হলো অক্সিজেন।
গুজরাটে সুরাট সিভিল হাসপাতালের ডা: পারুল ভাডগামা বলছিলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এবার কোভিড রোগীদের অক্সিজেনের চাহিদা অন্তত পাঁচগুণ বেশি। ওপিডিতে যে রোগীরা আসছেন তাদের নব্বই শতাংশই আসছেন স্ট্রেচারে করে। আর তাদের সবারই অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে।’
মুম্বাইয়ের একটি কোভিড হাসপাতালের প্রধান নার্স জানাচ্ছেন, ‘আমাদের ২৫ বেডের ওয়ার্ডে ৩৩ জন ভর্তি আছেন। তাদের সবারই অক্সিজেন লাগছে। সিলিন্ডার জোগাড় করতে আমাদের কর্মী ও ওয়ার্ড বয়রা বহু দূর দূর যাচ্ছেন। প্রতি ঘণ্টায় চারটা করে সিলিন্ডার শেষ হয়ে যাচ্ছে!’
অক্সিজেনের সঙ্কট সরকারকেও বিপদে ফেলেছে। রোগীদের পরিমিত পরিমাণে অক্সিজেন দেয়ার কথা বলে বিতর্ক তৈরি করেছেন ক্যাবিনেটমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল।
তার বক্তব্য ছিলো, ‘বহু জায়গায় অক্সিজেনের অপচয় হচ্ছে এবং দরকার না থাকা সত্ত্বেও রোগীদের অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে।’
এদিকে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে গত রাতে রিলায়েন্স গোষ্ঠীর পাঠানো ৬০ টন অক্সিজেনের ট্রাক দু’ঘণ্টা ধরে আটকে রেখে বিজেপি নেতারা পুজোআচ্চা করেছেন। মিডিয়াকে ডেকে ছবিও তুলেছেন।
সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হওয়ার পর ওই রাজনৈতিক নেতারা যথারীতি বিতর্কের মুখে পড়েছেন।
ওদিকে মুম্বাই শহরতলির দর্জি রামবাবুর মেয়ে ললিতা বলছেন, নার্সিংহোমে অক্সিজেন সিলিন্ডার খুলে নেওয়াতেই তার বাবার মৃত্যু হয়েছে।
সোমবার একই ধরনের অভিযোগ এসেছে মধ্যপ্রদেশের শাহডোল থেকেও। যেখানে ভোররাতে ১০ জন কোভিড রোগী একসাথে অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছেন বলে বলা হচ্ছে।
দিল্লির একটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক নিদা আহমেদ তার চাচার জন্য অক্সিজেনওলা অ্যাম্বুলেন্স জোগাড়ই করতে পারেননি।
তিনি বলেছেন, অক্সিজেন নেই বলে একের পর এক হাসপাতাল আমাদের গেট থেকেই ফিরিয়ে দিয়েছে। চাচা চোখের সামনে এক রকম বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন।
এরই মধ্যে দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষজন অক্সিজেন মজুত করার চেষ্টা করে সমস্যা আরো বাড়িয়ে তুলছেন বলে জানান দ্বৈপায়ন ঘটক।
তিনি বলেন, ‘লোকে এখন বাড়িতেও অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুত করছে। যদি পরে লাগে, এই ভেবে যার সুযোগ আছে সেই দু’টো সিলিন্ডার বাড়িতে রেখে দিচ্ছে। অনেকে আবার বাড়িতে অক্সিজেন কনসেনট্রেটর কিনেও রেখে দিচ্ছেন। অক্সিজেনের উৎপাদন তো অফুরন্ত নয়। এভাবে প্যানিক হোর্ডিং করলে আকাল তো হবেই।
‘আর একটা জিনিস সাধারণ লোককে বোঝাতে পারছি না। একজন কোভিড রোগীর মিনিটে কুড়ি লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন লাগতে পারে। সেখানে একটা সিলিন্ডারে মাত্র বারোশো লিটার অক্সিজেন থাকে। যে মানুষ সিলিন্ডার কিনে রাখছে তো তা দিয়ে কতক্ষণ চালানো যাবে?’ বলছিলেন দ্বৈপায়ন ঘটক।
ফলে দ্বিতীয় ধাক্কার কোভিড সুনামিকে ভারতে আরো ভয়ঙ্কর করে তুলেছে রেমডেসিভির আর অক্সিজেনের তীব্র অভাব।
সূত্র : বিবিসি