'অনুপ্রবেশকারীদের' নিয়ে যা বললেন বিজেপির অমিত শাহ আর দিলীপ ঘোষ
অমিত শাহ আর দিলীপ ঘোষ - ছবি : সংগৃহীত
ভারতের দায়িত্বশীল নেতারা, বিশেষভাবে বিজেপি নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশ নিয়ে আপত্তিকর, উসকানিমূলক ও অসম্মানজনক মন্তব্য করে চলেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ‘অনুপ্রবেশকারীদের ভ্যাকসিন নয়, গলাধাক্কা দেয়া হবে’। বাংলাদেশ নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করতে পিছিয়ে নেই ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডিও। ২০২০ সালে হায়দ্রাবাদের সন্ত রবিদাস জয়ন্তী পালন অনুষ্ঠানে দেশটির বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) নিয়ে বক্তব্য দেয়ার সময় তিনি বলেন, ‘নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলে অর্ধেক বাংলাদেশ খালি হয়ে যাবে।’ কট্টর হিন্দুত্ববাদী এই বিজেপি নেতা বলেন, ‘ভারতের নাগরিকত্ব পেতে অর্ধেক বাংলাদেশীই ভারতে চলে আসবে। তখন ওদের দায়িত্ব কে নেবে, রাহুল গান্ধী নাকি কেসিআর?’ (যুগান্তর, ১৮ মার্চ, ২০২০)।
চরমপন্থী রাজনৈতিক দল ‘মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা’ নেতা রাজ ঠাকরে ঘোষণা করেছেন, ‘ভারত কোনো ধর্মশালা নয়; এখান থেকে বাংলাদেশী ও পাকিস্তানিদের তাড়িয়েই ছাড়া হবে।’ দেশ থেকে অবৈধ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়নের দাবিতে এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সমর্থনে দলটি এ জনসভার ডাক দিয়েছিল। বাণিজ্যিক মহানগরী মুম্বাইয়ের মিছিল ও সমাবেশে লক্ষাধিক মানুষ অংশ নেয়। এ খবরটি ফলাও করে প্রচার করেছে গণমাধ্যম। ফেসবুক পেইজে এক স্ট্যাটাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল মন্তব্য করে বলেন, ভারতে নাকি ‘অবৈধ বাংলাদেশীদের’ বিরুদ্ধে সমাবেশে লাখ মানুষ এসেছে। বাংলাদেশে অবস্থানরত অবৈধ ভারতীয়দের বিরুদ্ধে মুক্তভাবে সমাবেশ করতে দিন। কোটি লোক জড়ো হবে।’ (যুগান্তর, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০) আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞদের মতে, এ জাতীয় মন্তব্য ও বক্তব্য সৎপ্রতিবেশীসুলভ নয়। এতে পারস্পরিক আস্থার সঙ্কট বৃদ্ধি পেতে এবং ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।
পশ্চিম বাংলায় নির্বাচনী প্রচারে এসে আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অমিত শাহ বলেছেন, ‘বাংলাদেশে পর্যাপ্ত খাবারের অভাব রয়েছে। সে দেশে বহু মানুষ নিজেদের রাষ্ট্রেই অভুক্ত থাকে। ফলে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে বাংলাদেশীদের অনুপ্রবেশ বাড়ছে। তৃণমূল কংগ্রেসকে হটিয়ে পশ্চিমবঙ্গে দুই শতাধিক আসন পেয়ে সরকার গঠন করা হবে। ক্ষমতায় এসেই পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ বন্ধ করে দেবো।’ গত ১০-১৫ বছরে বাংলাদেশের আর্থিক উন্নয়ন হয়েছে। তাও কেন লোকে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ করছে? আনন্দবাজারের এমন প্রশ্নে অমিত শাহ বলেন, ‘এর দুটি কারণ আছে- এক. বাংলাদেশের উন্নয়ন সীমান্ত এলাকায় নিচুতলায় পৌঁছায়নি। যেকোনো পিছিয়ে পড়া দেশে উন্নয়ন হতে শুরু করলে সেটা প্রথমে কেন্দ্রে হয়। আর তার সুফল প্রথমে বড়লোকদের কাছে পৌঁছায়। গরিবদের কাছে নয়। এখন বাংলাদেশে সেই প্রক্রিয়া চলছে। ফলে গরিব মানুষ এখনো খেতে পাচ্ছে না। সে কারণেই অনুপ্রবেশ চলছে। আর যারা ভারতের অনুপ্রবেশকারী, তারা যে শুধু বাংলাতেই থাকছে, তা নয়। তারা তো ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। জম্মু-কাশ্মির পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে।’ অমিত শাহের মতে, দ্বিতীয় কারণটি হলো প্রশাসনিক সমস্যা। তিনি বলেন, প্রশাসনিকভাবেই এর মোকাবেলা করতে হবে। সেটা পশ্চিমবঙ্গের সরকার করেনি’
(https://www.anandabazar.com/elections/west-bengal-assembly-election/west-bengal-assembly-election-2021-exclusive-interview)।
এহেন মন্তব্যের কড়া জবাব দিলেন বাংলাদেশের পরারাষ্ট্রমন্ত্রী ড: এ কে আবদুল মোমেন। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, অমিত শাহের বাংলাদেশ সম্পর্কে ধারণা ‘নগণ্য’। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এহেন মন্তব্য ‘গ্রহণযোগ্য’ নয়, বরং ‘দুর্ভাগ্যজনক’ ও ‘বিভ্রান্তিকর’। যেখানে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এত গভীরে পৌঁছেছে, তার এই মন্তব্য ‘নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি’ সৃষ্টি করতে পারে। আবদুল মোমেন আরো বলেন, ‘পৃথিবীতে এমন জ্ঞানী লোক আছেন, যারা দেখেও দেখেন না, জেনেও জানেন না। তবে তিনি (অমিত শাহ) যদি তেমনটা বলে থাকেন, তাহলে আমি বলব, বাংলাদেশ নিয়ে তার জ্ঞান সীমিত। আমাদের দেশে এখন কেউ না খেয়ে মরে না। এমনকি দেশের উত্তরপূর্ব প্রান্তেও ক্ষুধার জন্য হাহাকার নেই। অনেক সামাজিক সূচকে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মোটামুটি ভালো শৌচাগার ব্যবহার করে, ভারতের ৫০ শতাংশেরও বেশি লোকের সেই শৌচাগার নেই। বাংলাদেশে শিক্ষিত লোকের চাকরির ঘাটতি রয়েছে তা স্বীকার করি, তবে দেশে স্বল্প শিক্ষিত মানুষের চাকরির ঘাটতি নেই। তিনি বলেন, ভারত থেকে এসে এখন এক লাখেরও বেশি মানুষ বাংলাদেশে কাজ করছেন। জীবিকার অন্বেষায় আমাদের ভারতে যাওয়ার দরকার নেই।’ (নয়া দিগন্ত ও প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল, ২০২১)
পশ্চিম বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের জন্য বিজেপি মরিয়া হয়ে প্রচারাভিযানে নেমেছে। গুরুত্বপূর্ণ জেলা সদরে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য রাখছেন। বিজেপি পশ্চিম বাংলায় সরকার গঠন করতে পারলে সংখ্যালঘুদের নিয়ে সঙ্কট সৃষ্টি হবে- এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। এ দিকে ‘বাংলাকে গুজরাট বানাতে দেবেন না’ বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জি। গত ১৪ এপ্রিল ডাবগ্রাম-ফুলবাড়িতে নির্বাচনী জনসভায় মমতা বলেন, ‘আসামে সবাইকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাচ্ছে। মনে রাখবেন- বাংলায় এনপিআর, এনআরসি করতে দেবো না। আপনারা সবাই নাগরিক। তবে ১৮ বছর বয়স হলে দেখবেন, ভোটার তালিকায় যেন আপনাদের সবার নাম থাকে।’
বাংলাদেশ নিয়ে তীর্যক মন্তব্য অমিত শাহর নতুন নয়। বিজেপির সভাপতি থাকাকালে ২০১৮ সালে রাজস্থানের এক জনসভায় তিনি ভারতে বসবাসকারী ‘অবৈধ’ বাংলাদেশীদের ‘উইপোকা’র সাথে তুলনা করে দাবি করেন, এক এক করে তাদের সবার নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে। (বিবিসি বাংলা, নয়াদিল্লিø, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)। ২০২০ সালের নভেম্বরে বিএসএফের সাথে এক বৈঠকে অমিত বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে ভোটার গিয়ে ভারতে ভোট দিয়ে আসে। সীমান্ত সিল করে দেয়া হবে, যাতে ‘মশা-মাছিও’ ঢুকতে না পারে। স্মর্তব্য, ২০০২
সালে অমিত শাহ গুজরাটের ডেপুটি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় দুই হাজার মানুষ প্রাণ হারান। এর মধ্যে বেশির ভাগ মানুষই মুসলমান।
অমিত শাহের মন্তব্যের জবাবে বাংলাদেশের পরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া সাহসী উচ্চারণ। জনগণ এটাকে ভালোভাবে নিয়েছে। অনেক সময় জোরালো প্রতিবাদে জনগণের আস্থা ও সমর্থন বৃদ্ধি পায়; যদিও এক যুগ ধরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ছিল অনেকটা নতজানু। তিস্তার পানিবণ্টনসহ অনেক দ্বিপাক্ষিক ইস্যুই আজো অমীমাংসিত। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ভারতের ভূমিকা বাংলাদেশের অনুকূলে নয়। সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা রোধে বাংলাদেশের জোরালো কোনো প্রতিবাদ নেই, শক্তিশালী ভূমিকাও নেই। এমনকি বাংলাদেশের বিজিবি প্রধান ভারতের বিএসএফের সুরে কথা বলেন। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের জন্য এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। মানবাধিকার সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১০ বছরের মধ্যে (২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত) ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে প্রায় এক হাজার ১৮৫ বাংলাদেশী বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
(https://bangla.dhakatribune.com/bangladesh/2020/12/22/30336)।
বাংলাদেশের মুসলমানদের অনুপ্রবেশপূর্বক ভারতে যাওয়ার বা বসতি স্থাপনের কোনো যৌক্তিক বা অর্থনৈতিক কারণ নেই। শিক্ষা, সরকারি চাকরি ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে পশ্চিমবঙ্গে বসবাসরত ভারতীয় মুসলমানদের যে দুর্দশা ও বৈষম্য, তাতে বাংলাদেশী মুসলমানরা নিজ দেশে বেশ সুখেই আছেন। বরং পাঁচ লাখ ভারতীয় নাগরিক ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া বাংলাদেশের গার্মেন্টস, বায়িং হাউজ ও আইটি সেক্টরে কাজ করছেন। এমনকি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম, বিজ্ঞাপন, কনসালটেন্সি- এসব খাতেও ভারতীয়রা রয়েছেন। তারা ট্যুরিস্ট ভিসায় এখানে আসেন। ট্যুরিস্ট ভিসায় যারা কাজ করেন তাদের আয়করের পুরো অর্থই অবৈধ পথে বাংলাদেশের বাইরে চলে যায়। বিআইডিএসের অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ জানান, ‘প্রতি বছর আমাদের দেশ থেকে চার-পাঁচ বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। আর এবার আমাদের রেমিট্যান্সের টার্গেট ২০ বিলিয়ন ডলার। তাহলে আমরা যা আনতে পারি তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ বিদেশী কর্মীদের দিয়ে দিতে হয়। এ থেকে বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশীদের সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। এটা বৈধ চ্যানেলের কথা। অবৈধভাবে কত টাকা চলে যায় সেটা সরকার উদ্যোগ নিলে জানা যাবে।’ (কালের কণ্ঠ অনলাইন, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০)
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ এবং ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য বলছে, বিগত চার বছরে যত বাংলাদেশী ভারতে ঢুকতে গিয়ে ধরা পড়েছেন, তার প্রায় দ্বিগুণ আটক হয়েছেন ভারত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সময়। বাংলাদেশ থেকে ভারতে ‘নেট মাইগ্রেশন’ কমছে বলে বিশেষজ্ঞরা বহুদিন ধরেই বলে আসছেন। এই পরিসংখ্যান কার্যত সেই দাবিকেই সমর্থন করছে। বিএসএফের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করতে গিয়ে মোট তিন হাজার ১৭৩ জন তাদের হাতে ধরা পড়েন। অপর দিকে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ভারতে ঢুকতে গিয়ে আটক হয়েছেন এর মাত্র এক তৃতীয়াংশ, অর্থাৎ এক হাজার ১১৫ জন (শুভজ্যোতি ঘোষ, বিবিসি বাংলা, দিল্লি, ১৭ ডিসেম্বর ২০২০)।
সাংবাদিক ও কলামিস্ট আনিস আলমগীর এ ব্যাপারে এক নিবন্ধে মন্তব্য করেন ‘এটা ঠিক যে, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সামর্থ্যবান হিন্দুদের কেউ কেউ ভারত গিয়েছেন ভারতকে ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থ ভূমি’ জ্ঞান করে। আর কেউ কেউ যাচ্ছেন এখান থেকে বড় অঙ্কের টাকা আত্মসাত করে। মামলায় পলাতক হয়ে। বাংলাদেশ বরং অভিযোগ করতে পারে, ভারত এদের দ্বারা অবৈধভাবে বাংলাদেশের সম্পদ পাচারে সহায়তা করছে এবং মুসলমান ছাড়া সবাইকে নাগরিকত্ব দেবে বলে অমিত শাহরা ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা সিএবির মূলা’ ঝুলিয়ে শিক্ষিত হিন্দু, বিশেষ করে আমেরিকা-কানাডা-ইউরোপে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশী হিন্দুদের দেশত্যাগে বা ভারতে সেকেন্ড হোম বানাতে অর্থপাচারে উৎসাহ জোগাচ্ছেন। এসব প্রবাসীর অনেকে পশ্চিমা দেশে ভারতীয় হিন্দু মৌলবাদীদের সাথে মিশে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায়ও আছে (https://www.jagonews24.com/opinion/article/659026).’
আয়তনের দিক দিয়ে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ ছোট হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এ দেশে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের মতো সর্বভারতীয় ও জাতীয় নেতার জন্ম হয়েছে। প্রায় একশ’ বছর আগে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি মহামতি গোপাল কৃষ্ণ গোখলে বাংলার নেতাদের দূরদর্শিতা নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন তা এখনো প্রযোজ্য। তিনি বলেন, ‘বাংলা আজ যা ভাবে, ভারত ভাবে আগামীকাল’ (What Bengal thinks today, India thinks tomorrow)। মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, ২০২১ পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে এক হাজার ৮৮৮ ডলার। আর একই সময়ে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে এক হাজার ৮৭৭ ডলার।
বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে যারাই বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়েছেন তারা সবাই ভারতের সাথে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে আন্তরিক ছিলেন। বিএনপি বিরোধী দলে থাকার সময় ‘ভারতবিরোধিতা’ করে জনসমর্থন আদায় করলেও ক্ষমতায় আসীন হয়ে ‘ভারততোষণ’ নীতি অবলম্বন করেছে। আওয়ামী লীগ ‘ভারতপন্থী’ হিসেবে সবসময় পরিচিত পেয়ে আসছে। কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের সাথে আওয়ামী লীগের যেমন মধুর সম্পর্ক ছিল, তেমনি বিজেপির আমলেও তাদের ‘ভারতপ্রীতি’ মোটেই কমেনি। বরং বর্তমান সরকার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী কতিপয় সশস্ত্রগোষ্ঠীর ঘাঁটি বন্ধ করে দেয়ায় আস্থার বন্ধন দৃঢ় হয়েছে দু’রাষ্ট্রের। বাণিজ্য ও ট্রানজিট সুবিধা দুদেশকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। আমাদের বৃহত্তম প্রতিবেশী দেশ ভারত। ভারতের সাথে আমাদের সীমান্ত প্রায় চার হাজার ১৪৪ কিলোমিটার।
আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান আমরা কোনোদিন ভুলতে পারি না। সুতরাং যে সরকার বাংলাদেশে সরকার গঠন করে ভারতের সাথে তারা বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় নেতাদের অসম্মানজনক মন্তব্য বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারে। বৈদেশিক সহযোগিতা নিয়ে হলেও সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশকে। কারণ যেকোনো সময় আসাম ও পশ্চিম বাংলা থেকে ‘পুশইন’ করা হতে পারে। তখন রোহিঙ্গা সমস্যার চাইতে আরো বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। ভারতীয় নেতাদের বক্তব্য এরই ইঙ্গিত বহন করে। সুতরাং সময় থাকতে বাংলাদেশকে সাবধান হতে হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com