সৈয়দ আলী আহসান : কাছে থেকে দেখা
সৈয়দ আলী আহসান - ছবি : সংগৃহীত
তখন আমি ইউনিভার্সিটির ছাত্র। তুখোড় আড্ডাবাজদের একজন। আড্ডা, কিন্তু কবিতার। আড্ডা কিন্তু কবিদের। আড্ডা ঠিক সাহিত্যের কোনো না কোনো বিষয়ের। হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে, টিএসসি, মধুর ক্যান্টিন, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি এসব জায়গায়। এছাড়া বিশেষ কেন্দ্র ছিলো দৈনিক ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, বাংলার বাণী, ইনকিলাব এবং শিল্পকলা একাডেমি। প্রথম আলোসহ বেশ ক’টি পত্রিকার জন্ম হয়নি তখনও। এসব আড্ডায় কবিতার সঙ্গে কবিদের এবং সাহিত্যের সঙ্গে সাহিত্যিকদের আলোচনা থাকতোই। যেমন থাকে আজও। আলোচিত গুটিকয় নাম ঘুরেফিরে উঠে আসতো আড্ডায়। এর মধ্যে একটি নাম- সৈয়দ আলী আহসান।
দেখা হওয়ার আগেই নামটির সঙ্গে পরিচয় ছিলো ঘনিষ্ঠ । ছিলো জাতীয় পত্র-পত্রিকার সৌজন্যে। বিভিন্ন দিবসে দৈনিকগুলো প্রকাশ করতো বিশেষ সংখ্যা। এর মধ্যে সাপ্তাহিক এবং পাক্ষিক ছিলো। ছিলো মাসিকও। প্রকাশের এ ধারা অব্যহত এখনও। বিশেষ সংখ্যার বুকে সৈয়দ আলী আহসান নামটি ছিলো বরাবর। থাকতো প্রথম পাতায় জ্বলজ্বলে। তাঁর লেখা দিয়েই হতো বিশেষ সংখ্যার সূচনা। পড়তে পড়তে বেশ আপন হয়ে উঠলেন তিনি। একান্ত পছন্দের হয়ে উঠলেন। প্রতিটি পাঠকের প্রিয় লেখক থাকেন। যাদের লেখা ভালো লাগা ছাড়িয়ে প্রিয় হয়ে ওঠে। সৈয়দ আলী আহসান তেমনই একজন প্রিয় লেখক ছিলেন আমার। যখন কাছাকাছি হলাম হয়ে উঠলেন প্রিয় মানুষও। একজন লেখক এবং একজন মানুষ যখন দু’ধারী হয়ে ওঠেন দারুণ জমে যায় বিষয়টি। তাঁর সাথে তেমনই জমেছিলো আমার। জমেছিলো আন্তরিক ঔজ্জ্বল্যে। সময়ে অসময়ে পেয়েছি তাঁর সান্নিধ্য। তাঁর স্নেহের ছায়াটি দীর্ঘ হয়ে উঠেছিলো আমার দিকে। যখন তখন ভিজতাম সে ছায়ার শীতলতায়। তাঁর প্রশ্রয় উদযাপন করেছি। আনন্দ নিয়েছি সান্নিধ্যের।
তিনি তাঁর পছন্দের তারুণ্যের প্রতি ছিলেন অকাতর। ছিলো একধরনের পক্ষপাত । বিশ্বাস করতেন সাহিত্যের বাঁক বদলের প্রেক্ষিত রচনা করে তারুণ্য। তাঁর দরোজা সবসময় খোলা ছিলো তারুণ্যের দিকে।
কখনও কখনও আড্ডা জমে উঠতো তাঁর বাসায়। একরকম অঘোষিত সাহিত্যের মজমা জমে উঠতো। সন্ধ্যা হলেই একজন দু’জন করে পাঁচ সাতজন দশজনও হাজির হতেন। আড্ডায় প্রায় সকলেই কম বেশি কথা বলতেন। কিন্তু সবার তৃষ্ণা চাগিয়ে থাকতো তাঁর দিকে। কখন কথা বলবেন তিনি। তাঁর কথা মানে নতুন কিছু। নতুন কোনো বিষয়। নতুন কোনো চিন্তা। তিনি যা বলতেন তা ই সাহিত্যের নান্দনিক সৌরভে মথিত ছিলো। ছিলো কাব্যগন্ধী আনকোরা শব্দের নিখুঁত উচ্চারণ। তাঁর উচ্চারণ সংশয়হীন। বাক্য দ্বিধামুক্ত। বক্তব্য দৃঢ়। গভীর বাণীর প্রস্রবন। বলতেন স্পষ্ট। জড়তামুক্ত। যে বিষয়ে বলতেন, তলা ছুঁয়ে বলতেন। আগাগোড়া ভেজে বলতেন। আঁট ঘাট চিনে বলতেন। বলার ভংগীও ছিলো তাঁর নিজস্ব। শব্দের মালা গাঁথার সুতোটি ছিলো তার আয়ত্তে। যথাস্থানে যথার্থ শব্দটি গেঁথে দিতে তিনি ছিলেন দক্ষ। শব্দগুলো তসবির দানার মতো অথবা বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝরে ঝরে পড়তো। বলতে বলতে থামতেন। কোথায় থামতে হবে জানতেন। কতক্ষণ বলা উচিৎ বুঝতেন। শ্রোতার তৃষ্ণা তেজি থাকতে থাকতে শেষ করে দিতেন। কখনও কারো অধৈর্যের রেখা ছুঁতে দিতেন না।
কোনো অনুষ্ঠানে তাঁর পালা এলে জিজ্ঞেস করে নিতেন- কতক্ষণ বলবেন। যতটা সময় তাঁর পক্ষে বরাদ্দ ততক্ষণই বলতেন। সময়ের শেষ দাগে এসে বলতেন শেষ বাক্যটি। বিশ মিনিট দিলে বিশ মিনিট। এক ঘণ্টা দিলে এক ঘণ্টাই বলতেন। মজার বিষয় ছিলো বিশ মিনিটের বক্তব্যে যেমন গুরুত্ববহ বাণী থাকতো। এক ঘণ্টার বক্তব্যেও তেমনই থাকতো। এক কথা বারবার অথবা বক্তব্যের পুনরুক্তি থাকতো না।
বাংলা বক্তব্যে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার করতেন না। ইংরেজি বললে বাংলার মিশেলও ছিলো না। তাঁর বক্তব্য লিখে নিলে একটি গোছানো সৃষ্টিশীল প্রবন্ধ কিংবা নিবন্ধ হয়ে উঠতো।
নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে ছিলো তাঁর। যেতেনও। তিনি লিখতেন তাঁর প্রবল আকাংখার উচ্চতা নিয়ে। স্পর্শ করতেন বিষয়ের পূর্বাপর। না কোনো বিষয়ে ভাসা ভাসা ছিলেন না তিনি। গভীরতা ছিলো অতল। বিষয় বৈচিত্রও অগুণতি। যে কোনো বিষয় আলোচনার সঙ্গ পেতো সে বিষয়েই সার কথা বলতেন তিনি। হোক কবিতা। সাহিত্য। কিংবা সাহিত্য বা শিল্পের যে কোনো শাখা । সেটি হোক দেশীয় অথবা আন্তর্জাতিক। সাহিত্যের বাইরের বিষয়ও ছিলো তাঁর নখদর্পনে। জীবনের গভীর তাৎপর্য জানতেন। জীবন ও জগতের রহস্যময় বিষয়ে তিনিও রহস্যময় হয়ে উঠতেন। সৃষ্টির বিশালতার ভেতর ডুব দেবার দৃঢ় শ্বাস ছিলো তাঁর। এই মহাবিশ্বের বিশালত্বে মানুষের অবস্থান কি! স্থিতি ও স্থানান্তরের কায়দা ও কৌশল কেমন। কেন মানুষ আসে পৃথিবীতে! চলেই বা যায় কেন! গেলে না ফেরার চিরন্তন রহস্যের বিধান ছিলো স্বচ্ছ। প্রকৃতির প্রতি কৌতূহল তাঁকে ভাবুক করে তুলেছিলো। আধ্যাত্মিকতার অনুধ্যান ছিলো গভীর। ¯্রােতে ভেসে যাওয়া কোনো মানুষও তাঁর প্রিয় ছিলো না। সহজে কাউকে গ্রহণ করার প্রবণতা থেকে দূরে রাখতেন নিজেকে। গাম্ভীর্য এবং গভীরতা দেখে সম্পর্কের সেতু চিহ্নিত করতেন তিনি। কিন্তু মিষ্টিভাষী ছিলেন সবার সাথে। কথায় ছোবল দেবার বৈশিষ্ট্য ছিলো না তাঁর।
পৃথিবীতে কিছু মানুষের থাকে নিজস্ব জগৎ। একান্ত আপন ভুবন। তেমনই নিজস্ব ও একান্ত জগৎ ছিলো সৈয়দ আলী আহসানের। তাঁর রচনা কৌশলেও ছিলো তাঁর নিজস্বতা। তাঁর লেখা পড়ে তাঁকেই পাঠ করার কথা মনে হতো। আজও তেমনি মনে হয়। মনে হয় লেখার ভেতর লুকিয়ে তিনি। লেখায় গুছিয়ে দিতেন নিজের জগৎ। অন্তত তাঁর আত্মজীবনীধর্মী বই- ‘¯্রােতবাহী নদী’, ‘আমার প্রতিদিনের শব্দ’ এ কথার সাক্ষ্য দেয়।
তাঁর যে কোনো লেখা পাঠ করার ফল ছিলো পরিপূর্ণ।
স্বাদ অন্যরকম আনন্দের। বিশেষ রান্নায় যেমন বিশেষ স্বাদ। তাঁর লেখার রসায়নেও ছিলো স্বাদের চমৎকারিত্ব। প্রতিটি বাক্য ওজনদার। শব্দগুলো জীবন্ত। আঙ্গিক নিজস্ব। একান্ত নিজের ঢংয়ে বলা। কিছু শব্দ নতুন। কিছু পুরনো। কিছু পরিচিত শব্দের নতুন ব্যবহার। এসবের মিশেলে লেখাটি হয়ে উঠতো সুখপাঠ্য। লেখায় শুরু থেকে শেষাবধি একটি সাবলীল ¯্রােত বহমান। পাঠ শুরু হলে পাঠককে শেষের দিকে টেনে নেয়ার চুম্বকীয় আকর্ষণ বেশ স্বচ্ছল! শেষ হলে একটি অন্যরকম তৃপ্তি পূর্ণতা পেতো। গজিয়ে উঠতো নতুন চিন্তার চারা। কল্পনার জগৎ সহসা কাছের হতো বাস্তবতার নিরিখে। এভাবে সৈয়দ আলী আহসান আমার নিত্য পাঠ্য হয়ে উঠলেন।
আমি তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যের হয়ে উঠবো এমন ধারণা জন্মেনি কখনও। ভাবিনি তাঁর কোনো বিশেষ প্রয়োজনে অনুভব করবেন আমাকে। কিংবা প্রয়োজন অপ্রয়োজনে আমি ফিরে ফিরে পৌঁছবো তাঁর আঙিনায়। সব হয় তো ভাবতে পারে না মানুষ। ভাবনার আকাশে সবসময় ফোটে না চাঁদের মুখ। সময় মানুষকে দাঁড় করিয়ে দেয় অকল্পনীয় কোনো চূড়ায়। অথবা অভাবনীয় কোনো উপত্যকার দিগন্তে। আমারও হয়েছিলো তেমনি কাহিনী। সৈয়দ আলী আহসান এর সাথে আমার একান্ততা অন্তত আমার ভাবনার বাইরের।
তাঁর সাথে প্রথম দেখা জাতীয় প্রেসক্লাবে। একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি তিনি। দূর থেকে যাকে গভীরভাবে পাঠ করি চোখের সামনে তিনি। বেশ পুলক অনুভব করছিলাম। বেঁটে-খাটো একজন মানুষ। কিন্তু মাথাটি বেশ গোলগাল। অপেক্ষাকৃত বড়। চেহারার সাথে মানানসই। দুটি চোখ স্বচ্ছ। জ্বলজ্বলে। দৃষ্টি গভীর।
মাথা এবং চোখ ছিলো আকর্ষণীয়। দেখেই মনে হলো স্থিরচিত্ত। মুখে ছড়ানো হাল্কা দাড়ি। পাঞ্জাবি পাজামায় জড়ানো শরীর।
তাঁর যাদুকরী বক্তৃতার প্রেমে পড়েছিলাম সেদিন। শুনছিলাম মন ও আবেগ উঁচিয়ে। শুনতে শুনতে মনে হলো - ইস! এতো সুন্দর করেও বলা যায়! একদম সাবলীল। প্রতিটি শব্দ গোটা গোটা উচ্চারণ। বাক্যগুলো লেখ্যগুণে সমৃদ্ধ। মনে হয় লিখে মুখস্ত করা। কণ্ঠস্বর না উঁচু। না নিচু। যেখানে থামার থামছেন। চলার তো চলছেন। দর্শকের চোখে চোখ। শুনেই মনে হলো এ বক্তৃতা কোনো সাধারণ বক্তৃতা নয়! কোনো সাধারণ মানুষের বক্তব্যও হতে পারে না। এক ধরনের বিস্ময় জেগে উঠেছিলো আমার ভেতর। মন প্রশ্রয় দিচ্ছিলো অবাক হতে। ভাবছিলাম- মানুষের মুখের ভাষার ঢেউ আবেগকে এমন করে ভাসিয়ে নিত পারে কি করে। কি করে শব্দের উন্মাদনা এতোটা ঘোরে আক্রান্ত হতে পারে! এসব কথা তাড়া দিচ্ছিলো আমাকে। ভাবছিলাম- তবে এমন করেও কথা বলা যায়! গাঁথা যায় শব্দফুলের মালা! শব্দের পিঠে সে কি শব্দদানা! যথার্থ শব্দটির আকর্ষণীয় প্রয়োগে বাক্যটি হয়ে ওঠে নানন্দিক। বেশ সহজ করে অনেক কঠিন কথা বলার কৌশলী শিল্পী ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান। বৃষ্টিফোটার মতো অঝোর বর্ষণ ছিলো তার শব্দধারায়।
শ্রদ্ধার জায়গাটি কোনোভাবেই জবরদস্তির সাথে যায় না। ক্ষমতার সাথেও না। আইন করে তো নয়-ই। ভালোবাসা? না এখানেও খাটে না জোর। এখানেও বিধি অথবা নিয়মের আশ্রয় চলে না। সাদা কথায় শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা একদমই মনের শাসনাধীন। মনেই রোপিত এর অকাট বীজ। সে বেড়ে ওঠা বৃক্ষেই ফোটে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার ফুল। এ ফুলই সৌরভ ছড়ায় জীবনের চলতি পথে। পথের আনন্দ তখন দীর্ঘ হয়ে ওঠে।
হ্যাঁ তেমনই বিষয়টি। সৈয়দ আলী আহসান শ্রদ্ধার একজন। ভালোবাসারও। কোনো মানুষকে ভালোবাসতে পারার আনন্দটি অন্যরকম। ভালোবাসার মানুষ সবাইকে উপহার দেয় না জীবন। ভালোবাসার মতো মুখ পেলে স্বচ্ছল হয়ে ওঠে মানুষের ভেতর জগৎ। ভালোবাসার রকমফের আছে। থাকবেই। তবে ভালোবাসার উৎপত্তির উৎস কিন্তু ভালোলাগার নিবিড় অনুভূতি। একে বলা যায় ভালোবাসার চারা বীজ। শ্রদ্ধার পক্ষেও বলা যায় একই কথা।
সৈয়দ আলী আহসান তেমনই একজন শ্রদ্ধার। ভালোবাসার।