দুই ভূখণ্ডের রান্না : কারিয়ালাঁপায়েশতি এবং সাপাসুই
দুই ভূখণ্ডের রান্না : কারিয়ালাঁপায়েশতি এবং সাপাসুই - ছবি : সংগৃহীত
টেবিলে তখন ইথিওপিয়ান খাবার দরোওয়েত। খেতে খেতে কথা। এরপরে কোন দেশে যেতে চাও? অগ্নি নানরুটির টুকরোতে দরোওয়েতের ঝোল মেখে মুখে দিয়ে বলে, ডেলিশাস।
খাবারটা গলাধঃকরণ করে বেশ ভেবেচিন্তে জানায়, ফিনল্যান্ড।
সাথে সাথে জলে ভাসা শহর ভেনিস এসে সটান দাঁড়িয়ে পড়ে। তখন জানুয়ারি, ভেনিসে তেমন ঠাণ্ডা নেই। কসোভোর মাইনাস চল্লিশ থেকে পালাতেই আমরা দক্ষিণে পাড়ি জমাই। সেটা ছিল ২০০৩ সাল। আমার সহকর্মীদের দেখেছি, বেড়াতে গেলে পুরো পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়- এটাই উচিত। তাহলে ছুটিটা উপভোগ করা যায়। আমার বদ-অভ্যাস আছে। যেখানেই যাই, যেখানেই থাকি, যোগাযোগের সুতোটা কেটে দিই না। সারা দিন ভেনিসের মুরানো দ্বীপ, টর্চেলো দ্বীপ, বুরানো দ্বীপ ঘুরে-টুরে সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে আসি। স্ত্রী-সন্তানেরা শুয়ে পড়লে কাছের কোনো ইন্টারনেট ক্যাফেতে ঢুকে পড়ি। ৩০ মিনিটে ই-মেইলগুলো দেখে নিই, উত্তর দিতে হলে দিই।
ইমেইল পাঠিয়েছেন হেলি উসিকিলা। ঢাকাস্থ ইউএনডিপি অফিসের পার্বত্য প্রকল্পের ম্যানেজার। তিনি কিভাবে আমার ই-মেইল ঠিকানা পেলেন, সে এক লম্বা কাহিনী, আজ সেই কাহিনী থাক। হেলি জানায়, ইইউর টম বলেছে ঢাকায় তুমি একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ খুঁজছো, আমাদের পার্বত্য প্রকল্পের অপারেশন্স ম্যানেজারের দায়িত্ব নিতে যদি রাজি থাকো আমাকে জানাও।
পরদিন মুক্তির সাথে আলাপ-আলোচনা করে জানিয়ে দিলাম, রাজি আছি। রিক্রুটমেন্টের লম্বা প্রক্রিয়া সেরে এপ্রিলের ১৬ তারিখে আমি এবং মুক্তি, দু’জনেই কসোভোর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ঢাকার উদ্দেশে উড়াল দিই। হেলিই প্রথম কাছে থেকে দেখা কোনো ফিনিশ মানুষ। হেলি শুধু সহকর্মীই না, বেশ ক’বছর পর ঢাকায় ফিরে পুরনো বন্ধুদের সাথে যখন বেশ একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে, ফিনিশ এই ছিপছিপে তরুণী হেলি উসিকিলাই হয়ে ওঠে আমার প্রধান বন্ধু। হেলির দিক থেকে আমি ওর প্রধান বন্ধু না হলেও নিজেকে ও আমার প্রধান বন্ধু মনে করত। অনেক দিন পর দেশে ফিরে এসেছি বলে ও আমাকে বিদেশিদের মতো ট্রিট করত। কি করব কি করব না, কোথায় গেলে নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে, কোথায় ছিনতাই বেশি হয়, এইসব বলে ও আমাকে ঢাকায় চলাফেরা সম্পর্কে সতর্ক করে দিত।
তিন পাহাড়ি জেলায়ই আমাকে যেতে হয়, প্রকল্প সদর দফতর রাঙামাটি গিয়ে থাকতে হয় মাসের প্রায় অর্ধেক সময়। হেলির একজন বাঙালি বয়ফ্রেন্ড ছিল। বাংলাদেশের আচার-সংস্কৃতি ও খুব ভালো করেই জানত। রাঙামাটিতে দরকার না হলেও, বাঙালি মুসলমানদের পার্টিতে ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে উপস্থিত হত হেলি। একজন শাদা, সুন্দর গঠনের মেয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে হাজির হয়েছে দেখতে খুব ভালো লাগত।
আমার বেইজ ঢাকাতে হলেও হেলির বেইজ ছিল রাঙামাটি। আমি যখন রাঙামাটি যেতাম হেলি আমাকে লোকাল গাইডের মতো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাত। সন্ধ্যার পরে দো-চোয়ানি, বাঁশের ভেতরে মাংস পুড়িয়ে রান্না করা চাকমা খাবার হেলিই আমাকে প্রথম খাওয়ায়। হেলির কাছ থেকে ফিনিশ ডিশ খেতে চাইলে বলত, ইউরোপের সব খাবার প্রায় একই রকম। আলাদা কিছু নেই।
জাতিসঙ্ঘে নানা দেশের, নানা ভাষার মানুষ কাজ করে। কিন্তু হেলি ছাড়া আমি আজ অব্দি আর কোনো ফিনিশ সহকর্মী পাইনি। যে দেশের মোট লোকসংখ্যা মাত্র ৫৪ লক্ষ এবং মাথাপিছু আয় ৪৯ হাজার মার্কিন ডলার, কোনো দুঃখে ওরা দেশের বাইরে কাজ করতে যাবে। এত অল্প লোক বাস করলেও দেশটা কিন্তু ছোটো না। ফিনল্যান্ডের আয়তন তিন লাখ ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটার। প্রতি বর্গকিলোমিটারে মাত্র ১৮ জন লোকের বাস। ঠাণ্ডা যদি কারো কাছে বড় কোনো সমস্যা না হয় তাহলে উত্তর মেরুর দেশ ফিনল্যান্ড বসবাসের জন্য স্বর্গ।
ইউটিউব ঘেঁটে একটি ডিশ বের করলাম, কারিয়ালাঁপায়েশতি। উত্তর ইউরোপের কারেলিয়া অঞ্চলে এই খাবারের উৎপত্তি হয়। কারেলিয়া এখন দুই দেশে বিভক্ত, ফিনল্যান্ড এবং রাশিয়া। এখনো পুরো কারেলিয়াতেই কারিয়ালাপাঁয়েশতি খুব জনপ্রিয় খাবার। ২০০৭ সালে ফিনল্যান্ড সরকার এই খাবারটিকে ওদের জাতীয় খাবারের মর্যাদা দেয়। রান্না করাও খুব সহজ। দুই রকমের মাংস লাগে। ওরা গরু এবং শূকরের মাংস ব্যবহার করে। শূকরের বদলে ছাগলের গোশত হলেও চলে। হাড় ছাড়া দুই রকমের গোশত ছোটো ছোটো করে কেটে মিশিয়ে নিতে হয়। গোশতের অর্ধেক গাজর এবং গাজরের সমপরিমাণ পেঁয়াজকুঁচি ঢেলে দিতে হয় একটি ওভেনপ্রুফ পাত্রে। এরপর গোল মরিচের গুঁড়ো, নুন, তেজপাতা এবং খুব সামান্য তেল দিয়ে মেখে নিতে হয়। মিশ্রণে পানি ঢেলে মিশ্রণটা ডুবিয়ে দিতে হয়। ব্যাস, এবার ১৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রান্না করতে হবে ৪ ঘণ্টা।
রান্নাটা যখন এত সহজ, কালই করে ফেলব। মুক্তি বাঁধা দেয়, এত ঘন ঘন না, আগামী সপ্তাহে করো।
একটি বড় দেশে নানা সংস্কৃতির চর্চা হবে- এটিই স্বাভাবিক। ফিনল্যান্ডে আদি ফিনিশ সংস্কৃতির পাশাপাশি তাভাস্তিয়ান এবং কারেলিয়ান সংস্কৃতির চর্চা প্রমিন্যান্ট। কারিয়ালাঁপায়েশতি কারেলিয়ান সংস্কৃতির খাবার।
বাংলাদেশের দ্বিগুণের চেয়েও বড় দেশ ফিনল্যান্ড হচ্ছে ছোটো ছোটো অসংখ্য জলাশয়ের দেশ। ছোটো-বড় মোট এক লাখ ৮৮ হাজার লেক আছে ফিনল্যান্ডে। সবচেয়ে বড় লেকটির নাম সুরসাইমা লেক, যার আয়তন ৪,৪০০ বর্গকিলোমিটার। এইসব লেকের ভেতরে ভেসে আছে নয়ানাভিরাম ৯৮ হাজার ৫০টি বিভিন্ন আকৃতির দ্বীপ।
অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের মতো ফিনল্যান্ডের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও বেশ প্রাচীন। খ্রিস্টের জন্মের ৯ হাজার বছর আগেই এখানে কিউকারেন এবং পলিয়া সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে।
১৯৯৯ সালের জুন মাসে আমি যখন ঢাকা থেকে অ্যারোফ্লোটের বিমানে চড়ে কোপেনহেগেন যাচ্ছিলাম, মস্কো বিমান বন্দরে ৮ ঘণ্টার যাত্রাবিরতিতে এক বাঙালি ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয়, তার নামটি এখন ভুলে গেছি, তিনি ফিনল্যান্ডের ঔলুতে বসবাস করতেন। ছাত্র হিসেবে পড়তে গিয়ে ওখানেই থেকে যান। পরে অধ্যাপনার জীবন বেছে নেন। তার সাথে আমার অনেক বছর পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল। একবার দু’জনের ছুটির দিনক্ষণ মিলিয়ে ঢাকায় গিয়ে একসঙ্গে ঘোরাঘুরিও করেছি। তিনি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন আমি যেন ঔলু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই এবং ফিনল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাসের কথা ভাবি। অবশ্য তিনি আমাকে ফিনিশদের বর্ণবাদী আচরণের কথাটিও বলতে ভোলেননি। ওখানকার মেয়েরা ভারতীয় ছেলেদের প্রতি খুব দুর্বল এই কথাটিও জানান। আমি তাকে বলেছিলাম, বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে, এখন আর এসব জেনে লাভ নেই। আমি একজন সুখী বিবাহিত পুরুষ এবং চাকরি-বাকরি ছেড়ে আবার ছাত্র হওয়ারও কোনো ইচ্ছে আমার নেই। তবে সময় সুযোগ পেলে ফিনল্যান্ডে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। আমাদের অঞ্চলের ছেলেদের পেলে যে ফিনিশ মেয়েরা ছাড়তে চাইবে না তা হেলির বাঙালি বয়ফ্রেন্ডের প্রতি প্রেম দেখেই বুঝতে পারি।
হাতে যখন সময় আছে তখন কারিয়ালাঁপায়েশতি সম্পর্কে আরো একটু স্টাডি করে নেওয়া যেতে পারে। বেশ কিছু রান্নার ভিডিও দেখে নিলাম। হেলি একেবারে মিথ্যে বলেনি, ফিনিশ ডিশ বলতে আসলে খুব বেশি কিছু খুঁজে পেলাম না। কারিয়ালাঁপায়েশতি যেহেতু মাংসের ঝোল জাতীয় খাবার, এটি আমাদের জিহ্বায় রুচবে ভালো, তাই অন্য কিছুতে আর আগ্রহী হলাম না।
১৭ ডিসেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার, রান্নাটা চড়িয়ে দিলাম। ৪ ঘণ্টার যাত্রা শুনে মুক্তি কিছুটা ভ্রƒ নাচাল।
আজ আমরা ডিনার খেতে পারব তো?
কিছুক্ষণ পরপর মুক্তি ওপরতলা থেকে নিচে নেমে জিজ্ঞেস করে, মুখে দেয়া যাবে তো?
কারিয়ালাঁপায়েশতি খেতে হয় ম্যাশ পটেটো দিয়ে। আমি আলু সেদ্ধ বসিয়ে দিয়েছি। পুত্রবধূ ব্রিজিত এসে ম্যাশ পটেটোর বাকি দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করল। ও খুব ভালো ম্যাশ পটেটো তৈরি করে। ওদের বাড়িতে ওর নাম “ম্যাশ পটেটো কুইন”। ঠিক সন্ধ্যা ৬টায় টেবিল তৈরি। গাজর এবং পেঁয়াজের মধ্যে গলে যাওয়া মাংস এবং স্ট্যু সত্যিই খুব সুস্বাদু হয়েছে। যারা কারিয়ালাঁপায়েশতি রান্না করবেন বাঙালি জিহ্বার জন্য কিছুটা শুকনো মরিচের গুঁড়ো আর গরম মসলার গুঁড়ো দিয়ে দিতে পারেন। তবে কিছুতেই হলুদ, আদা, রসুন, ধনিয়া এসব দেবেন না, তাহলে কারিয়ালাঁপায়েশতির আসল বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যাবে।
খাওয়ার সময় সবাই ওয়াও, ওয়াও করলেও মুক্তি চুপচাপ খেয়ে উঠলো। সিঙ্কে যখন হাত ধুচ্ছি, মুক্তি পাশে এসে আস্তে করে বলে, কারিয়ালাঁপায়েশতি কিন্তু দুর্দান্ত হয়েছে।
হেলির কাছে ফিনিশ ডিশ খেতে চেয়েছিলাম, ও খাওয়ায়নি, আজ ১৭ বছর পর জানি না হেলি এখন কোথায় আছে, তবে খুব ইচ্ছে করছে ওকে এক দিন কারিয়ালাঁপায়েশতি রান্না করে খাওয়াই।
সাপাসুই
ফিনিশ ট্র্যাডিশনাল খাবার কারিয়ালাঁপায়েশতি সুপারহিট। প্রতিবারের মতো এবারো খাবার টেবিলেই পরবর্তী দেশের নাম ঘোষণা করা হবে। এবার দেশ নির্বাচনের দায়িত্ব ব্রিজিতের। হয়ত ব্রিজিত আগে থেকেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল, তাই কোনো রকম চিন্তা না করেই ঘোষণা করে, সামোয়া আইল্যান্ড।
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে ভেসে থাকা দ্বীপ দেশ সামোয়া আইল্যান্ড। পলিনেশিয়ান এই দেশটি দুই ভাগে বিভক্ত। পশ্চিম অংশ স্বাধীন সামোয়া, পূর্ব অংশ আমেরিকার একটি টেরিটোরি বা আমেরিকান সামোয়া।
সামোয়ার নিকটস্থ দেশ নিউজিল্যান্ডের দূরত্ব ৩,৪৩২ কিলোমিটার এবং আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপের দূরত্ব ৩৯২০ কিলোমিটার। আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে দক্ষিণ এশিয়া থেকে, খোদাই জানেন কিভাবে, কিছু মানুষ এসে সামোয়া দ্বীপে বসতি স্থাপন করে। অথচ দক্ষিণ এশিয়া থেকে এই দ্বীপের দূরত্ব ১০ হাজার কিলোমিটার। সামোয়ার অধিবাসীদের দেহ ও মুখের আকার-আকৃতি এবং রং দেখে গবেষকদের এই তথ্য অমূলক বলে মনে হয় না। কে জানে, হয়ত সাড়ে তিন হাজার বছর আগে এই বিস্তীর্ণ জলভূমির ওপর ভেসে ছিল অসংখ্য ছোটো ছোটো দ্বীপ। কোনো এক বা একাধিক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সেইসব দ্বীপ সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে গেছে এবং তাদের কেউ কেউ ভাসতে ভাসতে এসে উঠেছে সামোয়া, ফিজিসহ প্রশান্ত মহাসাগরে এখনো ভেসে থাকা দ্বীপগুলোতে।
আমাকে এখন খুঁজে বের করতে হবে সামোয়া দ্বীপের কোনো একটি মজার ডিশ। ব্রিজিত এবং নভো এই খোঁজাখুঁজির কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। প্রকৃতপক্ষে ওরাই ঠিক করে দিলো, আমাকে রান্না করতে হবে সামোয়ার প্রথাগত খাবার সাপাসুই। ইউটিউব ঘেঁটে সাপাসুই রান্নার প্রক্রিয়াটি দেখে নিলাম। অতিমাত্রায় সয়া সসের ব্যবহার দেখে আমার মোটেও ভালো লাগল না। কিন্তু নভোর জোর তদ্বির সাপাসুইই রান্না করতে হবে। সাপাসুই রান্না করার জন্য লাগবে চিকন গ্লাস নুডুলস, মানে যে নুডুলস কাচের মতো স্বচ্ছ। হাড় ছাড়া কিছু গরুর গোশত, গোশতের সমান পেঁয়াজ, তাজা আদা ও রসুন এবং পরিমাণমতো তেল।
বাসায় গরুর গোশত আছে, সেটা হাড়াক্রান্ত হওয়ায় তাতে কাজ হবে না। তুষারপাতে ডুবে আছে নিউইয়র্ক। এই কনকনে ঠান্ডায় বাজারে যেতেও ইচ্ছে করছে না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, বরফের নিচ থেকে গাড়ি বের করতে হবে। এটি যথেষ্টই কঠিন কাজ। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে যখন কসোভোতে ছিলাম, ত্রিশের ঘরে বয়স, তারুণ্যের উত্তেজনায় শাবল মেরে জমে থাকা আইস সাফ করে গাড়ি বের করে ফেলতে সময় লাগত না। এখন ধূমায়িত চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জানালার পাশে বসে তুষারপাতের সৌন্দর্য দেখতেই ভালো লাগে, ঘর থেকে বের হতে ইচ্ছে করে না। এবার মুক্তি, নভো এবং ব্রিজিত ওয়াকওয়ের তুষার সাফ করেছে। তুষারপাতের পর একদল তরুণ ছেলে-ছোকড়া শাবল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ৪০-৫০ ডলায় ধরিয়ে দিলেই সাফ করে দেয়। এবারো ওরা এসে ডোরবেল বাজিয়েছে কিন্তু মুক্তি নিষেধ করে দিয়েছে। তুষার সাফ করার ‘ফান’ মিস করতে চায় না। আমি বলে দিয়েছি, এই ফানের মধ্যে আমি নেই।
বাজারে যাওয়ার জন্য আমাদের বেশ কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হলো এবং শেষ পর্যন্ত আমেরিকান মিটশপ থেকে গরুর গোশত কিনতে হলো।
এবার ঠিক করেছি, এই রান্না রান্না খেলাটিকে আরো খানিকটা শিক্ষামূলক করে তুলব। সবাইকে বলে দিয়েছি, গুগলে খোঁজ-খবর করো, সামোয়া আইল্যান্ডের ওপর পড়াশোনা করো। সাপাসুই খেতে খেতে সবাই পাঁচ/দশ মিনিট করে এই দ্বীপ দেশটি সম্পর্কে বক্তব্য রাখবে। নভো খুব উৎসাহ পেল এতে। ২৫ ডিসেম্বর, ক্রিসমাসের দিন রান্নাটা চড়িয়েছি। ব্রিজিত চলে গেছে নিউ জার্সিতে পরিবারের সাথে ক্রিসমাস পালন করতে, বিকেলে অগ্নিও গেছে। বাসায় আমরা চারজন, ওরা চলে যাওয়ায় বাসাটা কেমন খালি খালি লাগছে। খালি বাড়িতেই সাপাসুই রান্না হচ্ছে। মুক্তি পড়াশোনার কথা শুনে তেমন খুশি না হলেও নভো ইন্টারনেট থেকে তথ্য বের করে পরীক্ষার প্রস্তুতির মতো খাতায় নোট নিচ্ছে।
সুপ্রাচীনকালে সামোয়ার লোকেরা উমুতে রান্না করত। উমু হচ্ছে মাটির মধ্যে গর্ত করে গাছের শুকনো ডালপালা দিয়ে আগুন ধরানো চুলা। ওদের আদি ভাষা গাগানা থেকে উমু শব্দটি এসেছে। সামোয়ার প্রাচীন নাম ছিল মতু ও সামোয়া। সাড়ে তিন হাজার বছরের স্বাধীন দ্বীপবাসী ১৮ শতকে হঠাৎ দেখা পায় সমুদ্র থেকে ভেসে আসা শ্বেত বর্ণের অদ্ভুত একদল মানুষের। পালাক্রমে ডাচ, ইংরেজ, জার্মান এবং মার্কিনিরা এসে নামে সামোয়া দ্বীপে। ১৯ শতকে আমেরিকা এবং জার্মানি সামোয়াকে দু’ভাগ করে নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। পুরো সামোয়ার আয়তন ৩,০৩০ বর্গকিলোমিটার, যার বৃহৎ অংশ, ২,৮৩১ বর্গকিলোমিটারের দখল নেয় জার্মানি এবং পূর্বাংশের, যার আয়তন ১৯৯ বর্গকিলোমিটার, দখলে নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। জার্মান অংশের রাজধানী আপিয়া, আমেরিকান অংশের রাজধানী পাগো পাগো।
দুই সামোয়াই অনেকগুলো দ্বীপের সমষ্টি। পশ্চিম সামোয়ার দ্বীপগুলোর মধ্যে উপোলু, সাভাই, মেনোনো, এপোলিমা, ফানুয়াতাপু, নামুয়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। পূর্ব সামোয়ার উল্লেখযোগ্য দ্বীপের নাম তুতুইলা, আনু, তাউ, পোলা প্রভৃতি। পূর্ব সামোয়া বা মার্কিন টেরিটোরির তাউ দ্বীপের লতা পর্বতের উচ্চতা ৩,১৬৯ ফুট যা এই অংশের সর্বোচ্চ চূড়া। জার্মান সামোয়ার সর্বোচ্চ পর্বতচূড়া সাভাই দ্বীপে অবস্থিত, উচ্চতা ৬,০৯৬ ফুট।
প্রথম মহাযুদ্ধে পরাজয়ের পর সামোয়া দ্বীপ জার্মানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জের নির্দেশে দ্বীপের দখল নেয় নিউজিল্যান্ড, ১৯১৪ সালের ২৯ আগস্ট। নিউজিল্যান্ডের সাথে নেটিভদের সম্পর্ক সব সময়ই খারাপ ছিল। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৬২ সালের ১ জুন পশ্চিম সামোয়া স্বাধীনতা লাভ করে। পূর্ব সামোয়া এখনো আমেরিকার টেরিটোরি। দুঃখজনক হচ্ছে আমেরিকান টেরিটোরি হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব সামোয়ানদের আমেরিকায় যেতে ভিসা লাগে। পূর্ব সামোয়ানদের বলা হয় ‘আমেরিকান উইদাউট সিটিজেনশিপ’।
স্বাধীন সামোয়ার বর্তমান লোকসংখ্যা দুই লাখ এবং আমেরিকান সামোয়ার ৫৬ হাজার। স্বাধীন সামোয়াতে ওদের নিজস্ব মুদ্রা তালা প্রচলিত, মার্কিন সামোয়াতে লেনদেন হয় ডলারে। আমেরিকানরা নিজের দায় এড়াতে দাবি করে, সামোয়ানদের ভোটিং রাইট বা নাগরিকত্ব না দেবার মূল কারণ হলো সামোয়ানরা চায় না ওদের সংস্কৃতি হাওয়াইয়ানদের মতো আমেরিকানাইজ হয়ে যাক। খুবই খোঁড়া যুক্তি।
হাড় ছাড়া গরুর গোশত পাতলা পাতলা করে কেটে একটি পাত্রে সামান্য পানি দিয়ে সেদ্ধ করে নিলাম। অন্য একটি পাত্রে গ্লাস নুডুলস সেদ্ধ করে কাঁচি দিয়ে কেটে একটু ছোটো করে নিলাম। গোশতের পানি নিঙড়ে নিয়ে সয়া সস ঢেলে দিয়ে চড়িয়ে দিলাম। এরপর পেঁয়াজ কুঁচি, আদাকুঁচি ও রসুনকুঁচি ঢেলে দিয়ে কিছুক্ষণ গোশতটা রান্না করে নিই। গোশত সেদ্ধ হয়ে এলে নুডুলস ঢেলে দিয়ে আরো খানিকটা সয়া সস ঢেলে দিই। সাপাসুই রান্না করতে সয়া সস একটু বেশিই দিতে হয় এবং আঁঠাল সয়া সসটা ব্যবহার করতে হয়।
এবার পরিমাণ মতো পানি ঢেলে নাড়াতে হবে যাতে তলায় লেগে না যায়। এভাবে ত্রিশ মিনিট রান্না করলেই তৈরি হয়ে যাবে সাপাসুই।
টেবিলে সাপাসুই রেখে আমরা সামোয়া আইল্যান্ড নিয়ে আলোচনা শুরু করি। নভো জানায়, ওদের প্রধান খাবার হচ্ছে মাছ এবং মজার ব্যাপার হলো ওরা কাঁচা মাছ খায়। কাঁচা মাছ খাওয়ার বিষয়টি নভোর একদমই পছন্দ হচ্ছে না। ভেবেছিলাম মুক্তি কিছুই বলতে পারবে না; কিন্তু গোপনে গোপনে সে যে এতখানি পড়াশোনা করে নিয়েছে ভাবতেও পারিনি। মুক্তির আলোচনায় মার্কিন সামোয়ানদের দেশহীন, নাগরিকত্বহীন জীবনের কষ্টই বেশি ফুটে ওঠে। ওদের পাসপোর্ট আছে; কিন্তু কোনো দেশ নেই।
সামোয়ানদের প্রথাগত নাচের নাম অগ্নিনৃত্য। মাথায়, হাতে, পায়ে আগুনের বৃত্ত তৈরি করে বিশেষ দিবসগুলোতে ঢোলের তালে তালে নাচ করে।
সাপাসুই খেতে তেমন ভালো হয়নি। জল একদমই পছন্দ করেনি। সয়া সসের নোনতা স্বাদ বাঙালি জিহ্বা তেমন গ্রহণ করল না। ঠিক করেছি এরপর আমরা আরো বুঝে-শুনে খাবার নির্বাচন করব।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ২৮ ডিসেম্বর ২০২০