আধুনিক তুরস্কের কয়েকটি চমৎকার ওসমানিয়া রীতি
আধুনিক তুরস্কের কয়েকটি চমৎকার ওসমানিয়া রীতি - ছবি : সংগৃহীত
তুর্কিরা এক মহান জাতি। তুর্কিদের সমাজব্যবস্থা ও শাসনব্যবস্থার ভিত বহু পুরনো। ওসমানিয়া সালতানাতের সময় মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বেশির ভাগ মুসলিম দেশ ও উপমহাদেশের মুসলিমদের মধ্যে রয়েছে তুর্কিদের আলাদা এক সম্মান। আজকের তুর্কিরাও তাদের এই অতীত সম্পর্কে অবগত এবং তারা তাদের এই সোনালি অতীত নিয়ে গর্ববোধ করে। শুধু গর্ববোধেই আজো তারা কাজ করছে যাতে তারা তাদের হারানো অবস্থান ও গৌরব ফিরে পায়, যে অবস্থান ও গৌরব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে তাদের কাছে ছিলো। অর্থাৎ তুর্কিরা মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দিতে চায় আবারো। তুর্কিরা তাদের এই লক্ষ্য অর্জনে অনেকটা সফলও হয়েছে। গত এক দশকে তুরস্ক রজব তৈয়ব এরদোগানের নেতৃত্বে অর্থনীতি ও সামরিক খাতে সফলতার এমন কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে যার ফলে আবারো পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দেশের তালিকায় তুরস্ক অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আধুনিক তুরস্কে আজো অনেক ওসমানিয়া রীতিনীতি রয়েছে যা তুর্কিরা প্রতিদিন পালন করে থাকে। আধুনিক তুরস্কে ওসমানিয়া রীতিনীতির নানা কথায় এ সম্পর্কে জানা যাক।
আধুনিক তুরস্কে আজো চালু থাকা ওসমানিয়া রীতিনীতির মধ্যে প্রথম হলো বংশীয় বা পারিবারিক প্রথা। প্রত্যেক তুর্কির জীবনের ওপর তা অনেক প্রভাব বিস্তার করে। তুর্কিরা একটি শক্তিশালী পারিবারিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে। পশ্চিমাদের মতো পারিবারিক ব্যবস্থাবিহীন একা একা বসবাস করার ওপর বিশ্বাস করে না৷ প্রত্যেক ব্যক্তির আচার-আচরণ তার পরিবারের আচার-আচরণে বিবেচনা করা হয়। পরিবারের কোনো ব্যক্তি বিপদে পড়লে কিংবা পরিবার বিপদে পড়লে ওই পরিবারের অন্যান্য সদস্য পরিবারের সাথেই সংযুক্ত থাকে। পরিবারের ভালো বা খারাপ সব সময়ই পরিবারের সদস্যরা বাকি সদস্যদের সাথে থাকে। ২০১৮ সালের একটি সার্ভে বা জরিপ অনুযায়ী ৬৮ শতাংশ তুর্কি নাগরিক পরিবারব্যবস্থাকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ৯০ শতাংশ তুর্কি নাগরিক পরিবারব্যবস্থাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে থাকে।
দ্বিতীয় ওসমানী রীতি হলো বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান। তুর্কিরা বয়োজ্যেষ্ঠ বা বয়সে বড়দের অনেক সম্মান করে থাকে। তুরস্কের রাস্তায় বয়োজ্যেষ্ঠদের আগে কম বয়সীদের চলে যাওয়াকে অসম্মানের মনে করে হয়ে থাকে। সাধারণত কম বয়স্করা রাস্তায় তখনি বয়োজ্যেষ্ঠদের চেয়ে এগিয়ে চলে যখন বয়োজ্যেষ্ঠরা তা করার অনুমতি দেয়। তুর্কিরা দাঁড়িয়ে খাওয়া পছন্দ করে না। তুর্কিরা বসে খাবার খায় আর সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ বিসমিল্লাহ পড়ে খাওয়া শুরু করলে তারপর বাকিরা বিসমিল্লাহ বলে খাবার শুরু করে থাকে। তুর্কিরা খাবার শেষে সূরা ফাতিহা পাঠ করে থাকে।
তৃতীয় ওসমানী রীতি হলো ফুলের ব্যবহার। তুরস্কে কোনো বাড়ির সামনে হলুদ রঙের ফুল থাকার মানে হলো এই বাড়িতে কেউ অসুস্থ। তাই এই বাড়ির পাশ দিয়ে কেউ যাওয়ার সময় কেউ যেন কোনো শব্দ না করে। তুরস্কে কোনো বাড়ির সামনে লাল রঙের ফুল থাকার মানে হলো এই বাড়িতে বিবাহ উপযুক্ত মেয়ে আছে। তাই কেউ এই বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার কথাবার্তায় যেন খেয়াল রাখে। যাতে করে কোনো অশ্লীল বা অসম্মানজনক কথা মুখ থেকে বেরিয়ে না যায়। এছাড়া তুরস্কে বিভিন্ন রঙের ফুল বিভিন্ন জিনিস বোঝাতে ব্যবহার করা হয়।
চতুর্থ ওসমানী রীতি হলো নতুন বসতি স্থাপন। তুর্কিদের মধ্যে ওসমানিয়া খিলাফাতের আমল থেকে নতুন বসতি বা শহর তৈরীর সময় সবার আগে মসজিদ নির্মাণের রীতি রয়েছে। মসজিদ নির্মাণের পর মসজিদকে কেন্দ্রকরে বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়। এতে করে মসজিদ ওই বসতি বা শহরের কেন্দ্রের ভূমিকা পালন করে। এছাড়া উপমহাদেশের অনেক শহরেও তুর্কিদের এই রীতি অনুসরণ করতে দেখা যায়।
পঞ্চম ওসমানী রীতি হলো তুর্কি মুসলিমদের তাদের রবের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ। তুর্কি মুসলিমরা তাদের নতুন ঘর নির্মাণের পর তাদের ঘরের সামনে 'মালিকুল মূলক' লিখিয়ে থাকেন। এ কথা দিয়ে তুর্কি মুসলিমরা বোঝান যে তাদের কোনো কিছুর মালিকানা নেই। সকল কিছুর মালিক আল্লাহতা'লা।
ষষ্ঠ ওসমানী রীতি হলো দরজায় কড়া নাড়া। তুর্কি মুসলিমরা দরজায় কাড়া নাড়ার জন্য দুটি আলাদা আংটা ব্যবহার করে। যদি কোনো পুরুষ কোনো বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে তাহলে সে বড় আংটা ব্যবহার করে। ফলে বেশি শব্দ হয় এবং বাড়ির ভিতর থেকে কোনো পুরুষ এসে দরজা খুলে। কোনো নারী কোনো বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ার সময় ছোট আংটা ব্যবহার করে। ফলে শব্দ কম হয় এবং বাড়ির ভিতর থেকে কোনো নারীই এসে দরজা খুলে। এতে করে পর্দার খেলাপ হয় না।
সপ্তম ওসমানী রীতি হলো নিজেদের ধর্ম, ভাষা ও জাতিকে ভালোবাসা। তুর্কি মুসলিমরা তাদের ধর্ম ইসলামকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। তুর্কিরা তাদের ভাষা ও জাতিকেও প্রচণ্ড ভালোবাসে। একটি সার্ভে বা জরিপ মোতবেক আজো ৮০ ভাগ তুর্কি ওসমানিনয়া খিলাফাত নিয়ে গর্ববোধ করে। ৮৭ ভাগ তুর্কি তুরস্কের নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট নিয়ে গর্ববোধ করে। ৫৭ ভাগ তুর্কি তুরস্কে জন্ম নেওয়ার জন্য সম্মানিত বোধ করে। প্রায় এক শতাব্দী সেকুলার শাসনে থাকার পর আজো তুরস্কের ৯১ ভাগ নাগরিক ইসলাম ধর্মকে সবক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং ৬৭ ভাগ নাগরিক মুসলিম হওয়াকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে থাকে৷
অষ্টম ওসমানিয়া রীতি হলো সেনাবাহিনীকে ভালোবাসা। তুর্কিরা যোদ্ধা জাতি। গত প্রায় এক শ' বছর ধরে তুরস্কের সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিতর্কিত ভূমিকা সত্ত্বেও ৯০ ভাগ তুর্কি নাগরিক সেনাবাহিনীকে ভালোবাসে। আর ৬০ ভাগ তুর্কি নাগরিক সেনাবাহিনীকে ভালোবাসা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এই সার্ভে ২০১৬ সালের ব্যর্থ সেনা অভূত্থানের পর করা হয়েছিলো।
নবম ওসমানিয়া রীতি হলো মেহমানদারী। তুর্কিরা অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ হয়ে থাকে। তুর্কিদের বাড়িতে কোনো মেহমান এলে তুর্কিরা তাঁকে টার্কিশ চা ও পানি খেতে দেয়। যদি মেহমান আগে পানি খায় তাহলে মেহমান ক্ষুধার্ত তা বোঝায়। আর তারা মেহমানের খাবারের ব্যবস্থা করে। আর যদি মেহমান চা আগে খায় তাহলে মেহমান খাবার খাবে না তা বোঝায়। তুর্কিদের বাড়িতে মেহমান এসে খাবার না খেলে তুর্কিরা তা নিজেদের জন্য অসম্মানের মনে করে থাকে। খাবারের পর মেহমানের জন্য ফল ও টার্কিশ চা পরিবেশন করা হয়। সাধারণত মেহমান জুতা খুলে ঘরে প্রবেশ করে। তাই তুর্কিরা মেহমানের জন্য ঘরের ভিতরে ঢোকার আগেই পরিষ্কার জুতা সরবরাহ করে থাকে। মেহমান খাবার খেয়ে দ্রুত বিদায় নেয়াকে তুর্কিরা অপছন্দ করে। মেহমানের খাবার খেয়ে দেরি করে বিদায় নেয়াকে তুর্কিরা পছন্দ করে।
দশম ওসমানিয়া রীতি হলো পাখির যত্ন নেয়া। তুর্কিরা ঐতিহাসিকভাবে পাখির যত্ন নিয়ে থাকে। কোনো অতিথি পাখি যদি তার দল থেকে আলাদা হয়ে যায় বা আহত হয় তাহলে তুর্কিরা তার যত্ন ও চিকিৎসা করে। এজন্য বিভিন্ন তুর্কি সংগঠনও আছে। শীতকালে যেসব এলাকায় তুষারপাতের ফলে মাটি বরফের চাদরে ঢেকে যায় সেসব এলাকায় তুর্কিরা বরফের ওপর পাখির খাবার ছড়িয়ে দেয়। যাতে পাখিরা খাবার খেতে পারে।
এগারতম ওসমানী রীতি হলো প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক। তুরস্কে কোনো বাড়ির কোনো মানুষ মারা গেলে ওই বাড়ির আশপাশের মানুষ ওই বাড়ির মানুষদের জন্য কয়েক দিন খাবার সরবরাহ করে। শোকগ্রস্ত বাড়ির পাশে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দকে তুর্কিরা অপছন্দ করে। শোকগ্রস্ত বাড়ির মানুষদের তাদের প্রতিবেশীরা বোঝানোর চেষ্টা করে যে আপনারা একা নন আমরাও শোকগ্রস্ত। এছাড়া তুর্কিরা প্রতিবেশীদের সাথে দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র আদান প্রদান করে থাকে।
বারোতম ওসমানিয়া রীতি হলো কোনো ব্যক্তি সফরে যাওয়ার সময় পিছনে পানি ছিটানো। এটা দিয়ে সফরকারী ব্যক্তিকে বলা হয় ভালোভাবে যাও, ভালোভাবে ফিরে এসো।
তেরতম ওসমানী রীতি হলো তুর্কি ভাষা লেখার পদ্বতি। তুর্কিরা তাদের ভাষাকে খুব ভালোবাসে আর গর্বের সাথে এই ভাষায় কথাও বলে। ১৯২৮ সাল পর্যন্ত তুর্কি ভাষা যাকে ওসমানিয়া তুর্কিও বলা হতো। তা আরবি ও ফারসি অক্ষরে লেখা হতো। ওসমানিয়া সালতানাতের সমৃদ্ধির সময়ে ওসমানিয়া তুর্কি ভাষার ৮৮ শতাংশ শব্দ আরবি ও ফারসি ভাষার ছিলো। এই শব্দগুলো ১৪ শতক থেকে ২০ শতকের মধ্যে তুর্কি ভাষায় এসেছিলো। ওসমানিয়া তুর্কি ভাষা আদি তুর্কিভাষী তুর্কি সহজে বুঝতে পারত না। আদি তুর্কি ভাষা ল্যাতিন অক্ষরে লেখা হতো। আদি তুর্কি ভাষায় আরবি ও ফারসি শব্দ খুব কম ছিলো। এরপর ১৯২৯ সালে কামাল আতাতুর্ক ল্যাতিন ভাষায় লেখা তুর্কিকে তুরস্কের সরকারি ভাষা ঘোষণা করেন। আরবি ও ফারসি ভাষায় তুর্কি লেখা নিষিদ্ধ করেন। এটি মূলত কামাল আতাতুর্কের ইসলাম ও আরবদের প্রতি বিদ্বেষের কারণে হয়েছিল। যদিও বলা হয়ে থাকে যে তুর্কি ভাষা সঠিকভাবে বলতে ও লিখতে এই নিয়ম জারি করা হয়। প্রায় ১০০ বছর পর আবারও তুরস্কে ওসমানী তুর্কী ভাষা আরবি ও ফারসিতে লেখার চল শুরু হয়েছে।
উপরোক্ত ওসমানী রীতি তুরস্কের সব জায়গায় সমানভাবে দেখা না গেলেও সবগুলো রীতিই তুরস্কে এখনো চলমান রয়েছে। এই ছিলো আধুনিক তুরস্কে ওসমানিয়া রীতিনীতির নানা কথা।
তথ্যসূত্র : Turkish Traditions From Ottoman Era
- BS
istanbultrails.com
propertyturkey.com
americanprogress.com
kayifamily.com
en.wikipedia.org
allaboutturkey.com
7 Unique Ottoman Traditions | CCT
Investments
লেখক : প্রাক্তন শিক্ষার্থী, আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক