দুশ্চিন্তার বড় কারণ ‘গঙ্গা দূষণ’
দুশ্চিন্তার বড় কারণ ‘গঙ্গা দূষণ’ - ছবি : সংগৃহীত
হিমালয়ের ভাটির দেশগুলোর জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে গঙ্গা নদীর পানি-দূষণ। ‘পবিত্র’ আখ্যা পাওয়া এই গঙ্গা এখন মানুষের আচরণের কারণেই আর ‘পবিত্র’ থাকতে পারছে না। এই দূষণজনিত অবস্থা থেকে উত্তরণে নানা প্রকল্প নেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। কেননা, প্রকল্পের প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার চেয়ে দূষণের প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার মাত্রা অনেক বেশি।
এই দূষণের প্রতিক্রিয়ার শিকার যে কেবল গঙ্গাপাড়ের মানুষেরাই হচ্ছে তা নয়। পদ্মা ও তার শাখা-প্রশাখাগুলোতেও এর প্রতিক্রিয়া বিস্তৃত হচ্ছে। তার মানে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সরাসরি এই দূষণ-প্রক্রিয়ার আওতায়।
এই দূষণের জন্য প্রাথমিকভাবে যে সব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে, কল-কারখানার বর্জ্য নিক্ষেপ, বাঁধ দিয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা, নদীতে সরাসরি ময়লা-আবর্জনার ডাম্পিং, মৃতদেহ পোড়ানোর শ্মশান, পূজার বিসর্জন প্রভৃতি। এই দূষণের কারণে গঙ্গার পানিও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এ নিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি সচেতন মহলে বিস্তর মত-অভিমত প্রকাশ করেও এর রাশ টানা যাচ্ছে না। এসবের জের টানতে হচ্ছে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীকেও।
তথ্যে দেখা যায়, ভারতের সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড এবং বায়ো কেমিক্যাল অক্সিজেন ডিমান্ড বা বিওডি এই মর্মে রিপোর্ট দিয়েছে যে, বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েও গঙ্গা দূষণ তো কমেইনি, উল্টো দিনের পর দিন তা বেড়েই চলেছে। শুধু তাই নয়, গঙ্গার পানি বেশ কিছু জায়গায় ঘর সংসারের কাজ ও সেচের কাজে ব্যবহারেরও অযোগ্য হয়ে পড়েছে। দূষণের মাত্রা এতটাই বেড়ে গেছে যে, নদীতে বেশ কিছু ক্ষতিকারক ব্যাকটিরিয়ার সন্ধান মিলেছে।
পলি পরিবহনে ভাটা
গঙ্গা গোমুখ থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত ২৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ধারাতেই কেবল সীমাবদ্ধ নয়। বরং বহু উপনদীর প্রবাহে পুষ্ট হয়ে এটি তার অববাহিকার অন্তত ৬০ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার লালন পোষণকারী। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, গঙ্গাপথে বছরে ৫২৫ ঘনকিলোমিটার পানি বয়ে আসে। এর সঙ্গে আসে প্রায় ৫০ থেকে ৮০ কোটি টন পলি। তবে উজানে মূল গঙ্গা ও তার উপনদীগুলিতে বহুসংখ্যক জলাধার নির্মাণের ফলে ভাটির দিকে বয়ে আসা পলির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। ভারতের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির দেয়া রিপোর্টে (২০১৫) বলা হয়েছে, ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে ফারাক্কায় বার্ষিক ভাসমান পলির পরিমাণ ছিল গড়ে মাত্র ১৭.৭০ কোটি টন। এই নদী হলো পানি ও পলির এমন এক প্রবহমান ধারা, যা একই সঙ্গে কৃষি ও নানা ধরণের জীববৈচিত্র্যকে লালন পালন করে। গঙ্গার অববাহিকায় ভূগর্ভ থেকে প্রায় ১৭০ ঘনকিলোমিটার পানি সেচ ও গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
যেসব কারণে দূষণ
গঙ্গার দূষণ যেসব কারণে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে তার মধ্যে রয়েছে, নদীর ঘাটে ঘাটে আবর্জনার স্তূপ, ভাসমান কঠিন বর্জ্য, সরাসরি গঙ্গাকেই ডাস্টবিনের মতো ব্যবহার, শহরের নালা থেকে উপচে পড়া ময়লা পানির স্রোত, জালিবিহীন নালা-নর্দমার মুখ, পূজার সময় দেব-দেবীর মূর্তি বিসর্জন, পোড়ানো মৃতদেহের ভস্ম নিক্ষেপ, মানুষের মল-মূত্র সরাসরি নদীতে পড়া, কাপড় কাচা ও রান্নার বাসনকোসন ধোয়া, গবাদিপশু ধোয়ানো, শিল্প-কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও অসংখ্য বাঁধ ও পিলারের সেতু নির্মাণ করে স্রোত বাধাগ্রস্ত করায় পানি দূষিত হচ্ছে। নদীর প্রায় ৮৫ শতাংশ দূষণের কারণ হচ্ছে এই মনুষ্যসৃষ্ট বর্জ্য। দূষণ সৃষ্টিকারী বাকি বর্জ্য আসে কারখানার শিল্প বর্জ্য, কৃষিতে ব্যবহৃত সার, অন্যান্য কঠিন বর্জ্য, মানব শরীর এবং মৃত পশুপাখির দেহ থেকে। ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুর, প্রয়াগরাজ, বারাণসী এবং বিহারের পাটনায় অসংখ্য ট্যানারির বর্জ্য, কানপুর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত ৬ লাখ মেট্রিক টন কয়লা এবং তার থেকে তৈরি ২ লাখ ১০ হাজার টন ফ্লাইঅ্যাশ প্রভৃতি গঙ্গার পানিতে এসে পড়ছে। এছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যে রয়েছে হাজার হাজার ইটভাটার ছাই। এসব কারণে গঙ্গা মূলত একটি বিশাল ভাগাড় বা আঁস্তাকুড়ে পরিণত হয়েছে।
এক কলকাতার তথ্যেই দেখা যায়, এখানে জঞ্জাল ফেলার জন্য আটটি ডাম্পিং সেন্টার রয়েছে গঙ্গার ঘাটগুলিতে। এর মধ্যে পাঁচটির অর্থাৎ ৬৩ শতাংশ কঠিন বর্জ্য ঘাটের পাশ দিয়ে যাওয়া গঙ্গার পানিতে ভাসতে দেখা যায়। কলকাতা থেকে ভাগীরথী-হুগলির উজানে গেলে দেখা যাবে সেখানে নদীর তীরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কলা বাগান, ইটের ভাটা আর কয়লা-বিদ্যুত প্রকল্প। এসব প্রকল্প থেকে প্রচুর বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র জানান, রাজ্যের কয়েক শ' শহর থেকে প্রতিদিন প্রায় সাত বিলিয়ন টনেরও বেশি অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি চলে যাচ্ছে গঙ্গায়।
এ রাজ্যে গঙ্গায় দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে। শুশুক থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এমনকি ইলিশের সংখ্যাও দিন দিন কমছে এই দূষণের জেরে। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ন্যাশনাল মিশন ফর ক্লিন গঙ্গা’ প্রকল্পের রিপোর্টেও বলা হয়েছে, মারাত্মক ক্ষতিকারক কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া মিশছে গঙ্গায়। গঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমছে। প্রতি লিটারে পাঁচ মিলিগ্রাম দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকলে তা স্বাভাবিক। কিন্তু রিপোর্টে বলা হয়েছে, বারাণসী থেকে বাংলা- বিভিন্ন জায়গাতেই এই দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে কম। আর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বহরমপুর, নবদ্বীপ, পলতা, দক্ষিণেশ্বর, গার্ডেনরিচ প্রভৃতির সর্বত্রই গঙ্গার পানিতে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া মাত্রাতিরিক্ত।
বাস্তব অবস্থা আরো ভয়াবহ
হিমালয় থেকে উৎসারিত হয়ে প্রায় দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবশে করে বিশ্বের সবচেয়ে জনাকীর্ণ অববাহিকার এই নদী। চলার পথে প্রায় অর্ধ বিলিয়ন মানুষের বর্জ্য নিজ বক্ষে ধারণ করে গঙ্গা। ভারতের কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের (সিপিসিবি) মতে, এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্যরে মাত্র ১০ শতাংশ পরিশোধন করা সম্ভব হয়। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গায় প্রতি ১০০ এমএল পানিতে ব্যাকটেরিয়ার (গাদ কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া) পরিমাণ এক কোটি ৬০ হাজার। অর্থাৎ নদীতে মানুষের মলের উপস্থিতির মাত্রা অত্যন্ত উচ্চ। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে এই জাতীয় ব্যাকটেরিয়ার সর্বোচ্চ নিরাপদ মাত্রা প্রতি ১০০ এমএল পানিতে ১০০০)। এর অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে। সিপিসিবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পুরো গঙ্গা জুড়েই এই ধরনের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। এমনকি হৃষিকেশ ও হরিদ্বারের মতো হিন্দু তীর্থস্থানগুলিতেও এই ধরনের জীবাণু পাওয়া যাচ্ছে। অথচ ধরে নেয়া হয় যে, এসব জায়গায় গঙ্গার পানি অন্যান্য স্থানের চেয়েও বিশুদ্ধ।
পর্যাপ্ত প্রবাহের অভাব
নদীদূষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এই নদীতে এখন পানিপ্রবাহ অত্যন্ত ক্ষীণ। পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের মতে, গঙ্গা কানপুরে পৌঁছার আগেই ৯০ শতাংশেরও বেশি পানি কৃষি জমিতে সেচের জন্য অপসারণ করে নেয়া হয়। ফলে যে সমস্যাটি হয় তা হচ্ছে আরো নি¤œাঞ্চলে দূষণ বা অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থ অপসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া নদীর উজানে পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাঁধ নির্মাণ করে এই স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করা হচ্ছে। বিস্তীর্ণ ভূ-ভাগের প্রাণদায়িনী এই নদীর দু’পাড়ে ২৩টি বৃহদাকার শহর গড়ে উঠেছে। ৪৮টি মাঝারি শহরও রয়েছে। রয়েছে অসংখ্য গ্রাম-জনপদ। আড়াই হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর যত্রতত্র বাঁধ নির্মাণ করে এবং পিলার দিয়ে সেতু নির্মাণের ফলে স্বাভাবিক প্রবাহও দিন দিন অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে। গঙ্গার নিম্নধারা কানপুর, বিজনৌর, নারোরা, রুকনপুর, কানজাউলি, হাকানিপুর, ভোসাওয়ালি, শেখপুর, কোচকপুর, লামুই, চাওকা প্রভৃতি স্থানে ছোট-বড় তিনশ’ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে সেচকাজের জন্য। এর ফলে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে বদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এমতাবস্থায় পরিবেশকর্মীরা অনেকেই মনে করেন, পরিস্থিতির পরিবর্তনে গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই।
বিপুল স্বাস্থ্য ঝুঁকি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গঙ্গা নদী অববাহিকায় বসবাসকারী মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি অত্যন্ত নাজুক। কারণ বিপুল সংখ্যক মানুষ এই নদীর পানির উপরে নির্ভরশীল। যদিও প্রচলিত ধারণা যে গঙ্গার নিজস্ব একটি বিশুদ্ধীকরণ প্রক্রিয়া রয়েছে, তারপরেও দূষিত পানির মাধ্যমে মারাত্মক রোগের জীবাণু ছড়িয়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। ভারত এমন একটি দেশ যেখানে প্রতি বছর পাঁচ বছরের নিচে কয়েক লাখ শিশু কেবল ডায়রিয়ার মতো রোগে মারা যায়। এছাড়া পানিবাহিত অন্যান্য রোগেও এখানে হাজার হাজার মানুষ ভুগে থাকে। বলা হচ্ছে, দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে গঙ্গার ধারে বসবাসকারী মানুষের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ভারতের জাতীয় ক্যান্সার নিবন্ধন কর্মসূচির (এনসিআরপি) তথ্য অনুযায়ী উত্তর প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের প্লাবন ভূমি এবং বিহারে নদী অববাহিকার আশেপাশে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে পরিপাকতন্ত্র, কিডনি, লিভার, মূত্রনালী ও চর্ম ক্যান্সারের প্রবণতা বেশি। দিল্লিতে নারীদের মধ্যে পরিপাকতন্ত্রের ক্যান্সারের প্রবণতা সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
পরিস্থিতির উন্নতি নেই
দিল্লিতে কংগ্রেস সরকারের আমলে গঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণে কিছু প্রকল্প নেয়া হয়। নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার পর গঙ্গার দূষণ ঠেকাতে আরও বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এই প্রকল্পে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় চার হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ছিল, গঙ্গা দূষণ রোধ করার পাশাপাশি শহরের নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিল্পক্ষেত্রে দূষণ কমানো, গ্রামীণ অঞ্চলে শৌচালয় নির্মাণ, নদীর পাড়ের উন্নয়ন, নদীর পাড় ও ঘাটের সংস্কার, বৃক্ষ রোপণ এবং বায়োডাইভার্সিটি পরিকাঠামোর উন্নয়ন। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই এখনো পর্যন্ত ঠিকমত সম্পূর্ণ হয়নি।
অন্যদিকে বাংলাদেশে পদ্মার দূষণ পরিস্থিতি নিয়ে তেমন কোনও গবেষণা বা এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চিহ্নিত করতে কোনোপ্রকার কার্যক্রম দেখা যায় না। ফলে অদূর ভবিষ্যতে গঙ্গা-পদ্মার দূষণ-পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছাবে তা আন্দাজ করা যায় না। একদিন হয়তো প্রাণদায়িনী গঙ্গা-পদ্মা প্রাণঘাতী এক সরোবরে পরিণত হয়ে পড়বে।