যেভাবে তারকা শিক্ষক হয়ে গেলেন মুনজেরিন শহীদ
মুনজেরিন শহীদ - ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ শুরুর পর অনলাইনে দেশের ইংরেজি শিক্ষাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর অর্জনকারী মুনজেরিন শহীদ৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া এই শিক্ষার্থী এখন পড়ছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে৷
দেশের সর্ববৃহৎ অনলাইন শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম টেন মিনিটস স্কুলর মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান ও ইংরেজির শিক্ষক তিনি৷ তুমুল জনপ্রিয় হওয়া তার ইংরেজি ভিডিও লেকচারগুলো তৈরির কাজ তিনি শুরু করেছিলেন ২০২০ সালে করোনার কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর৷ তার মতে, লকডাউনের হতাশায় বন্ধুদের পরামর্শে তিনি ভিডিও তৈরি শুরু করেন৷
এরপর ইংরেজি ভাষা শিক্ষার উপর দুটি বই লেখেন৷ পিডিএফ সংস্করণ বাজারে আসার পর সেগুলোও পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে৷ এরপর বইমেলায় আসে প্রিন্টেড সংস্করণ, যা উঠে আসে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায়৷ এটা নিয়েই আলোচনা-সমালোচনা চলছে দেশের সামাজিক মাধ্যমে৷ নিজের উঠে আসা, ক্যারিয়ার, সাফল্য, আলোচনা-সমালোচনা নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন মুনজেরিন৷
ডয়চে ভেলে : অনেকের কাছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকা ইংরেজি শিক্ষক৷ কেমন লাগে?
মুনজেরিন শহীদ : নিজেকে তারকার চেয়ে আমি শিক্ষক হিসেবেই বেশি দেখি৷ আমি নিজেকে ভীষণ লাকি মনে করি যে, যেই কাজ করতে আমার এতো ভালো লাগে তা করতে গিয়ে আমি মানুষের এত প্রশংসা পেয়েছি৷ এটা বড় একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার৷ আমি সবার প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ৷ আশা করি সবাই আমাকে এভাবে সাপোর্ট করে যাবেন৷
ছোটবেলায় আসলে কী হতে চেয়েছিলেন?
একেক সময়ে একেক ধরনের এইম ইন লাইফ ছিল৷ অনেক ছোটবেলায় আমি ডাক্তার হতে চাইতাম৷ তারপর ডাক্তারদের মেডিকেলের গাইডবুক দেখে আমার মনে হয়, ডাক্তারি আমাকে দিয়ে হবে না৷ তারপর ভাবলাম, আর্কিটেকচার পড়বো৷ মাঝখানে অনেক দিন ধরে পাইলট হওয়ারও ইচ্ছা ছিল৷ এ রকম অনেক ধরনের ইচ্ছাই ছিল৷ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ইংলিশ পড়ে অনেক ভালো লেগেছে৷ ইংরেজি শিক্ষা নিয়ে কাজ করার সুযোগ হয়েছে টেন মিনিটস স্কুলে এসে৷ সবকিছু মিলিয়ে পরে ভাবলাম, শিক্ষকতা আমার জন্য অনেক ভালো৷
ইংরেজি সাহিত্যে কেন পড়তে এলেন?
ইংরেজি বিষয়টা আমার স্কুল থেকেই অনেক বেশি ভালো লাগতো৷ আমি স্কুলে থাকতে ইংরেজি পড়তে, গল্পের বই পড়তে, অন্যদেরকে ইংরেজি পড়াতে খুব বেশি পছন্দ করতাম৷ এ কারণেই ভাবলাম, এই বিষয়টা ইউনিভার্সিটিতে উঠে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত৷ কারণ আমি সবসময় চাইতাম, আমি এমন কিছু একটা পড়বো, যেটাতে আমি ভালো, যেটা আমি উপভোগ করি৷ সে কারণেই ইংরেজিটা বেছে নেয়া৷
ইংরেজি পড়ার সিদ্ধান্ত কখন নিলেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে একটা পছন্দের বিষয় নির্বাচন করতে হয়৷ এর আগেই আমি চিন্তা করেছিলাম, বিষয় নির্বাচনে হয়ত আমি ইংরেজিকে একেবারে উপরের দিকেই রাখবো৷ কারণ, আমার ইংরেজি পড়তে ভালো লাগতো৷ তাই এই বিষয়ে পড়লে হয়ত ভালো কিছু করতে পারবো৷
টেন মিনিটস স্কুলের সাথে কিভাবে যুক্ত হলেন?
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার সময় আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু টেন মিনিটস স্কুলে কাজ করতো৷ তাদের মাধ্যমে আমি টেন মিনিটস স্কুল সম্পর্কে জানতে পারি৷ তখন আমার লেখালেখি করার অনেক অভ্যাস ছিল৷ এ কারণে আমি ছোট ছোট এডুকেশনাল ব্লগ লিখে টেন মিনিটস স্কুলে কাজ করা শুরু করি৷ এরপর টেন মিনিট স্কুলের অন্যান্য কাজে শিফট করি৷ যেমন, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট, কুইজ ম্যানেজমেন্টে কাজ করি, সবশেষে এইচআরে (মানবসম্পদ বিভাগে) ঢুকি৷ এখনো আমি টেন মিনিটস স্কুলে এইচআর প্রধান হিসাবে কাজ করি৷ শেষপর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষার কাজটাও টেন মিনিটস স্কুলে করি৷
প্রথম কখন এভাবে অনলাইন স্কুল শিক্ষকতা করার কথা ভেবেছেন?
এটা গত বছর লকডাউনের শুরুতে৷ প্রথম যে লকডাউন আমাদের দেশে শুরু হয়, সেই লকডাউনের সময়ে ঘরে বসে ছিলাম৷ ঘরে বসে ভালো লাগছিল না৷ এ রকম অবস্থায় একটা হতাশা চলে আসছিল৷ এটা কাটানোর জন্য আমার অনেক বন্ধুরা সাজেস্ট করে যে, তুইতো অনেক দিন ধরে ইংলিশ পড়ছিস, এখন ইংলিশ ভিডিও বানিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারিস৷ ঘরে থাকতে থাকতে কারো সঙ্গে দেখা হচ্ছে না, অফিসে যাওয়া হচ্ছে না, সেই হতাশা থেকে আমার মনে হলো, ভিডিও করে যদি সবার সাথে আবার যোগাযোগ করা যায়, কানেক্ট করা যায়, তাহলে খুবই ভালো হয়৷ তখন থেকেই ভিডিও বানানো শুরু করা৷
লকডাউনে হঠাৎ করে ভিডিও বানানো শুরু৷ আর শুরু করেই বাজিমাৎ?
আমার জন্য এটা খুবই লাকি একটা ব্যাপার ছিল৷ কারণ আমি যেই প্রথম ভিডিওটা দেই, সেটা খুবই ইতিবাচকভাবে নেয় মানুষ৷ প্রথম ভিডিওটা এক থেকে দুই দিনের মধ্যে এক মিলিয়ন ভিউ হয়ে যায়৷ তখনই বুঝতে পারি, ইংরেজি শেখা ও শেখানোর বড় একটা চাহিদা মানুষের মাঝে আছে৷ তখন থেকেই আরো নিয়মিত ভিডিও দেয়া শুরু করি৷
এবারে আপনার দুটি বই এসেছে৷ দুটিই বেস্ট সেলিং হয়েছে৷ কখন এই বই লেখার কথা মাথায় এসেছে?
গত বছরের জুন, জুলাইয়ের দিকে আমরা অনলাইনে স্পোকেন ইংলিশের বই রিলিজ করি, যেটা অনলাইনে রিলিজের কিছুদিনের মধ্যেই বেস্ট সেলার হয়ে যায়৷ এই পরিমাণে কোনো দিনই একটা অনলাইন পিডিএফ বই মানুষ কখনো নেয়নি৷ আর সবার জন্য ভোকাবুলারি বইটি এ বছরের শুরুর দিকে আমরা ছাড়ি৷ দুটিই এই বছরের বইমেলাতে হার্ডকপি ভার্সন হিসাবে আসে৷
প্রথমে যখন বইটা লিখি, তখন দুই সপ্তাহের মধ্যে বইটা লিখে প্রকাশ করা হয়েছে৷ হার্ডকপি হিসাবে প্রকাশ করার আগে অনেকবারই বইটা সংস্করণ করা হয়েছে৷
যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন দুই তিনটা চাকরি একসাথে করতাম৷ টেন মিনিটস স্কুল তার মধ্যে একটা ছিল৷ আমি লেখক, শিক্ষিকা, আমি এইচআরে কাজ করছি, শিক্ষার্থী হিসাবে এখন অক্সফোর্ডে আছি৷ এটা ছাড়া আপাতত আর কিছু করছি না৷
কীভাবে সামলান?
অনেক ছোট থেকেই আমি অনেক ধরনের কাজে যুক্ত ছিলাম৷ যে কারণে অনেকগুলো কাজ করার অভ্যাসটা আমার অনেক ছোট থেকেই গড়ে উঠেছে৷ আমি যেমন স্কুলে ক্লাস নাইন, টেন থেকেই চাকরি করা শুরু করেছিলাম৷ তখন থেকেই আমার একটা বিষয় ছিল যে, কীভাবে স্কুলের রেজাল্ট ঠিক রেখে চাকরি করা যায়, সব কিছু একসাথে ব্যালেন্স করে কাজ করা যায়৷ এমন সময় খুব কমই থাকে যে, আমি কোনো একটা কাজ করছি না৷ কাজ ম্যানেজ করার স্কিলটা সবারই থাকা উচিত৷ এটা আমি স্কুল থেকেই চেষ্টা করতাম নিজের মধ্যে গড়ে তোলার৷
নাইন, টেনে থাকতে কী চাকরি করতেন?
নাইন, টেনে থাকতে আমি ইংরেজি অনেক ভালো পারতাম৷ যে টিচারের কাছে আমি ইংরেজি পড়তাম, তিনি টিচিং অ্যাসিস্টেন্ট হায়ার করতেন৷ দেখা যাচ্ছে, জুনিয়র ক্লাসের পেপার ওয়ার্ক কারেক্ট করে দিতাম৷ মাঝে মাঝে ওনার পরিবর্তে জুনিয়র ক্লাসে ক্লাস নিতেও যেতাম৷
আপনার বইটা বেস্ট সেলিং হলো৷ কিন্তু এই বইয়ের পাঠক কারা?
সবচেয়ে বেশি চাহিদা স্টুডেন্টদের মধ্যে৷ এরপর চাকুরিজীবী আছে, বা যারা চাকরিতে ঢুকবে৷ আরেকটা গ্রুপ এই বইটা গ্রহণ করে নিয়েছে, কারণ বইটা সহজ ভাষায় লেখা৷ সেটা হচ্ছে, যারা গৃহিণী বা একটু বয়স্ক, টুকটাক অবসর সময়ে ইংলিশ শিখতে চান৷ তাদের মধ্যে আমি অনেক ভালো একটা সাড়া দেখছি এই বইটার জন্য৷ এই তিনটা গ্রুপের মাঝে এই বইয়ের জন্য আমি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা দেখছি৷
কী পরিমাণ বিক্রি হলে একটা বই বেস্ট সেলিং হয়? আপনার বই কী পরিমাণ বিক্রি হয়েছে?
একটা বই বা বেস্ট সেলিং বই, গত বছর যে পরিমাণ বিক্রি হয়েছে, এই বছর সেই পরিমাণ বিক্রি নাও হতে পারে৷ এটা আসলে ডিপেন্ড করে৷ আমাদের বইটা বইমেলা চলাকালে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ৩০-৪০ হাজারের বেশি কপি বিক্রি হয়ে গেছে৷ এটা আমাদের স্পোকেন ইংলিশ বইয়ের কথা বলছি৷
পৃথিবীর দেশে দেশে গল্প, উপন্যাস, আত্মজীবনীর মতো বই বেস্ট সেলিং হয়৷ আমাদের দেশে ইংরেজি শেখার বই হয়েছে৷ এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আমি এটাকে আসলে অনেক ইতিবাচকভাবে দেখছি৷ আমার মনে হয় প্রত্যকটা দেশে, যখন আমরা বেস্ট সেলিং লিস্টটা দেখি, সেটা ওই নির্দিষ্ট দেশের দক্ষতার একটা বহিঃপ্রকাশ হয়৷ আপনি বিদেশের কথা বললেন, যেখানে গল্পের বই, উপন্যাস বা এই ধরনের বই বেস্ট সেলিং হয়, কারণ তাদের একটা স্ট্যান্ডার্ড মানের লিটারেসি অলরেডি আছে৷ তারা ওই লিটারেসি দিয়ে মন মতো চাকরি করতে পারছে৷ মন মতো জীবনযাপন করতে পারছে৷ ওই লিটারেসিটা তাদের হয়ে গেছে৷ আমাদের দেশের মানুষ ইংরেজি না পারার কারণে এখনো অনেক ধরনের সুযোগ মিস করে৷ অনেক ধরনের চাকরির সুযোগ তারা পায় না, বিদেশে যাওয়ার সুযোগ তারা পায় না৷ ওই স্কিল গ্যাপটা পূরণ করতে একটা ভোকাবুলারির বই বা একটা স্পোকেন ইংলিশের বই তাদেরকে সাহায্য করছে৷ ইংরেজি শিক্ষার যে একটা গ্যাপ আছে, এটা মানুষ বুঝতে পেরেছে৷
এটার সমালোচনাও অনেকে করেছে, এটাকে কীভাবে দেখছেন?
এটা আসলে যার যার মন্তব্য তার তার কাছে৷ সবারই নিজেদের মন্তব্য শেয়ার করার পূর্ণ স্বাধীনতা আছে৷ এটাকেও আমি অনেক গঠনমূলকভাবে নিচ্ছি৷ ইতিবাচকভাবে নেয়ার চেষ্টা করছি৷ আমাদের বইগুলো যে সৃজনশীল না-সেভাবে আমরা তৈরি করি নাই৷ অনেকগুলা ইলাস্ট্রেটরের সাথে, অনেক ডিজাইনারের সাথে খুব সম্পৃক্তভাবে কাজ করে এই বইগুলো তৈরি করা৷ এই বইগুলো অনেক ক্রিয়েটিভ হিসাবে মার্কেটে আনার চেষ্টা করেছি৷ যাতে এগুলো পুরোপুরি গাইড বুক হিসাবে দেখানো না হয়, ক্রিয়েটিভ বুক হিসাবেই দেখানো হয়৷ সব সময় এক ধরনের বই টপে থাকতো৷ এই বছর পারাডাইম শিফট হয়েছে৷ ভিন্ন হওয়ার কারণটাও স্কিল গ্যাপ৷ ক্রিয়েটিভ ও লার্নিংটাকে আমরা একত্রিত করতে পেরেছি৷ এই বইটার মধ্যে সৃজনশীলতাও আপনি পাবেন৷ শিক্ষার একটা উপাদানও আপনি পাবেন৷ দুটি মিলানোর কারণে যে নতুনত্ব এসেছে, আমার মনে হয়, এ কারণেই মানুষ এটাকে আরো ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে৷ আমি এটাকে অবশ্যই অনেক ইতিবাচকভাবে/ভালোভাবে নিচ্ছি৷
আপনার সাফল্যের ‘সিক্রেট' কী?
আমি গত বছরের এপ্রিলের দিকে ঠিক এই সময়টাতে ১৭-১৮ তারিখে আমার প্রথম ভিডিওটা দেই৷ এই যে পুরো এক বছরটা ছিল, এই সময়ে আমি ধারাবাহিকভাবে কাজ করে গিয়েছি৷ এই এক বছরে প্রায় প্রত্যেক দিন আমি নতুন কোনো একটা কন্টেন্ট দিয়েছি৷ এই ধারাবাহিকতা আমাকে অনেক বেশি সাহায্য করেছে৷ এই যে ধারাবাহিকতা, এই যে ডেডিকেশন দিয়ে কাজ করা, এটা খুবই ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে আমার জীবনে৷ একটা কাজের পেছনে লেগে থাকা৷ সব সময় হয়ত যেটা আশা করেছি, সেটা হয়নি৷ তাও লেগে থাকা৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে