মধ্যপ্রাচ্য সংকটে ইরান-ইসরাইলের ভূমিকা
মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র - ছবি : সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্য পৃথিবীর ঝামেলাপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই অঞ্চলে শান্তির পায়রা কবে উড়বে কেউ বলতে পারে না। বিশ শতকের শুরুতে মধ্যপ্রাচ্য প্রথমবারের মতো বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই অঞ্চলের সংকট মূলত কেন্দ্রীভূত ছিল ফিলিস্তিন তথা আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে ইসরাইলের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে। সময়ের ক্রমধারায় সেই কেন্দ্র বদলেছে মাত্র। এখন বলা হচ্ছে ইসরাইলের গোয়ার্তুমি, ইরানের আস্ফালন ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিচারিতা মধ্যপ্রাচ্যকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলবে।
পিছনের গল্প শুনি
বিখ্যাত নৌ স্ট্রাটেজিস্ট এডমিরাল মাহান ১৯০২ সালে মধ্যপ্রাচ্য শব্দটি ব্যবহার করেন। উসমানিয়া সাম্রাজ্যের শাসনাধীন এই অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, ধর্মীয় আনুগত্য ও বন্ধনকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে এই অঞ্চলের নাম দেন মধ্যপ্রাচ্য। একদিকে ইউরোপ, অন্যদিকে ভারতবর্ষ এর মাঝখানে মধ্যবর্তী অঞ্চল বিবেচনায় এই নামকরণ করা হয় বলে মনে করা হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে এই অঞ্চলে আরবদের মাঝে জাতীয়তাবাদী চিন্তার জাগরণে পশ্চিমা শক্তি মদদ জুগিয়েছিল। সেই সময় এখানে মাঠ কাঁপিয়েছে ফ্রান্স ও ব্রিটেন৷ ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর এদের সাথে যুক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্র। সাইকট পিকট চুক্তির আলোকে আরব অঞ্চল ভাগ-বাটোয়ার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন।
উসমানিয়া সাম্রাজ্যের প্রতাপকে বিলীন করে দিতে ফ্রান্স ও ব্রিটেনের কূটকৌশল অজানা কোনো বিষয় নয়। হাশেমীয় ও সৌদ- দুই গ্রুপকেই সহযোগিতা করেছে ফ্রান্স ও ব্রিটেন। দুই দলের সামনে মুলো ঝুলিয়ে তারা নিজেদের স্বার্থ আদায় করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী শক্তি ফ্রান্স ও ব্রিটেন পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আরব রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। ১৯২০ সালে তুরস্কের জন্মের মধ্য দিয়ে উসমানিয়া সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি হয়। ১৯২৩ সালে লুজান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের সীমানা নির্ধারিত হয়।
১৯১৮ সালে পশ্চিম আরবে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে ইয়েমেন রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। মধ্য আরবে সউদ পরিবার আরবের পাঁচ ভাগের চার ভাগ দখল করে নেন। সৌদ পরিবারের নেতৃত্বে ১৯৩২ সালে বৃহত্তর সৌদি আরব রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে উসমানিয়া আমলের শাসক শরীফ হোসেনের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।
শরীফ হোসেন আরব অঞ্চলে আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি ব্রিটেনের সাথে দামেস্ক প্রটোকল সই করেছিল। উসমানিয়াদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে তাকে সহায়তা করেছিল আল ফাতাত ও আল আহাদ নামের দুটি গুপ্ত সংগঠন। তার ছেলে ফয়সালের উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত হয়েছিল রহস্যময় চরিত্রের অধিকারী লরেন্স অব অ্যারাবিয়া।
ইতিহাসের নানা ঘটনা পেরিয়ে জর্দান এখনো শরীফ হোসেনের বংশধররাই শাসন করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ অঞ্চলকে নিয়ে আলাদা একটি মিডল ইস্ট কমান্ড গঠিত হয়েছিল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সময় এ অঞ্চলকে 'সেন্ট্রাল ইস্ট' এবং 'নিয়ার ইস্ট' হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন মধ্যপ্রাচ্যকে ঘিরে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিল। মিসর ও ইয়েমেনে এ নিয়ে পরীক্ষাও চালানো হয়েছিল। নাসেরের নেতৃত্বে প্যান আরাবিজম জন্ম নিয়েছিল।
তেলক্ষেত্র আবিষ্কার ও দীর্ঘস্থায়ী সংকটের পদধ্বনি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে শক্তির উৎস হিসেবে খনিজ তেলের গুরুত্ব বেড়ে যায়। এ ব্যাপারে যুদ্ধের সময়কার ফরাসি প্রধানমন্ত্রী জর্জ ক্লেমেন্সুর একটি আপ্তবাক্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, 'One drop of oil is worth one drop of blood of our soldiers'। পরবর্তী সময়ে এই তেল নিয়েই মধ্যপ্রাচ্যের মাটিতে রক্তের নহর বইয়ে দেয়া হয়েছে। রক্তের নহর বইয়ে দিতে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাই বেশি।
১২ জানুয়ারি ১৯২১ সালে ইকোনিমিস্ট পত্রিকা লিখেছিল, 'যুক্তরাষ্ট্র একটি শব্দ তেল ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। যুদ্ধে যত লোকই মারা যাক, তবু এই যুদ্ধে নামতেই হবে।' সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, ইরাকের মাটি ওই সাক্ষ্যই বহন করছে। ১৯৩২ সালে সৌদি আরবে প্রথম তেলক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। এই অঞ্চলে আরো তেলের সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে পশ্চিমা তেল কোম্পানিগুলো সক্রিয় হয়ে উঠে।
একে একে পুরো অঞ্চলে তেলক্ষেত্র আবিষ্কার এই অঞ্চলের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়। বিশ্বের বাঘা বাঘা তেল কোম্পানি এই অঞ্চলে আসতে শুরু করে। শুরু হয় দীর্ঘময় সংকটের শুভযাত্রা। এ প্রসঙ্গে সেভেন সিস্টার কোম্পানির কথা উল্লেখ করা যায়। এই সেভেন সিস্টার কোম্পানিগুলো হলো- শেল, ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম, এক্সোন, মবিল, টেক্সাকো, শেভরন ও গালফ। ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম ও শেল ছাড়া বাকি পাঁচটি কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের।
মধ্যপ্রাচ্যে এই কোম্পানিগুলোর সম্পদের ভাণ্ডার তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো। এদের এক একটি কোম্পানির বার্ষিক আয় তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশেরই বার্ষিক আয়ের চেয়ে বেশি। এদের প্রশাসনিক কাঠামোও অনেক দেশের চেয়েও জটিল, বৃহৎ ও ব্যাপক। এদের নৌবহর অনেক দেশের নৌবহরের চেয়ে শক্তিশালী।
ইসরাইলের জন্ম ও ঝামেলার সূত্রপাত
১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণার সফল বাস্তবায়ন হয় ১৯৪৮ সালে। প্রতিষ্ঠার পর পরই আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয়৷ একে একে চারটি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে শক্ত ভিত্তি গড়ে নেয়। ১৯৫৬ সালের সুয়েজ যুদ্ধের সময় দৃশ্যপটে হাজির হয় যুক্তরাষ্ট্র। বলতে গেলে এর পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে বেশি মনযোগী হয়ে উঠে। সাথে মিত্র হিসবে পাশে রাখে ইসরাইলকে। স্বার্থের প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে অনেক দেশের সাথেই প্রণয় সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। তবে ইসরাইলকে রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র ছিল সদা তৎপর, এখনো এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও নিজেদের কূটবুদ্ধির সৃজনশীল প্রয়োগ ঘটিয়ে ইসরাইল আজ এই অঞ্চলের প্রতাপশালী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বলতে গেলে আজ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশ ইসরাইলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বলয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। উড়ে এসে জুড়ে বসা দেশটি এখন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে সবাইকে শাসিয়ে বেড়াচ্ছে। অবৈধভাবে রাষ্ট্র গঠনের বিষয় নিয়ে আলোচনা বলতে গেলে এখন হারিয়েই গেছে। আরব রাষ্ট্রগুলো এখন মনে করে ইসরাইলের এই অঞ্চলে থাকার অধিকার রয়েছে।
ইসরাইলের আত্মপ্রকাশ
সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ প্রভাব কমে যাচ্ছে৷ এর স্থলে ইসরাইলের প্রভাব বাড়ছে৷ অনেক বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক ঘাঁটিগুলো থেকে সৈন্য সংখ্যা কমিয়ে আনছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরাইলের প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের সায় রয়েছে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনা প্রমাণ করে আগামীতে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনায় ইসরাইল আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দিবে। পূর্বেও প্রতিটি ঘটনায় দেশটি ভূমিকা রাখলেও তা এখনকার মতো এত প্রকাশ্য ছিল না। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি দেশে ইসরাইল একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে৷
বিশেষ করে আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের সাথে ইসরাইলের সখ্য এখন চোখে পড়ার মতো বিষয়। কাতারের সাথেও দেশটি সম্পর্ক গড়ে তুলছে। গত বছর ইসরাইলকে বিলিয়ন ডলারের অনুদান দিয়েছে কাতার। মিসরের সিসির সাথেও নেতানিয়াহুর সদ্ভাব রয়েছে।
আব্রাহাম একর্ড চুক্তি ও ইসরাইলের লাভ
গত বছরের আরব আমিরাতের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক স্থাপন নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে অন্যতম একটি দিক হল ইরানের ওপর নজরদারি বৃদ্ধি করা। উপসাগরীয় অঞ্চলের আরব আমিরাতের বিপরীত পাশেই ইরানের অবস্থান। আরব আমিরাত থেকে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ চাবাহার বন্দরের ওপর নজরদারি করা যাবে।
আবার আমিরাতের সাথে চুক্তির ফলে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ইয়েমেনের সেকোত্রা দ্বীপেও ইসরাইল অবস্থান তৈরির সুযোগ পেয়েছে। এ দ্বীপটি বর্তমানে ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলের বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এখান থেকে লোহিত সাগর অভিমুখী জাহাজ ও আরব সাগরের উপর নজরদারি করা ইসরাইলের জন্য সহজ হবে।
অন্যদিকে ইসরাইল ৪০ বছর পর আকাবা উপসাগরের এইলাত বন্দর থেকে উত্তর ইসরাইলের আসকালান বন্দর পর্যন্ত ২৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ আরব পাইপলাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এই পাইপলাইন দিয়ে সৌদি ও আমিরাত থেকে ইউরোপে তেল রফতানির পথ সুগম হবে। ইসরাইল ধারণা করছে, এতে চীনও যোগ দিবে।
ইসরাইলের জন্য একমাত্র হুমকি ইরান
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলকে চ্যালেঞ্জ করার মতো একমাত্র ইরানই এখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে৷ দেশটি এই অঞ্চলে উঠতি শক্তি। অনেক বিশ্লেষক মত দিয়েছেন, ইরান ও ইসরাইল বিরোধই হবে মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান ইস্যু।
মধ্যপ্রাচ্যের শক্তির লড়াইয়ে আগামীতে পৃথিবী এই দুই দেশের আচকা-আচকির গল্পই শুনবে বেশি। ইসরাইল যেমন প্রভাব বিস্তারের খেলায় মেতে উঠেছে ইরানও তেমনি ওই খেলায় জোর কদমেই এগিয়ে চলেছে৷
দেশটি প্রভাব বিস্তারের খেলায় নানামুখী কাজ করে যাচ্ছে। ইয়েমেন, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক প্রভৃতি দেশে প্রভাব বিস্তার করেছে। ইয়েমেনে হাউছি, লেবাননে হিজবুল্লাহ দিয়ে ইরান বহু দিন ধরেই ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
আইসিস দমনেও ইরান সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। ইরাকে আজ বলতে গেলে ইরানেরই শাসন চলছে। আফগানিস্তান, কাতার, সৌদি আরবসহ প্রতিটি দেশের শিয়া সম্প্রদায়ের কাছে ইরান আজ একটি আশার ফুল। ইরান অনেক বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও পরমাণু কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। মিসাইল প্রতিরক্ষায় ইরানের শক্তি খোদ ইসরাইলকেও তাক লাগিয়ে দেয়৷
ইরানকে থামাতে মরিয়া ইসরাইল
ইরানের এই অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে সর্বগ্রাসী কৌশল গ্রহণ করেছে ইসরাইল। তারা ইরানের পরমাণু প্রকল্প ও এর বিজ্ঞানীদের উপর অন্যায়ভাবে বহু আক্রমণ করেছে। সিরিয়ার ইরানের স্থাপনার ওপর অগুনতি এয়ার স্ট্রাইক পরিচালনা করেছে। গত দুই বছর ইরানের ডজন খানেক জাহাজ ও তেলবাহী ট্যাঙ্কারে হামলা করেছে। কাসেম সুলাইমানি ও সর্বশেষ ফাখরিজাদেহ হত্যাতেও ইরানের হাত ছিল বলে সন্দেহ করা হয়।
এসবের পিছনে একটাই উদ্দেশ্য পরমাণু প্রকল্পকে পিছিয়ে দেয়া অথবা বিনাশ করে সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনে ইরানের প্রভাব কমিয়ে আনা। আর এই কাজের জন্য ইসরাইল তার নতুন আরব বন্ধুদের ব্যবহার করছে।
ইসরাইলকে মোকাবেলায় ইরান ব্যর্থ
এর প্রতিবাদে ইরান প্রতিশোধের হুমকি দিলেও ইসরাইলের দুই একটা জাহাজে আক্রমণ ছাড়া বড় কোনো কিছুই করতে পারেনি। ইতোমধ্যে দেশটি পরমাণু কর্মসূচি এগিয়ে নিতে ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ইসরাইল যেকোনো উপায়ে ইরানের এই অগ্রগতি থামিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর।
ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী হত্যা, বারবার পরমাণু কেন্দ্র আক্রমণ, সিরিয়ার ইরানি অবস্থানে হামলা প্রভৃতি ঘটনার যথোপযুক্ত জবাব ইরান দিতে পারেনি। কাসেম সুলাইমানি হত্যার পর ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের স্থাপনায় কয়েকটা ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বাইরে তেমন বড় কিছুই করতে পারেনি। ফাখরিজাদেহ হত্যার পরও হম্বিতম্বির মধ্যে দিয়েই শোক কেটে গেছে।
তবে এখানে উল্লেখ করা যায়, কাসেম সোলাইমানির হত্যার পর ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক স্থাপনায় মিসাইল হামালা চালানোর ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে শক্ত বার্তা দিয়েছে। হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ৫২টি স্থাপনার উপর পাল্টা হামলার ঘোষণা দিয়েছিল।
এর জবাবে ইরান বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্র এই হামলা করলে ইরানের পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হবে আরব আমিরাতের দুবাই ও ইসরাইলের বড় শহর ও বন্ধর নগর হাইফা। হাইফাতে আক্রমণের ছক ইরান ও হিজবুল্লাহ উওয়ের কাছেই রয়েছে।
ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ কি আসন্ন?
সাইবার হামলা বা ছায়াযুদ্ধের মধ্যে আপাতত দুই দেশের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ থাকলেও দিন দিন উত্তেজনা যে হারে বাড়ছে এতে করে ভবিষ্যৎ দেশ দুটি প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতিকেও সামনে রেখেছেন। তিনি বছরের শুরুর দিকে বলেছেন, 'ইরান পরামণু অস্ত্র পেতে আগ্রহী। এটা পরিষ্কার যে ইসরাইলকে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।'
তবে যুদ্ধ শুরু হলে ইসরাইল দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক কিছু পাবে না এমন মতামত অনেক বিশ্লেষকের। কারণ তখন তাকে বিভিন্ন ফ্রন্টে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। বিশেষ করে হিজবুল্লাহ ইসরাইলের প্রধান মাথাব্যথা। এর আগে হিজবুল্লাহর সাথে ইসরাইলের পরাজয়ের রেকর্ড রয়েছে। সরাসরি যুদ্ধের আশঙ্কা কম এরপরও বিষয়টি একেবারে উড়িয়েও দেয়া যায় না।
ইসরাইল কি আসলেই শান্তি চায়?
মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এখানকার প্রতিটি সংকটেই ইসরাইলের ভূমিকা রয়েছে। যখনই কোনো আরব দেশ পরমাণু শক্তির উত্তরাধিকার পেতে চেষ্টা করেছে তখনই ইসরাইল তা ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়েছে। এর আগে সিরিয়া ও লিবিয়ার পরমাণু প্রকল্প ধ্বংস করে মোসাদ। মিসরের মিসাইল কর্মসূচি ভণ্ডুল করে দিতে পত্রবোমা পাঠিয়ে এই প্রকল্পের সাথে জড়িতদের হত্যা করে মোসাদ।
বাইডেন প্রশাসন যখন ইরানের সাথে একটা সমঝোতার চেষ্টা করছে তখন ইসরাইল সাহায্য না করে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। ইসরাইলি লবির মাধ্যমেও বাইডেন প্রশাসনকে বাধাগ্রস্ত করতেও থেমে নেই ইসরাইল।
ইরান পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হলে ইসরাইল নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। এটা মেনে নিলেও এর সমাধান কি অন্যভাবে করা যায় না? উত্তেজনা ছড়ানো, মানুষ হত্যা, যুদ্ধাবস্থা তৈরি করা এগুলোই কি একমাত্র সমাধান?
শেষ করার আগে আল জাজিরার রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশরার সুরে বলতে চাই, 'আর কত যুদ্ধ এই অঞ্চলে হলে ইসরাইল নিরাপদ হবে? আর কত দেশ অস্থিতিশীল করলে ইসরাইলের অহমিকা চরিতার্থ হবে? মধ্যপ্রাচ্যের সংকট শেষ হওয়ার আগে আর কত মানুষকে মরতে হবে?'