ফেজ আল্লাহু আকবর : 'মুরের শেষ দীর্ঘশ্বাস'
আল হামরা প্রাসাদ - ছবি : সংগৃহীত
স্প্যানিশরা বলে 'Elultimo suspiro del Moro.' যার অর্থ 'মুরের শেষ দীর্ঘশ্বাস'। মুসলমানেরা ডাকে 'ফেজ আল্লাহু আকবর'।
১৪৯১ সালের ২ জানুয়ারি। গ্রানাডার মুসলিম অধিবাসীদের ঘুম তখনো ভাঙেনি। গ্রানাডার শেষ সুলতান আবু আব্দুল্লাহ তার পরিবার-পরিজন নিয়ে আল হামরা প্রাসাদ থেকে বের হয়ে এলেন। হাতে গ্রানাডার সরকারি সমস্ত প্রতিষ্ঠানের চাবি। রানি ইসাবেলা ও রাজা ফার্দিনান্দের কাছে চাবি হস্তান্তর করে আত্মসমর্পণ করার জন্যই তারা বেরিয়ে এসেছেন। পরিবার, পরিজনের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। বারবার স্মৃতিমাখা আল হামরা প্রাসাদের দিকে তাকাচ্ছেন আর জীবনের নানা স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে।
আলহামরাকে ছেড়ে যেতে কষ্টে যেন বুকের পাঁজর ভেঙে যাচ্ছিল আবু আব্দুল্লাহর। মুসলিম স্থাপত্যের ক্লাসিক মর্যাদা পাওয়া আল হামরা সম্পর্কে সরোজিনী নাইডু বলেছিলেন, 'তাজমহলের চাইতেও অধিকতর অনিন্দ্যসুন্দর।' সৈয়দ আমীর আলী বলেছিলেন, শক্তিশালী কলম দিয়েই কেবল আল হামরার সৌন্দর্য বর্ণনা সম্ভব। আল হামরা যেন বিধবার পোশাক পরে মুখভার করে দাঁড়িয়ে আছে। এই সেই গর্বের আল হামরা তাকে ছেড়ে যেতে হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে। প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে ভেগা প্রান্তর ধরে সেনিল নদী পার হয়ে আল পুজারিস পাহাড়ের পাদদেশে এক গ্রামে এসে উপস্থিত হলেন আবু আব্দুল্লাহ ও তার পরিবার। অপেক্ষমান ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলার হাতে তুলে দেবেন গ্রানাডার চাবি।
বশ্যতা স্বীকার করতে ঘোড়া থেকে নামতে হয়। তাই আবু আব্দুল্লাহ নামতে উদ্যত হলেন, ইশারায় নামতে নিষেধ করলেন ফার্দিনান্দ। ফার্দিনান্দের হাত চুম্বন করতে চাইলেন তাও নিষেধ করা হলো। অবশেষে ডান হাত চুম্বন করে চাবি হস্তান্তর করলেন। 'মুরের শেষ দীর্ঘশ্বাস' পাহাড়ের চূড়ার একটু নিচের সমতল জায়গায় এই ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে বলে পাহাড়ের নামকরণ হয় মুরের শেষ দীর্ঘশ্বাস।
আবু আব্দুল্লাহর দু'চোখ বেয়ে হৃদয়ভাঙা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়তে দেখে তার মাতা বললেন, তুমি তো পুরুষের মতো যুদ্ধ করোনি। অতএব নারীর মতো কান্নাই কেবল তোমার শোভা পায়।
আবু আব্দুল্লাহ গ্রানাডার নাসিরি বংশের দ্বাদশ ও শেষ শাসক। ১০০২ সালের পরে আন্দালুসিয়া ও অন্যান্য স্টেইট আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে কমবেশি ৩৪টি স্বাধীন প্রদেশে বিভক্ত হয় এবং ধীরে ধীরে সেগুলো ইউরোপের খ্রিস্টানদের হস্তগত হয়। বাকি থাকে শুধু গ্রানাডা। তাও ক্যাথলিকদের আভ্যন্তরীণ কোন্দল, যুদ্ধের জন্য প্রায় ৪০০ বছর টিকে যায় তবে ক্ষয়ের ধারা অব্যাহত থাকে গ্রানাডার।
গ্রানাডার শাসক ছিলেন আবু আব্দুল্লাহর পিতা আবুল হাসান আলী। খ্রিস্টানদের সহায়তায় সিংহাসনের লোভে পিতার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন আবু আব্দুল্লাহ। পিতা-পুত্রের যুদ্ধে পিছু হটেন পিতা আবুল হাসান। উপায় না পেয়ে ভাই আব্দুল্লাহ জাগালের হাতে ক্ষমতা দেন আবুল হাসান। চাচা আব্দুল্লাহ জাগালের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ চালিয়ে যান আবু আব্দুল্লাহ। চাচা আব্দুল্লাহ জাগালকে অবরোধ করে রাখেন ভাতিজা আবু আব্দুল্লাহ ও খ্রিষ্টান মিত্ররা। একসময়ে খাদ্য সংকট ও অন্যান্য দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন আব্দুল্লাহ জাগাল।
জাগাল সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা বলেন, 'তিনি সর্বশেষ মুর শাসক। তিনি ছিলেন সাহসী যোদ্ধা, যথার্থ শাসক ও খ্রিস্টশক্তির বিরুদ্ধে অটল প্রতিদ্বন্দ্বী। যদি ভাতিজার দ্বারা বিঘ্ন না ঘটতো, তবে গ্রানাডা তার হাতেই থাকতো গোটা জীবন।' (সূত্র : The Moors in Spain, Page- 248)
রাজা ফার্দিনান্দ আবু আব্দুল্লাহকে আশ্বস্ত করেছিলেন, গ্রানাডার ক্ষমতা তার হাতেই থাকবে এবং আশপাশের খ্রিস্টান রাজ্যগুলোর সাথে বিশ্বস্ত সম্পর্কও থাকবে। আবু আব্দুল্লাহ খ্রিস্টানদের সাথে বন্ধুত্বকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে নিয়েছিলেন আর পিতা ও চাচাকে প্রধান শত্রু গণ্য করেছিলেন। তারপরর করুণ ইতিহাস আমরা জানি। আবু আব্দুল্লাহ গ্রানাডা থেকে বেরিয়ে মরক্কোতে গিয়ে দীনহীন জীবনযাপন করে মৃত্যুমুখে পতিত হন। মুসলিমদেরকে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে দিয়ে যান।
ইতিহাসের নায়ক বা ভিলেন কেবল কোনো ব্যক্তিই হয়ে থাকেন না, তারা হয়ে পড়েন উত্তর প্রজন্মের অভিভাবকও। তাই ইতিহাসের মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে যারা বীরত্বগাঁথা নির্মাণ করেন, তাদের নিয়ে উত্তর প্রজন্ম যেমন গর্ববোধ করে, তেমনি নতজানু পরাজয় আর বেঈমানির ইতিহাস অপমানও করে, লজ্জায় ফেলে দেয়।
গ্রানাডার পতনের সময় উসমানীয়দের কাছে হাত পাতার মতো সম্পর্ক তার ছিল না। আবু আব্দুল্লাহ তাই সেদিকেও হাত বাড়াতে পারেননি। আবু আব্দুল্লাহর সেনাপতি মুসা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করতে চেয়েছিলেন। অথচ সেটাও করতে দেননি। বরং ঘরের মধ্যে বসে হাহাকার করছিলেন আর বলেছিলেন, তকদ্বিরে যা লেখা আছে তাই হবে। 'আল্লাহু আকবর। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ। আমার কর্মফল আমাকে নিতেই হবে।'
সেই থেকে ২ জানুয়ারি এলেই গ্রানাডার খ্রিস্টানেরা বিজয় উৎযাপন করে এই পাহাড়ে। পাহাড়ের চূড়ার নিচের চত্ত্বরে, যেখানে দাঁড়িয়ে আত্মসমর্পণ করেছিলেন সেখানে আবু আব্দুল্লাহর ২০০ পুত্তলিকা বানিয়ে চোখের মধ্যে একটি নল লাগিয়ে সেখান দিয়ে পানির সংযোগ দেয় এবং অঝোরে সেই চোখ দিয়ে পানি ঝড়তে থাকে। আর এতে যেন প্রতিফলিত হয় মুরের শেষ দীর্ঘশ্বাস।