মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ!
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ! - ছবি : সংগৃহীত
গত পয়লা ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে আবারো শাসনক্ষমতা পুরোপুরি হাতে তুলে নিয়েছে সামরিক জান্তা। সেনাবাহিনীর সবাই যে অভ্যুত্থান চাইছিলেন, এমন নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কারণ, দীর্ঘ দিন বহু ছোট-বড় বিদ্রোহী জনজাতির সাথে লাড়াই করে চলেছে সামরিক বাহিনী। সঙ্গত কারণে সাধারণ সেনাসদস্যরা যথেষ্ট ক্লান্ত।
দেশে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার থাকলেই বরং তারা খানিকটা আশ্বস্তই হতো। সাধারণ মানুষও গণতন্ত্র চাইছিল। বিশেষ করে তরুণেরা। তাই দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সেনা-অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছে বিপুল মানুষ। সেখানে তরুণদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো। জান্তাবিরোধী তীব্র প্রতিবাদে শরিক হচ্ছেন তারা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্যমতে, প্রতিবাদ করতে গিয়ে মার্চ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক মানুষ মারা গেছেন।
মিয়ানমারে কেন সেনাবাহিনী এই অবস্থায় ফের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ঝুঁকি নিলো? এই সময় সেনা-অভ্যুত্থানের কারণই বা কী? এক কথায় বলা যায়, শুধু সেনাবাহিনীর ওপরতলার কর্মকর্তাদের সীমাহীন উচ্চাকাক্সক্ষা এবং ক্ষমতার লোভ। পরবর্তী প্রশ্ন থাকতে পারে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ক্ষমতায় টিকে থাকার মানসিক বল কিভাবে পাচ্ছে? এ ক্ষেত্রে জানা থাকা প্রয়োজন, কিভাবে অগণতান্ত্রিক শক্তি ক্ষমতায় টিকে থাকে সেই বিষয়টি। দেশে দেশে সামরিক-বেসামরিক ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ক্ষমতায় টিকে থাকতে অশুভ আঁতাতে গাঁটছাড়া বাঁধে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয়, ‘সিভিকো-মিলিটার’। পৃথিবীতে গণতন্ত্রের আবহে কর্তৃত্ববাদের মিশেলে নতুন নতুন নানা পদ্ধতি চালু হওয়ায় সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক শাসনের মান নিচে নেমে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে দুর্বল হয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থানে জনবিচ্ছিন্ন শাসকেরা ক্ষমতা সুসংহত এবং ধরে রাখার কৌশল হিসেবে সামরিক-বেসামরিক শক্তির মেলবন্ধন। বিষফল হিসেবে বহু দেশেই গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে পরোক্ষে সেনাসমর্থিত সরকার কিংবা প্রত্যক্ষভাবে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণে উৎসাহিত হয়। এর মূলে রয়েছে পরাশক্তির মদদ। অগণতান্ত্রিক শক্তি কোনো না কোনো পরাশক্তির মদদেই ক্ষমতায় টিকে থাকে।
বাণিজ্যিক ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে দ্বৈত ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ‘দ্বিচারী’ পরাশক্তিগুলো। যদিও বিশ্ব মোড়লের অনেকে গণতন্ত্রের কথা বলে মুখে ফেনা তোলে। বাস্তবে, তাদের সব আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে হীন স্বার্থ। সেখানে নীতি আদর্শের বালাই বিন্দুমাত্র থাকে না। একদলীয় শাসনব্যবস্থার দেশ চীন এবং কর্তৃত্ববাদী রাশিয়ার কথা না হয় বাদই থাক। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোও গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতার কথা বলেও নিজেদের স্বার্থে অন্যের বেলায় তা জ্বলাজ্বলি দিয়ে দেশে দেশে অতীতে অগণতান্ত্রিক শাসন যেমন টিকিয়ে রেখেছিল; এখনো সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য হচ্ছে এর জ্বলন্ত উদাহরণ। মধ্যপ্রাচ্যে রাজা-বাদশাদের ক্ষমতায় দেখতেই মার্কিন প্রশাসন ও ইউরোপীয়রা আরাম বোধ করেন। পূর্বসূরিদের মতো বাইডেন প্রশাসনও শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের পদচারণকে মসৃণ রাখতেই কূটনৈতিক সম্পর্ক নির্ধারণ করতে ব্যস্ত। যেমন, সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যায় সৌদি যুবরাজের সম্পর্কের কথা মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা বললেও তাকে ছাড় দেয়া হচ্ছে শুধু সস্তায় জ্বালানি পাওয়া এবং অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া সাপেক্ষ।
অথচ বাইডেন ভোটের আগে নির্বাচনী প্রচারকালে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যেভাবে সমালোচনা করেছিলেন; যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে তিনি যে বাগাড়ম্বর করেছিলেন, তার সাথে বাইডেনের বর্তমান অবস্থানের বিস্তর ফারাক দেখে খোদ ডেমোক্র্যাটদের একটি অংশ বিরক্ত। তারা বলছেন, বাইডেন খাশোগি হত্যার বিষয়ে যেভাবে সালমানকে ছাড় দিচ্ছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রকে অন্যায়ের সাথে আপসরফাকারী শক্তি হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরছে। তারা আরো মনে করেন, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি যে মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে চলে, এর মাধ্যমে তার সাথে আপস করে বাইডেন প্রশাসন দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে দ্বিমুখী নীতি নতুন নয়। আরব বসন্তের মাধ্যমে মিসরে ক্ষমতার যে পালাবদল হয়; সেখানে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা টেকসই হয়নি শুধু মার্কিন দ্বৈতনীতির কারণে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ সিসিকে ক্ষমতায় এনেছে যুক্তরাষ্ট্রই। তেমনিভাবে বলা যায়, উদীয়মান আঞ্চলিক শক্তি তুরস্ক নিজেদের স্বার্থ বিবেচনায় মিসরের সাথে নতুন করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে। একইভাবে সিরিয়ায় বাশারের সহযোগী ইরান। কিছু আরব দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক গড়তে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার জ্বলাঞ্জলি দিতে কসুর করছে না। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত উল্লেখযোগ্য। উত্তর কোরিয়াতেও একনায়কের ক্ষমতায় টিকে থাকার কারণ চীন-রাশিয়ার মদদ। সিরিয়ার যুদ্ধে বাশার আল আসাদের এখনো টিকে থাকার কারণ পরাশক্তিগুলোর কাছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার বা বাকস্বাধীনতা নয়, বরং নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের নীতিই সবচেয়ে বড়।
বিশ্বরাজনীতির মারপ্যাচেই মিয়ানমারও দীর্ঘ দিন ধরে জান্তাশাসিত। দেশটির নাগরিকরা পরশক্তিগুলোর হিসাব-নিকাশের মারপ্যাঁচের গ্যাঁড়াকলে দশকের পর দশক ধরে গণতন্ত্রহীন। বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতা হারিয়ে দমবন্ধ অবস্থা তাদের। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছে থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ’৬২ সালেই সামকিরক জান্তার কবলে পড়ে দেশটি। অথচ ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার যখন ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, তখন কথা ছিল, দেশের বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে।
এমনকি চাইলে তারা বিচ্ছিন্নও হয়ে যেতে পারবে, এমন শর্তও মেনে নিয়েছিলেন স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা অং সান। বাস্তবে সেসব কিছুই ঘটেনি। বরং শুরু থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মীরা পুরো দেশে তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬২ সালে বর্মীনিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতা দখল করে বিদ্রোহী সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ওপর নির্বিচার নির্যাতন শুরু করে। অং সান সু চির পাঁচ বছরের শাসনকাল ছিল এরই সামান্য পরিবর্তিত রূপ। পরোক্ষে প্রকৃত ক্ষমতা ছিল সেনাবাহিনীর হাতেই। দেশটির অগণতান্ত্রিক শক্তির পেছনে অন্যতম মদদদাতা চীন। এ প্রসঙ্গে চীনা যে মনস্তত্ত্ব কাজ করছে, তা হলো- আদর্শগত বা প্রাতিষ্ঠানিক দুই অর্থেই গণতন্ত্র জিনিসটা চীন কেবল নিজের ভাষাতেই ভাবতে অভ্যস্ত। তাই মিয়ানমারে গণতন্ত্র আছে কী নেই, সে বিষয়ে ভেবে চীন খুব সময় নষ্ট করেনি, এখনো করবে না।
কেবলমাত্র নিজের স্বার্থটাই বেইজিংয়ের কাছে মুখ্য। ইদানীং বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ বলে দাবিদার ভারতেরও সায় রয়েছে জান্তার পক্ষে। একটি বিষয় লক্ষণীয়, মিয়ানমারের চলমান গণতান্ত্রিক সংগ্রামে ইতোমধ্যে সেখানে অন্তত ৩৭টি চীনা মালিকানাধীন কারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে গত কয়েক দিনে। সংকীর্ণ স্বার্থে মিয়ানমারের বেলায় বরাবর জান্তার পক্ষেই চীন। এর প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থীদের এই ক্ষোভ। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে কী চীনের জন্য শিক্ষণীয় কিছু আছে? নেপালকে কব্জায় রাখতে গিয়ে ভারত যেমন পস্তিয়েছে, মিয়ানমারে চীনও তেমন বেকায়দায় পড়ে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।
মিয়ানমারের সাধারণ মানুষের মধ্যে গণতন্ত্রের আকাক্সক্ষা এখন তীব্র। এ কথা অনস্বীকার্য যে, দীর্ঘ ৫০ বছর জান্তাশাসিত মিয়ানমারে ২০১১ সাল থেকে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে শুরু করে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে ক্ষমতায় আসে গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী ও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন দল লিগ ফর ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাসি। কিন্তু সু চিকে সামরিক জান্তার সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হয়। দেশটির সামরিক-বেসামরিক মুষ্ঠিমেয় শক্তি নিজেদের ভ্যাগ্য বিপর্যয়ের আশঙ্কায় সু চি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সরাসরি দেশের শাসনভার নিয়েছে। শক্তিমান প্রতিবেশী চীন মিয়ানমারের এই পরিবর্তনকে সেনা অভ্যুত্থান বলতেই রাজি হয়নি। বেইজিংয়ের মতে, এটা মন্ত্রিসভার রদবদল মাত্র। রোহিঙ্গা গণহত্যা প্রসঙ্গেও চীন বরাবর সেনাদের পাশেই থেকেছে।
মিয়ানমারে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনে অং সান সু চির দল আগের চেয়েও ভালো করেছে। তাতেই ঘটেছে তাদের এবং ভোটদাতাদের বিপদ। আসল ক্ষমতা সেখানে থেকেছে সেনাবাহিনীর হাতে, ক্ষমতা তারাই দখল করে রেখেছে এবং জবাবদিহির দায়বিহীন ক্ষমতায় থাকলে যা যা করা সম্ভব, সেসব তারা করেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি, সবকিছুতেই অবাধ লুণ্ঠনের রাজত্ব বসিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর গণনির্যাতন, তাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যাসহ যত রকমের জুলুম কল্পনা করা সম্ভব, সব চালিয়েও ক্ষান্ত হয়নি, প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গাকে অস্ত্রের মুখে দেশছাড়া করেছে। দুর্ভাগা মানুষদের জায়গাজমি, ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট যা ছিল, সব দখল করে নিয়েছে।
একদা বিশ্ববরেণ্য নেত্রী সু চি, তিনি প্রতিবাদ করবেন কী, উল্টো সহযোগিতাই করেছেন। অথচ ওই সেনাবাহিনী তাকে বছরের পর বছর আটক করে রেখেছিল। আপসের ফর্মুলায় ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেবেন এবং নির্বাচনের পথে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেবেন, এই ছিল তার আশা। সেনাবাহিনী সেটা হতে দেবে কেন? তাদের হাতে বন্দুক আছে, সেটা ব্যবহার করে আবারও তারা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। সু চিকে আবারো আটক করা হয়েছে। সু চির দল কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারেনি। সাধারণ মানুষ ঠিকই রাস্তায় নেমে এসেছে।
সু চির পতনে বাংলাদেশে অনেকেই খুশি। গত কয়েক বছরে তার বিরুদ্ধে আমাদের দেশের মানুষের মনে তীব্র ক্ষোভ জমেছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর যে বর্বরতা চলেছে, সেই দায় যদিও সেনাবাহিনীর; কিন্তু সামনে হাজির ছিলেন সু চি। নির্লজ্জভাবে তিনি সেনাবাহিনীর অপকর্মে অকুণ্ঠ সমর্থন জুগিয়েছেন। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে যাওয়া মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচারকে নাকচ করতে সু চি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে হাজির হন। সেখানে সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গান। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে আপত্তিকর কথা বলেছেন। তার বিদ্বেষ ও বর্ণবাদী আচরণ এবং অবস্থান ছিল প্রকাশ্য। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী একজন কিভাবে একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়ায় শামিল থাকতে পারেন, বিশ্বের শান্তিকামী সবাইকে যা অবাক করেছে। কিন্তু সু চি যাদের হাতে শায়েস্তা হচ্ছেন, সেই সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা গণহত্যার হোতা। তার এই ‘শাস্তির’ সাথে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিধনে তার ভূমিকার সম্পর্ক নেই।
মিয়ানমারে ২০০৮ সালে সেনাবাহিনী একটি সংবিধান রচনা করে, যাতে সরকারে সামরিক বাহিনীর পুরো কর্তৃত্ব বজায় রাখার বন্দোবস্ত করা হয়। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় আইনসভায় সেনাবাহিনীর জন্য ২৫ ভাগ আসন সংরক্ষিত রাখা হয়। বেসামরিক সরকারকে নিয়ন্ত্রণের সব ক্ষমতাই রাখা হয় সেনাবাহিনীর হাতে। সেই বিবেচনায় যা আদৌ গণতান্ত্রিক সংবিধান নয়। এই বাস্তবতায় ভোটে নির্বাচিত সু চির দলকে চলতে হয়েছে সেনাবাহিনীর কথামতো। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও গণতন্ত্রপন্থীরা যে শক্তি অর্জন করেন, এর প্রমাণ গত নির্বাচনে তাদের বিপুল বিজয়। সেই নির্বাচনে সেনাবাহিনী-সমর্থিতদের শোচনীয় পরাজয় হয়। সীমিত গণতন্ত্র চর্চার মধ্যেই মিয়ানমারে গণতন্ত্রীদের এমন বিজয় প্রমাণ করে, জনগণ গণতন্ত্রের স্বাদ উপভোগ করতে শুরু করেছিল।
কার্যত একটি সেনাতন্ত্রের ভেতরে অধিকতর গণতন্ত্রের যে আকাক্সক্ষা মিয়ানমারের ভোটাররা প্রকাশ করেছেন, সেটি সেনাবাহিনীর মনোপুত হয়নি। তারা বুঝতে পারে, এভাবে চললে সামনের দিনগুলোতে মিয়ানমারের রাজনীতিতে সেনানিয়ন্ত্রণ আরো আলগা হবে। সামরিক বাণিজ্যে লাগাম পড়বে। সেজন্যই গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষায় আগাম আক্রমণ। দেশটির রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর যে অবস্থান, তাতে সু চিকে সরিয়ে দেয়ার কাজটি সহজভাবে সামাল দেয়া যাবে, মনে করা হয়েছিল। কিন্তু একদশকে পরিস্থিতি যে পাল্টেছে, অভ্যুত্থানের পর টের পাচ্ছে জান্তা। তাই তো মিয়ানমারে শুরু হওয়া গণআন্দোলন থামাতে সেনাবাহিনী হিমশিম খাচ্ছে। গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার বিপক্ষে সেনাবাহিনীর আগাম আক্রমণ ঠেকাতে রাজপথে নেমেছেন গণমানুষ। দমন-পীড়নেও তাদের লড়াই থেকে সরানো যাচ্ছে না। প্রাণ দিচ্ছেন তারা।
শুধু আমজনতা নয়, নানা শ্রেণিপেশার মানুষও সেনাশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব বন্দী থাকায় গণ-আন্দোলনের কোনো কেন্দ্রীয় নির্দেশনা নেই। তবু বিক্ষোভ দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। এই সংগ্রামের পরিণতির ওপর মিয়ানমারের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। কঠোর হস্তে বিক্ষোভ দমাতে বদ্ধপরিকর জান্তা। আবার নতুন কৌশলে কোনো সেনানিয়ন্ত্রিত শাসনও আসতে পারে। কর্তৃত্ববাদীদের সাথে সেনাতন্ত্রের মিশেলে মিয়ানমারে নতুন কোনো পদ্ধতি জেঁকে বসলে, সেটি শুধু মিয়ানমারের জন্য নয়, সারা বিশ্বের গণতন্ত্রকামীদের জন্যই হবে দুর্ভাগ্যজনক। দক্ষিণ এশিয়াতেও বাজে নজির হিসেবে হাজির হবে। তাই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে মিয়ানমারের জনগণের বিজয় বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের স্বার্থেই জরুরি। এখানে রোহিঙ্গা ইস্যু এবং মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক লড়াইকে গুলিয়ে ফেলার সুযোগ নেই। তা সুবিবেচনাপ্রসূতও নয়।
মিয়ানমারে গণমানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নামায় রাতারাতি সামরিক বাহিনী নতজানু হয়ে যাবে, এমন আশা করা দুরাশা। বরং সামরিক বাহিনী পালটা যে আঘাত হানছে, তাতে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়বে। পশ্চিমী কোনো দেশ অথবা যৌথ রাষ্ট্রশক্তি মিয়ানমারে গণতন্ত্রের দুর্দশায় ব্যাকুল হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করবে, এমন কোনো সম্ভাবনার কথাও আপাতত ভাবা যাচ্ছে না। কারণ, বিশ্ব মোড়লরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় মিয়ানমারে গণতন্ত্রপন্থীদের সাথে সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘাত অবসানে আগের মতো একটি আপসরফার চেষ্টা করবে না, তা হলফ করে বলা যাবে না। আবার এমনো হতে পারে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে গণতন্ত্রপন্থীরা ক্লান্ত হয়ে তেমন কোনো সমঝোতায় রাজি হয়েও যেতে পারেন।
সেই আপসরফায় সু চি এবং তার দলকে হয়তো আবার ক্ষমতার ভাগ দেয়া হতে পারে। যদিও একটি আন্দোলন যে সবসময় তত্ত্বের ছকে চলে তা কিন্তু নয়। তার পরও বলা যায়, দেশটিতে সামরিক-বেসামরিক চক্রের বিরুদ্ধে এখন যে লড়াইটা দেখা দিয়েছে, সেটা আর কায়েমি স্বার্থের গৃহবিবাদমাত্র নয়; বুর্জোয়া রাজত্বের চরম প্রকাশের সময়ে যা অনিবার্য, তারই আভাস ফুটে উঠছে।
সার্বিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে গণমানুষের সংগ্রাম। সেটা গৃহযুদ্ধ। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা অসঙ্গ নয় যে, মিয়ানমারে চলমান গণতান্ত্রিক সংগ্রাম দীর্ঘায়িত হলে তা গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। সময় যত গড়াচ্ছে সেই শঙ্কা তীব্রতর হচ্ছে।