ভারতে কুম্ভমেলা হয়ে ওঠছে সুপার স্প্রেডার!
ভারতে কুম্ভমেলা হয়ে ওঠছে সুপার স্প্রেডার! - ছবি : সংগৃহীত
ভারতের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশেষ ধর্মীয় আয়োজন কুম্ভে দ্বিতীয় শাহি স্নানের জন্য মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত হরিদ্বারে এসে পৌঁছেছেন প্রায় ২৮ লাখ মানুষ। গোটা ভারতে করেনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়লেও কুম্ভে ন্যূনতম কোভিড সতর্কতা বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে উত্তরাখণ্ড সরকার। ফলে কুম্ভ কোভিড সংক্রমণের ‘সুপার স্প্রেডার’ হয়ে দাঁড়ানোর আশঙ্কা বাড়ছে। কুম্ভ ফেরত তীর্থযাত্রীদের মাধ্যমে মহারাষ্ট্রে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা নিয়ে এ দিন মুখ খুলেছে সে রাজ্যের শাসক জোটের শরিক শিবসেনা, এনসিপি ও কংগ্রেস।
কিন্তু উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী তিরথ সিংহ রাওয়তের মতে, সব কোভিডবিধি মেনেই কুম্ভমেলা পরিচালনা করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে তার আশা, ঈশ্বরভক্তি রোগের ভয়কে জয় করতে সাহায্য করবে। কিন্তু আগামীকাল দ্বিতীয় শাহি স্নানের আগে বাস্তব চিত্রটা কী? উত্তরাখণ্ড সরকারের মেডিক্যাল দফতরের হিসেব অনুযায়ী, রোববার রাত সাড়ে এগারোটা থেকে সোমবার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ১৮,১৬৯ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০২ জন কোভিড পজেটিভ। আজ হরিদ্বারে ৫৯৪ জন করোনা আক্রান্তের খোঁজ মিলেছে। এ নিয়ে ২ দিনে হরিদ্বারে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১ হাজার জনে।
হরিদ্বারের স্টেশন, হর কি পৌড়ী ও ঘাটগুলোতে দেখা যাচ্ছে না থার্মাল স্ক্রিনিংয়ের কোনো ব্যবস্থা। যারা মাস্ক পরছেন না তাদের উপরে নজরদারি করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় বলীয়ান নয়া সিসিটিভি ব্যবস্থা ব্যবহার করছে উত্তরাখণ্ড। তবে মাস্ক না পরে যারা ঘুরছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষণ চোখে পড়ছে না কোথাও।
কুম্ভযাত্রী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, বিপুল জনসমাগমের ফলে কোভিডের বিরুদ্ধে প্রথম যে ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে সেটি হলো কুম্ভে আসতে ইচ্ছুক সকলের আরটি-পিসিআর পরীক্ষা। বিভিন্ন চেকপোস্টে যাত্রীদের আরটি-পিসিআর রিপোর্ট আছে কি না, তা জানতে চাওয়া হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু না থাকলে কোনও যাত্রীকে আটকানো হচ্ছে না মেলায় কোভিড মোকাবিলার দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক অবিনাশ খন্না জানালেন, রাজ্যের সীমানা, স্টেশন ও ঘাটে থার্মাল স্ক্রিনিং করা হচ্ছিল আজ সকালে ঘাটে কেবল বিভিন্ন আখড়ার সদস্যদের স্নানের অধিকার ছিল। তাই স্ক্রিনিং ও পরীক্ষা বন্ধ আছে।’’
করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে গত বছরে তবলিগি জামাতের মার্কাজ়ের সঙ্গে কুম্ভের তুলনা টানছে অনেক শিবির। কিন্তু উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী তিরথ সিংহ রাওয়তের মতে, এই তুলনা ঠিক নয়। মার্কাজ হয়েছিল বদ্ধ জায়গায়। কুম্ভ গঙ্গার ঘাটের মতো ফাঁকা জায়গায় হচ্ছে।
২৪ ঘণ্টায় ভারতে সক্রিয় রোগী বাড়ল লক্ষাধিক
দেড় লক্ষের গণ্ডি পার করে দু’লক্ষের দিকে এগোচ্ছে ভারতের দৈনিক করোনা সংক্রমণ। রোববার প্রথমবার দেড় লক্ষের গণ্ডি পেরিয়েছিল দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা। সোমবার হয়েছিল ১ লাখ ৬৮ হাজার। মঙ্গলবার তা কমে হয় ১ লক্ষ ৬১ হাজার। বুধবার দেশে নতুন করে আক্রান্ত হলেন ১ লক্ষ ৮৪ হাজার ৩৭২ জন। এই সংখ্যা একদিনে আক্রান্তের নিরিখে সর্বোচ্চ। এই বৃদ্ধির জেরে দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা হল ১ কোটি ৩৮ লক্ষ ৭৩ হাজার ৮২৫ জন।
কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়িয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ১ হাজার ২৭ জনের। গত বছর অক্টোবরের শুরু দিকে দেশে দৈনিক মৃত্যু ১ হাজারের আশপাশে ছিল। তার পর তা কমতে কমতে ১০০-র নীচেও নেমেছিল। গত কয়েক সপ্তাহে ধারাবাহিক ভাবে বেড়ে আবার ১ হাজার ছাড়াল। এ নিয়ে দেশে করোনাভাইরাস মোট প্রাণ কেড়েছে ১ লক্ষ ৭২ হাজার ৮৫ জনের। মহারাষ্ট্রে গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ২৮১ জনের। দৈনিক মৃত্যু আচমকা বেড়েছে ছত্তীসগড়েও। সেখানকার সরকারি হাসপাতালের একটি ভিডিওতে দেখা গিয়েছে মর্গে জায়গা না থাকায় কী ভাবে মাটিতে সার দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে কোভিড রোগীদের দেহ। দিল্লিতেও বুধবার দৈনিক মৃত্যু ৮১। কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাতেও রোজ উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় মৃত্যু হচ্ছে।
লাগামছাড়া সংক্রমণের জেরে দেশে সক্রিয় রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সক্রিয় রোগী বেড়েছে ১ লক্ষেরও বেশি। এখন দেশে মোট সক্রিয় রোগী রয়েছেন ১৩ লক্ষ ৬৫ হাজার ৭০৪ জন। সক্রিয় রোগীর বৃদ্ধির জেরে হাসপাতাল, নার্সিংহোমগুলির উপর চাপ বাড়ছে প্রবল। এই সংখ্যায় রোজ রোগী বাড়তে থাকলে কী ভাবে তাদের চিকিৎসা পরিষেবা দেয়া যাবে তা নিয়েও চিন্তার উদ্রেক হচ্ছে প্রশাসনিক মহলে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন রাজ্যে কোভিড রোগীদের জন্য শয্যা বাড়াচ্ছে। কিন্তু এখন দেশে যে সংখ্যক করোনা রোগী রয়েছে দেশে আগে কখনো ছিল না।
সংক্রমণের এই শৃঙ্খল ভাঙতে রাত্রিকালীন কার্ফু জারি করেছে বেশ কয়েকটি রাজ্য। পর্যটকদের আগমনের বিধিনিষেধ চাপানো হচ্ছে বিভিন্ন রাজ্যে। মহারাষ্ট্রে বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে ‘জনতা কার্ফু’। চলবে ১ মে পর্যন্ত। সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে সেই সংক্রান্ত বিধিনিষেধের কথা মঙ্গলবার রাতে ঘোষণা করেছেন।
ভারতে দৈনিক সংক্রমণের এক তৃতীয়াংশই হচ্ছে মহারাষ্ট্রে। গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে আক্রান্ত হয়েছেন ৬০ হাজার ২১২ জন। উত্তরপ্রদেশের পরিস্থিতিও লাগামছাড়া হয়েছে গত কয়েক দিনে। সে রাজ্যে কুম্ভ মেলায় ভিড় ইতিমধ্যই ‘সুপার স্প্রেডার’ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সে রাজ্যে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ১৮ হাজার জন। ছত্তীসগঢ়ে তা ১৫ হাজার ছাড়াচ্ছে। দিল্লিতে গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত সাড়ে ১৩ হাজার ছাড়াল। যা গোটা অতিমারি পর্বে সর্বোচ্চ। কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশে আক্রান্ত সাড়ে ৮ হাজারে বেশি, কেরলে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি, তামিলনাড়ু এবং গুজরাতে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি। পশ্চিমবঙ্গেও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় এ রাজ্যে ৪ হাজার ৮১৭ জন নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন। রাজস্থানেও আক্রান্ত ৫ হাজারের বেশি। অন্ধ্রপ্রদেশে, বিহার, পাঞ্জাব, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশাতেও আক্রান্তের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। যদিও দেশে টিকাকরণ চলছে পুরোদমে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৬ লক্ষ ৪৬ হাজার ৪৯৩ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে দেশে। এখনও অবধি মোট ১১ কোটি ১১ লক্ষ ৭৯ হাজার ৫৭৮ করোনা টিকার ডো়জ দেওয়া হয়েছে দেশে।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা