বাইডেনের নীতি ও মার্কিন স্বার্থ
বাইডেন - ছবি : সংগৃহীত
বাইডেন প্রশাসন থেকে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির ফারাক বুঝতে হলে একজন ভাষ্যকার এ ক্ষেত্রে যে ফাঁক বা ব্যবধান তুলে ধরেছেন, তা অনুধাবন করা দরকার। তিনি লিখেছেন, বাইডেন বলার জন্য অনেক কিছুই বলতে পারেন। তবে সন্দেহের বিষয় হলো, বাইডেন হাঁটার দরকার হলে হাঁটবেন কি না, তা করতে পারবেন কি না। পূর্বসূরিরা জরুরি যেসব ইস্যু উপেক্ষা করেছেন কিংবা যেসব বিষয়ে অবস্থার অবনতি ঘটিয়েছেন (যেমন মধ্যপ্রাচ্য), সেগুলো মোকাবেলার মতো এনার্জি তার আছে কি না।
এমন এক প্রেক্ষাপটে, সে ভাষ্যকার আরো বলছেন, বাইডেনের প্রশাসন ইয়েমেনে লড়াই শেষ করে দেয়ার জন্য সৌদি-আরবকে চাপ দিয়ে সঠিক কাজই করেছেন। তবে একই রকম লোমহর্ষক আরেক লড়াইয়ের পীঠস্থান সিরিয়ার দিকে বাইডেন এ যাবৎ নজর দেননি। অথচ সিরিয়াতে রাশিয়া অত্যন্ত দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। বাইডেন প্রশাসন ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলেও এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হলেও তা করছে না। এই মার্কিন প্রশাসন মিসর সরকারকে মানবাধিকার ইস্যুতে সমালোচনা করছে। তবে সে মিসরের কাছেই ২০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। বাইডেনের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের সাথে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনের কথা বলছে। অন্য দিকে মনে হয় না ইসরাইলকে ইহুদি বসতি নির্মাণ বন্ধ করা কিংবা তার দখলদারির অবসান ঘটাতে চাপ দেয়ার জন্য এ প্রশাসন প্রস্তুত।
একই ভাষ্যকার আরো বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন ইরাক-আফগানিস্তানে তার সামরিক উপস্থিতির ব্যাপারে কালক্ষেপণ করছে এবং সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। সংক্ষেপে বলা চলে, জাতির নবায়নের উচ্চাকাক্সক্ষী এজেন্ডা থাকা এবং জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে সম্মতি এক কথা; অপর দিকে এসব বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেয়া ভিন্ন ব্যাপার।
জো বাইডেন সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর গত কয়েক মাসে যে আশাবাদ বিশ্বব্যাপী জেগেছিল, তার অনেকটা মিলিয়ে গেলেও এর বিরাট অংশ এখনো টিকে আছে। সম্প্রতি একদিনে মার্কিন রাষ্ট্রপতির তিনটি খবরই ছিল ইতিবাচক তথা আশাব্যঞ্জক। এগুলো হচ্ছে, ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তির ব্যাপারে নমনীয়তা, ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিপরীতে ইউনেস্কোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাবর্তন এবং অভিবাসীদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগমন বিষয়ে উদার মনোভাব। অবশ্য পরে বাইডেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতটা প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। তার সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি দৃশ্যমান ‘সাহসের অভাব’ও এর কারণ। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে তার ‘আমেরিকা উদ্ধার’ বিল পাস হয়েছে। এটা এক ধরনের প্রণোদনা প্যাকেজ। তবে তিনি আমেরিকাকে সত্যিই ‘উদ্ধার’ করবেন বলে শান্তিকামী বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা। দেখা যাক, তিনি এ ব্যাপারে কতটা করেন। এ পর্যন্ত তিনি খুব একটা করে দেখাতে পারেননি।
আমেরিকার সাথে প্রতিপক্ষ চীনের দীর্ঘ ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ ট্রাম্প আমলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। এর মাত্রা কমে আসতে পারে বাইডেন প্রশাসনের সময়ে; তবে চীন-মার্কিন ‘বাণিজ্য লড়াই’ আরো বহুদিন জারি থাকতে পারে। কারণ বাইডেন হঠাৎ করে এর থেকে পিছু হটতে পারবেন না। মার্কিন ‘জাতীয়’ স্বার্থ বলে একটা বিষয় সব আমেরিকানের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিশ্বাস করেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো স্থায়ী শত্রু বা মিত্র নেই। যা আছে, তা হলো জাতির স্বার্থ।’ ট্রাম্পের দৃষ্টিকটু বহু পদক্ষেপ এ কারণে বাইডেনকে ‘গিলতে’ হচ্ছে ইচ্ছা থাকুক কিংবা বা না থাকুক। এর মাশুলও তাকেই দিতে হবে।
আগেই ধারণা করা হয়েছিল, বাইডেন ট্রাম্পের চেয়ে ‘উদার’ ও ‘নমনীয়’ হবেন নানা বিষয়ে। তবে তিনি আপস করবেন না দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তার আত্ম সমর্থনের তো প্রশ্নই ওঠে না। বাইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন গত ৩ মার্চ নতুন মার্কিন সরকারের যে বিদেশনীতি তুলে ধরেছেন, সেটাই প্রমাণ করে সামনের ৪ বছরে আমেরিকা কোন পথে চলবে। তদুপরি, ব্লিংকেন বলে দিয়েছেন, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা কঠিন। এ কথা ট্রাম্প আমলের মার্কিন মানসিকতার ধারাবাহিকতা মাত্র এবং সেই একই রক্ষণশীল পররাষ্ট্রনীতি!
যা হোক, নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশনীতি উপস্থাপন করেছেন নয়া মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে। এর অর্থ জো বাইডেনের মনোভাব, ইচ্ছা ও আগ্রহ এর মাধ্যমে প্রতিফলিত। তার বিদেশ বা পররাষ্ট্রনীতিতে আছে ৮ বিষয়ে অগ্রাধিকার। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তিসামর্থ্য এবং প্রভাব বিস্তারের কলাকৌশল বলার অপেক্ষা রাখে না। নতুন মার্কিন নীতি মোতাবেক (অর্থাৎ জো বাইডেনের দৃষ্টিতে) চীন হলো- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ ভূরাজনৈতিক সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ। আরো উল্লেখ করা হয়েছে, ‘চীন হচ্ছে, উন্মুক্ত ও স্থিতিশীল আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রতি মারাত্মক চ্যালেঞ্জস্বরূপ এবং এ দিক দিয়ে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত শক্তির অধিকারী একক রাষ্ট্র।’ দেখা যাচ্ছে, পূর্বসূরির ন্যায় বর্তমান মার্কিন প্রশাসনও চীনকে প্রধান লক্ষ্য বানিয়েই জাতীয় নিরাপত্তার কৌশল প্রণয়ন করেছে।
জো বাইডেন পুরনো রাজনীতিক। পাঁচ মেয়াদে তিন দশকের সিনেটর ছিলেন তিনি। সাবেক রাষ্ট্রপতি ওবামার উপরাষ্ট্রপতি রূপেও ছিলেন বেশ তৎপর। এসব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক ফোরামে ফেরাতে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’। তবে ইতোমধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা বদলে গেছে। এসব ফোরামে এ সুযোগে গতানুগতিক মার্কিন স্বার্থের প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে চীনের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈ কি। এটা বাইডেনের জন্য বিরাট সমস্যা যার মূল কারণ ট্রাম্পের ‘একলা চলো’ নীতি। ট্রাম্পের সব ভুলের মাশুল হয়তো তাকে দিতে হবে।
২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি সেকুলার দৈনিক পত্রিকা লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দীর্ঘদিনের বৈরী সম্পর্কের অবসান ঘটিয়েÑ‘দু’দেশই লাভবান হবে’- এমন সম্পর্ক গড়তে চান তুরস্কের আলোচিত প্রেসিডেন্ট এরদোগান। ২০ ফেব্রুয়ারি টুইটারে ভিডিওর মাধ্যমে তিনি এ কথা বলেছেন। তার ভাষায়, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ স্বার্থগুলো উভয়ের মতপার্থক্যকে ছাড়িয়ে গেছে। আমেরিকার (প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর) নতুন প্রশাসনের সাথে নতুন করে উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক সম্পর্ক তৈরি করার ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। উল্লেখ্য, বাইডেন ক্ষমতায় এসে এরদোগানকে কোনো কিছু করেননি এ যাবৎ। স্মর্তব্য, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল বিশেষ করে বিগত আমলে অর্থাৎ ট্রাম্পের শাসনের সময়ে। কিছু বিষয়ে এ আমলেও মার্কিন চাপ বৃদ্ধি পেতে পারে জেনেও সে দেশের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে এরদোগান অভিনন্দন জানালেন। অপর দিকে তুরস্কে ছাত্র বিক্ষোভের জের ধরে ধরপাকড়ের নিন্দা এবং তুর্কি সুধীদের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ওসমান কাভালার মুক্তির দাবি জানায় নতুন মার্কিন প্রশাসন।
তাদের বক্তব্য, ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে’ বাইডেনের অঙ্গীকার কার্যকর করার অংশরূপেই যুক্তরাষ্ট্রের এহেন ভূমিকা। তুরস্ক নিজের জাতীয় স্বার্থের বিবেচনায় আমেরিকা প্রতিপক্ষ রাশিয়ার কাছ থেকে মিসাইল কিনেছে। এ বিষয়ে আমেরিকা অসন্তুষ্ট এবং এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে পারে। এ ছাড়া সম্প্রতি ইরাকে কুর্দি ‘সন্ত্রাসী’দের হামলায় ১৩ জন তুর্কি নাগরিকের প্রাণহানি হয়েছে বলে আঙ্কারা যে অভিযোগ এনেছে, তা ওয়াশিংটন প্রত্যাখ্যান করেছে। ১৫ ফেব্রুয়ারি এ কারণে তুরস্ক অভিযোগ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসের পেছনে মদদ’ জোগাচ্ছে। তুর্কি সরকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে এ জন্য ডেকে পাঠায়। যুক্তরাষ্ট্র সে দিনেই ইরাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’য় তুরস্কের নাগরিকদের মৃত্যুকে স্বীকার করে নিয়েছে। এরদোগান এমন ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়েছেন যে, ওয়াশিংটনের তা সাথে সাথে নাকচ করা কঠিন। এটা একটা পরীক্ষা।
নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন সম্প্রতি তার দেশকে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে আবার শামিল করেছেন। জলবায়ু ইস্যুতে ট্রাম্প আমলের বিপরীতে এ পদক্ষেপ নিলেন তাদের জাতীয় স্বার্থেই। তবুও ১০ মার্চের খবর, জো বাইডেনকে আসামি করে জলবায়ু প্রশ্নে ১২টি রাজ্যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মামলা করেছে ‘অর্থনৈতিক’ ক্ষতির কারণ দেখিয়ে। বাইডেন এই প্রেক্ষাপটে নিশ্চয়ই প্রতিপক্ষ রিপাবলিকানদের কাছে মাথানত না করে দৃঢ়তা ও নীতিনিষ্ঠার পরিচয় দেবেন বলে বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা। বাইডেন অনেকক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার পাশাপাশি বহু দিক দিয়ে ট্রাম্পের পদক্ষেপগুলোর ধারাবাহিকতা বা ভারসাম্য বজায় রাখছেন বলে প্রতীয়মান হয়েছে। জলবায়ু ইস্যু প্রমাণ করে, বাইডেনের নিজের মতাদর্শ অনুযায়ী যা উত্তম, তা-ই করা প্রয়োজন। অন্যথায় তিনি আপসকামী হয়েও এবং ছাড় দিলেও প্রতিপক্ষের চাপ ও আপত্তি, বিরোধিতা ও সমালোচনা এড়াতে পারবেন না।