মিয়ানমার : ক্যুর প্রতিবাদ ও দমনপীড়ন
মিয়ানমার : ক্যুর প্রতিবাদ ও দমনপীড়ন - ছবি : সংগৃহীত
মিয়ানমারে সামরিক কমান্ডার অভ্যুত্থান তথা ক্যু করে দেশের ক্ষমতা জবরদখলের পর প্রায় দুই মাস হতে চলল, তাদের দমননীতি হ্রাস পাওয়ার লক্ষণ নেই। ইতোমধ্যেই শ’ দুয়েকের বেশি বিক্ষোভকারীকে প্রাণ দিতে হয়েছে সেনা জান্তার বিরোধিতা করায়। জান্তা যত কঠোর ততই আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা মিয়ানমারের ওপর। কিন্তু এতে জনগণ দুর্ভোগ পোহাক আর না-ই পোহাক, দৃশ্যত জান্তার কোনো ‘হেল দোল’ নেই। এর একটা বড় কারণ, তাদের পেছনে প্রতিবেশী বৃহৎ শক্তি চীনের মদদ এবং আরেক বৃহৎ পড়শি ভারতের আনুকূল্য। তা ছাড়া বৃহৎ শক্তি রাশিয়াও বর্তমান মিয়ানমার সরকারের পক্ষে। ফলে পশ্চিমাদের যাবতীয় হুমকি ও কঠোরতা কার্যত অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। এ দিকে দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে রোহিঙ্গা ইস্যুর সুরাহা হওয়া। আর মিয়ানমারে গণতন্ত্রের ভবিতব্য কি, কেউ জানে না।
মিয়ানমার সরকারের কঠোরতাকে ভয় না পেয়ে গণতন্ত্রকামী জনতা বিক্ষোভ করে যাচ্ছে। সর্বশেষ গত ২১ মার্চও সাবেক রাজধানী ও বর্তমান ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী’ মান্দালয়ে কয়েক শ’ ডাক্তার ও নার্স বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষোভ প্রদর্শিত হচ্ছে প্রধানত ক) সেনা সরকারের বিদায়, খ) সু চিসহ নেতা ও নেত্রীদের মুক্তি এবং গ) আগের নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে।
২৩ মার্চ মঙ্গলবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বৈঠকে বসার কথা ধারণা করা হয়েছে, এ বৈঠকে মিয়ানমার দেশটির ১১ জন সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে। পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) জানায়, এ যাবৎ প্রায় আড়াই শ’ বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। গ্রেফতার ২৩০০।
ফেব্রুয়ারির পয়লা দিনেই সেনাবাহিনী মিয়ানমারে আবার ক্ষমতা দখলের পর এক দিকে দেশব্যাপী এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন এবং অপর দিকে শাসকগোষ্ঠীর কঠোর হত্যাসহ দমন তৎপরতা- দুটাই অব্যাহত রয়েছে। ‘গণতান্ত্রিক নেতা’ অং সান সু চি এবং তার প্রধান সহকর্মীরা এখনো বন্দী। তাদের নামে একের পর এক মামলা দিয়ে বিচারের নামে হয়রানি ও নির্যাতনের পাঁয়তারা চলছে মিয়ানমারে।
লন্ডনের ‘সানডে অবজার্ভার’ পত্রিকার ভাষায়, ‘লালবেলুন আর রিবনে শুরু হয়েছিল ক্যুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের নীরব প্রতীক। এরপর সসপ্যান ও থালাবাটির বাজনা। এসব ব্যবহার করা হয় শয়তান তাড়াতে। ১ ফেব্রুয়ারির প্রাথমিক ধাক্কা মিলিয়ে যাওয়ার সাথে রাজপথে বিক্ষোভ শুরু হয়ে গেল। ...
প্রতিবাদের ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। ব্যাপক অংশগ্রহণে এবং সাহসের সাথে তা ঘটছে। এতে স্বতঃস্ফূর্ততা ও আবেগের কমতি নেই এবং তা বিদ্রোহের মনোভাবপূর্ণ। ... বিভাজনের এক দিকে তরুণ, ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক, ভিক্ষু, গৃহকত্রী, শিল্পী, রাজনীতির লোকজন, সরকারি কর্মচারী এবং নির্বাচন সংশ্লিষ্ট মানুষেরা। তাঁদের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের আশাকে অভ্যুত্থানের নেতা অংমিন হ্লাইংয়ের উচ্চাকাক্সক্ষা ও স্বার্থপর বা সবার কাছে এবং ইতিহাস বিস্মৃতি ও কর্তৃত্ব পরায়ণতার কাছে বিসর্জন দেয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রতিবাদের ধরন পৌঁছেছে নিরাপত্তা বাহিনীকে তিন আঙুলে স্যালুট দেয়া পর্যন্ত।
এখানে যে বিভাজনের কথা বলা হলো, তার অন্য দিকে কারা? জেনারেলরা তথা মিয়ানমারের সশস্ত্রবাহিনী। তাদের দেশটার প্রকৃত শাসক ও জাতির স্বঘোষিত অভিভাবক বলা হয়। সামরিক কর্তা ব্যক্তিদের সুবিধা হলো, ‘অভিজাত’ ঊপড়হড়সরপ চড়বিৎ ইৎড়শবৎ রা তাদের পেছনে আছেন। ২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে ‘গণতন্ত্রের কন্যা’ অং সান সু চি তার দল এনএলভিসহ অগ্রবর্তী থাকায় দীর্ঘকালের শাসক জান্তা সাময়িকভাবে পিছু হটেছিল মাত্র। অদৃষ্টের পরিহাস, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ভূমিকা ও কর্তৃত্বের সূচনা হয়েছিল সু চির পিতা জেনারেল অং সানের মাধ্যমেই। এখন সেই বাহিনীর উর্দিধারীরা খোদ সু চির দলের লোকজনকে ধরছে, মারছে এবং আসামি বানাচ্ছে। তার পিতাও (দেশের স্বাধীনতার ঊষালগ্নে) নিহত হয়েছিলেন সহকর্মীদের হাতেই।
এখন অনেকেই বলছেন, গণতন্ত্রের কথিত কন্যা সু চি নিজ দেশেই সামরিক বাহিনরি উগ্র স্বাজাত্যবোধ, চরম সংকীর্ণ নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদ আর রোহিঙ্গা নিধনে মদদ দিয়ে এবং তাদের যাবতীয় অন্যায়ের পক্ষে ওকালতি করে, কী ফয়দা হলো? ‘যাদের জন্য চুরি করি, সে না বলে চোর।’ কথাটা সু চির বেলায় মহাসত্য। কারণ তিনি দৃশ্যত নিজের রাজনৈতিক স্বার্থেই সশস্ত্রবাহিনীর সব বর্বরতাকে বৈধতা দিয়ে এর সাফাই গেছেন ইউরোপে হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়ে। অথচ এখন সে বাহিনীর জান্তাই তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে, বন্দী করেছে, আসামি বানিয়েছে। ভোট চুরি ও জালিয়াতির দায়ে কাঠগড়ায় তুলছে, তার দলের অফিসে হামলা চালিয়েছে এবং তার নেতৃত্বাধীন পার্লামেন্ট বাতিল করে দিয়েছে। এ জন্য ক্ষোভে দুঃখে বলা হচ্ছে, সু চি নিজের কাঁধে নিজেই আটকা পড়েছেন এবং এত দিনে তার ‘প্রাপ্য’ পেলেন। আরো কত প্রাপ্য তাকে পেতে হবে কেউ জানে না।
মিয়ানমারে যেভাবে বর্বরতার সাথে গণতন্ত্রের সপক্ষ শক্তি, তথা মানুষকে দমানো হচ্ছে গ্রেফতার, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে, তাতে বলা চলে সেনা কর্মকর্তারা প্রতিশোধের জন্য এমন একটা সুযোগের প্রতীক্ষায় ছিলেন। কারণ ২০১৫ সালের নির্বাচনে তারা যতটা অবশিষ্ট সুযোগ ও সুবিধা পেয়েছেন, এবারকার নির্বাচনে সেটাও হারাতে বসেছিলেন। এর কারণ তাদের পছন্দের দলটির অধিকতর বিপর্যয়। এবারের সামরিক অভ্যুত্থানের হোতা এবং রোহিঙ্গা নির্যাতনের দায়ে যুদ্ধাপরাধীরূপে অভিযুক্ত, সেনাপ্রধান জেনারেল অং সিন হ্লাই; বলেছেনÑ বিগত নভেম্বরের নির্বাচনে সু চির দল) ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি বা এনএলডির ভূমিধস বিজয়ের কারণ তাদের ‘প্রতারণা’। তবে তার এ দাবি অনেকের বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। কেন না, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ওপর জনগণের আর আস্থা নেই। জনসাধারণ মনে করছে, রাজনীতিকদেরই রাজনীতি করা উচিত; সেনাবাহিনী কেন তাদের আসল কাজ ফেলে এটা করবে?
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য (ঐতিহ্যবাহী নাম ‘আরাকান’) সুদূর অতীত থেকে প্রতিবেশী বাংলাদেশের মানুষের কাছে পরিচিত ‘মগের মুল্লুক’ হিসেবে। বাস্তবে কেবল রাখাইন নয়, গোটা বার্মা বা মিয়ানমার দেশটাই যেন ‘মগের মুল্লুক’। না হলে সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর অবর্ণনীয় বর্বরতা তো আছেই, তদুপরি দেশটার জন্মলগ্ন থেকেই সেনাবাহিনী রাজনীতি ও রাষ্ট্র চালনার বিশেষ অধিকার, তথা ইচ্ছা মতো হস্তক্ষেপের সুযোগ ভোগ করে কিভাবে? সশস্ত্রবাহিনীর কর্তারা সংবিধানটা ওভাবে বানিয়ে নিয়েছেন ইচ্ছা মতো। স্বাধীনতার পর ৭১ বছরের বেশির ভাগই তারা দেশ শাসন করেছেন। এর অর্থ বার্মার সেনাবাহিনী বিদেশের নয়, নিজ দেশের সাথেই এক ধরনের লড়াইয়ে লিপ্ত। ‘যার কাজ, তাকেই সাজে’। এটা বর্মী সেনাবাহিনীর সাথে রাজনীতি (সেই সুবাদে অর্থনীতির বিপুল সুফল উপভোগ) করাও তাদের সবিশেষ অধিকার! অতএব, সমাজ সংস্কৃতিও তাদের ওপর নির্ভরশীল মিয়ানমার বা বার্মা বিশ্বের সর্বাধিক উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র। আর সে দেশের লাখ লাখ মুসলিম রোহিঙ্গা নাগরিকত্ব না থাকায় দুনিয়ার মধ্যে সর্বাধিক দুর্ভাগা। সে দেশের সংবিধানে অদ্ভুত নিয়ম রয়েছে, প্রতিরক্ষা তো বটেই- স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত সংক্রান্ত মন্ত্রণালয় দুটোও সশস্ত্রবাহিনীর হাতে থাকবে। তা ছাড়া পার্লামেন্টের বিরাট অংশ থাকবে সামরিক ইউনিফর্ম পরিহিত ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণে। এসব বিবেচনায় তারা বাধ্য হয়ে সামরিক পশ্চাদপসারণ করেন ২০১৫ সালে। তবে আবার ‘যথাসময়ে’ গত ১ ফেব্রুয়ারি আবির্ভূত হলেন ক্ষমতার রাজনীতি লোভনীয় রঙ্গমঞ্চে। দেশকে সশস্ত্রবাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিরা কোথায় নিয়ে যেতে চান, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
১ ফেব্রুয়ারির অপত্যাশিত অভ্যুত্থানে কেবল জনগণের শাসন নয়, এখন সব দেশবাসী ও মিয়ানমার দেশটাই বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা জেগেছে। একে তো সু চিসহ নেতৃস্থানীয় রাজনীতিকরা আটক, তদুপরি সিভিল সোসাইটির কয়েক শ’ নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। নিরাপত্তা বাহিনীই জনগণের চরম নিরাপত্তাহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিডিয়ার খবর, তারা মানুষকে গভীর রাতে এসে টেনে-হেঁচড়ে ঘর থেকে নিয়ে যাচ্ছে। জারি রয়েছে সান্ধ্যআইন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মারাত্মক সঙ্কোচন ঘটেছে। মোবাইল-ইন্টারনেট ফেসবুক এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তবে এসব কিছুর পরিণামে হয়তো অজানা কোনো ট্র্যাজেডি রয়েছে মিয়ানমারের বরাতে।
‘নানা মুনির নানা মত’। কেউ বলছেন, সু চি বেশি ঝুঁকে পড়ছিলেন পাশ্চাত্যের প্রতি। তাই আগের চীন এ ক্যু ঘটিয়েছে। কেউবা বলেছেন, সু চি চীনের সাথে মিলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কাজ করছিলেন, যা সেনাকর্তাদের মনোপুত হয়নি। তবে এটা সত্য, বেইজিং মিয়ানমারের অভ্যুত্থানে মোটেও নাখোশ নয় এবং এটা তাদের গা বাঁচানো প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট। ক্যু’র বেনিফিসিয়ারিও চীনই। চীনের চাপে অভ্যুত্থানটি হোক বা না হোক, তাদের তোয়াজ করা ছাড়া মিয়ানমার সশস্ত্রবাহিনীর উপায় নেই। এ দিকে চীনা শিল্প প্রতিষ্ঠানে বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন দিচ্ছে।
দিন দিন দেশে-বিদেশে আন্দোলন ও প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সমালোচনা জোরালো হয়ে উঠছে মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। চীন-রাশিয়ার প্রত্যাশিত আপত্তি সত্ত্বে¡ও জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার সংস্থা প্রস্তাব গ্রহণ করে বলেছে, মিয়ানমারে সু চি ও অন্যদের মুক্তি দিতে হবে, সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। বাতিল হওয়া পার্লামেন্ট পুনর্বহালের দাবিতে দেশ-বিদেশ খুব সোচ্চার। আমেরিকা মিয়ানমারের কিছু ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং সে দেশে মিয়ানমারের এসব লোকের সম্পদ জব্দ করেছে। তবে বৃহত্তর অবরোধই এখন প্রয়োজন আন্তর্জাতিকভাবে। তা ছাড়া দরকার সামগ্রিক অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা এবং মিয়ানমারের জেনারেলরা যেন ‘বাণিজ্যি’ করতে না পারেন।