ইরান যাবে আর কত দূর?

মীযানুল করীম | Apr 14, 2021 01:23 pm
ইরান যাবে আর কত দূর?

ইরান যাবে আর কত দূর? - ছবি : সংগৃহীত

 

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বাইডেন আমলে প্রত্যাশামাফিক ‘কিঞ্চিৎ স্বস্তিকর’ হয়েছে। তবে দেশ দু’টির মধ্যে পরমাণু চুক্তি নিয়ে মতভেদ এখনো দূর হয়নি। তেহরান বলেছে, আগে মার্কিন অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়া হোক, এরপর ইরান চুক্তি মেনে চলবে। এর বিপরীতে ওয়াশিংটন বলছে, আগে ইরান পরমাণু চুক্তি পুরো মেনে চলুক, তারপর আমেরিকা তার করণীয় নির্ধারণ করবে।’ স্মর্তব্য, ২০১৫ সালে ইরানের সাথে পাঁচ বৃহৎশক্তি এবং সেই সাথে জার্মানি বহুলালোচিত পরমাণু চুক্তি করেছিল তা থেকে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করেছিল। মূলত ইসরাইলি স্বার্থরক্ষার উদ্দেশ্যে এবং প্রভাবশালী ইহুদি লবির চাপেই বিগত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর করেছেন। কিন্তু এতে আমেরিকার কী লাভ হয়েছে?

অতীতে ইরানের পরিচিতি ছিল ‘আমেরিকার তাঁবেদার’ হিসেবে। সেটা এক সময়ের শাহ আমলের কথা। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ‘ইসলামী বিপ্লব’ সংঘটিত হলে ‘গনেশ উল্টে যায়’। তখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানি জনগণের দৃষ্টিতে ‘শয়তানে বুজর্গ’ (বড় শয়তান) আর ইসরাইল ‘ছোট শয়তান’ নামে পরিচিত। ’৭৯ সালের পর ইরান-আমেরিকা সম্পর্কের ক্রমে অবনতি ঘটে। এ অবস্থায় ইরানি তরুণরা দীর্ঘদিন তেহরানের মার্কিন দূতাবাস অবরোধ করে রেখেছিল। এর বিপরীতে আমেরিকা ইরানে Regime Change-এর লক্ষ্যে ইসরাইলের সহায়তায় একের পর এক জোরালো প্রয়াস চালিয়েছিল। এক পর্যায়ে ইরাক-ইরান রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৮ বছর কেটে যায়। অপর দিকে ইরানের যাত্রীবাহী বিমান রহস্যজনক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। অভিযোগ ওঠে, আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই বিমানটিকে মিসাইল মেরে ভূপাতিত করেছিল। এভাবে দীর্ঘ প্রায় দুই দশকের ‘বাঘে-মোষে’ সম্পর্কের পর ইরানের পরমাণু শক্তি তথা এর চুল্লি বা রি-অ্যাক্টর নিয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের বিরূপ প্রচারণা শুরু হয়ে যায়। ইরান পারমাণবিক বোমা বানাচ্ছে এবং এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক আইন-কানুন লঙ্ঘিত হচ্ছে- এটাই পশ্চিমাদের বক্তব্য। জবাবে ইরান বলে এসেছে, বোমা নয়, নিছক ‘শান্তিপূর্ণ’ কাজে- যেমন স্বাস্থ্য, কৃষি, বিদ্যুৎ, বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে- প্রয়োগের উদ্দেশ্যেই ইরান পরমাণু তৎপরতা চালিয়ছে, অর্থাৎ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে।

অনেকে মনে করেন, কোনো মুসলিম রাষ্ট্র- বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের কোনো মুসলিম দেশ- পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হোক, এটা আমেরিকা-ব্রিটেন-কানাডা-ফ্রান্সসহ পাশ্চাত্যের কেউ চায় না। ইরানে নিয়মিত নির্বাচনের পন্থায় ইতোমধ্যে কয়েক বার সরকার এসেছে এবং যথানিয়মে বিদায় হয়েছে; তবে পরমাণু ইস্যুতে তার তীব্র বিরোধিতা প্রাশ্চাত্য দুনিয়া বন্ধ করেনি। বরং জাতিসঙ্ঘের সংশ্লিষ্ট সংস্থা আইএইএ (আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা)কে দিয়েও বারবার তদন্ত তল্লাশি, অনুসন্ধান, পরিদর্শন, প্রভৃতি করা হয়েছে। তবে ইরানকে অপরাধী সাব্যস্ত করার জন্য তেমন তথ্য প্রমাণ মেলেনি এ নিয়ে। তবুও তেহরান এ ইস্যুতে বরাবর ক্রমবর্ধমান চাপে ছিল, প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে। অবশেষে ২০১৫ পাঁচ বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া এবং জার্মানি মিলে যৌথ পদক্ষেপ নিতে একটি চুক্তিতে উপনীত হয় ইরানের সাথে। ইরান দৃশ্যত সে মোতাবেক নিয়ন্ত্রিত কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। তবে ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে উগ্রপন্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প জিতে ক্ষমতায় গেলে ইরানের ব্যাপারে আমেরিকার সন্দেহ ও সমালোচনা অনেক বেড়ে যায়। ট্রাম্প প্রধানত ইহুদি লবি দ্বারা পরিচালিত হতেন এবং তার আপন জামাতা ও উপদেষ্টা জ্যারেড কুশনার একজন ইহুদি। এ অবস্থায় যা হওয়ার তা হলো।

ইরান চুক্তি ‘মানছে না’ অজুহাতে ট্রাম্প তার দেশকে সে পরমাণু চুক্তি থেকে বের করে আনলেন। এতে আমেরিকার অনেক ইউরোপীয় মিত্র এবং বিশেষত চীন-রাশিয়ার সম্মতি ছিল না। অপর দিকে পরমাণু চুক্তি থেকে ট্রাম্পের আমেরিকা বের হওয়ার পর ইরান ঘোষণা দিলো, ‘এখন থেকে ইরানও চুক্তির বাধ্যবাধকতার অধীনে আর নেই। যেহেতু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে পরমাণু চুক্তি থেকে সরে গেছে, তাই ইরানও আর এটা মানতে বাধ্য নয়।’ অবশ্য পাশ্চাত্যের কয়েকটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র ইরানকে এ চুক্তি থেকে সরে না যেতে সনির্বদ্ধ অনুরোধ করেছে। ইরান তার ‘প্রয়োজনীয়’ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে গিয়ে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাধার সম্মুখীন হয়েছে। যা হোক, বাইডেন প্রশাসন ইরানের বিষয়ে নমনীয় হবেন বলে অনেকেই আশাবাদী। আসলে পারস্পরিক সন্দেহের ঊর্ধ্বে উঠে, একে অন্যকে আস্থায় নেয়া ছাড়া এ সঙ্কটের অবসান হবে না। অন্যথায় ইরান পরমাণু চুক্তিকে উপেক্ষা করবে এবং ফররুখজাদেহর ন্যায় আরো পরমাণু বিজ্ঞানীকে হয়তো হারাতে হবে।

ইরান এমনিতেই দৃশ্যত যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী নীতির দরুন পাশ্চাত্যে সমালোচিত, তুদপরি ক্রমে শক্তিশালী আঞ্চলিক শক্তি হয়ে ওঠায় তেহরান এখন কিছু মুসলিম দেশের সরকারগুলোরও চক্ষুশূল। বর্তমান ইরান বিপ্লবের বাণী দিয়ে সারা বিশ্বে বিশেষ করে তরুণ সমাজের মাঝে সংগ্রামী অনুপ্রেরণা জাগিয়েছিল অতীতে। সময়ের সাথে সাথে দেশটির জাতীয় সমস্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট অনেকটা বদলে গেছে। ফলে ইরানের রাজনৈতিক প্রভাব বলয় বাড়লেও তার বৈপ্লবিক ভাবগতি সে অনুপাতে বাড়েনি। এ ছাড়া আগে থেকেই মুসলিম উম্মাহর সুন্নি বনাম শিয়া বিতর্কে সংখ্যালঘু শিয়া অধ্যুষিত ইরানকে ‘অন্য দৃষ্টিতে’ দেখা হয়েছে। তুদপরি, গত কয়েক দশকে ইরানের ‘বিপ্লব রফতানি’ কমে গিয়ে এবং প্রভাব বৃদ্ধির প্রয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ইরান অনেকটা সাফল্য পেলেও মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি-ইরান দ্বন্দ্বের তীব্রতায় তেহরান নানামুখী বিরোধিতার সম্মুখীন কম হয়নি।

ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো মধ্যপ্রাচ্যে প্রধানত, ‘শিয়াবেল্ট’ নিয়ে স্বীয় কর্তৃত্ব বিস্তার এবং এ জন্য বিভিন্ন বাহিনী দিয়ে চৎড়ীু ডধৎ জারি রাখার। সাধারণত ইরানবিরোধী মহল এবং মার্কিন প্রতারিত শক্তি এ অভিযোগ এনে থাকে। বলা হয়েছে, ইরান প্রতিবেশী ইরাক থেকে শুরু করে সুদূর ইয়েমেন পর্যন্ত- সিরিয়া, লেবানন, কুয়েত, বাহরাইন, সৌদি আরব হয়ে- বিরাট এলাকাজুড়ে শিয়াদের মাধ্যমে ‘বাহিনী’ বানিয়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য সশস্ত্র পন্থায় লিপ্ত। এর সত্যতা অনেখানি থাকলেও অস্বীকার করা যায় না যে, মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইরানকেই ইহুদিবাদী ইসরাইল তার ‘সবচেয়ে বড় দুশমন’ ভেবে থাকে।

এর কারণ ফিলিস্তিন প্রশ্নে এবং মার্কিন আগ্রাসন ইস্যুতে ইরানের নিরপক্ষ মনোভাবের দৃঢ়তা। পাশের দেশ ইরাকে ইরান প্রভাব সৃষ্টির জন্য সাদ্দাম আমলের পর থেকেই সক্রিয়। এ ক্ষেত্রে তার সফলতার পাশাপাশি মাশুলও কম দিতে হয়নি। যেমন বছর খানেক আগে বাগদাদ বিমানবন্দরে আকস্মিক মার্কিন মিসাইল হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক ব্যক্তিত্ব জেনারেল কাসেম সোলেমানি নিহত হন ইরাকের শিয়া মিলিশিয়ার একজন নেতাসহ। সিরিয়ায় ইরান আর রাশিয়া মিলে একনায়ক বাশার আল আসাদ সরকারকে টিকিয়ে রাখলেও এতে ইরানের ইমেজ বাড়েনি। বরঞ্চ তেহরান তার শিয়ামিত্র বাশারকে বাঁচাতে গিয়ে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লেবাননের ‘হিজবুল্লাহ’ মিলিশিয়াকে ইরান পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে কিছু বিজয় অর্জন করেছে। তবে কুয়েত, বাহরাইন, সৌদি আরবের মতো রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু শিয়াদের পক্ষাবলম্বন করে ইরান নানা সমস্যায় পড়েছে। অবশ্য ইয়েমেনের জায়েদি শিয়াদের অর্থাৎ বিদ্রোহী ‘হুতি’ বাহিনীকে সমর্থন দিয়ে সৌদি আরবের ক্ষতি করার ক্ষেত্রে ইরান বেশ কিছুটা সফল। কিন্তু এতে মুসলিম উম্মাহর সঙ্কট কমেনি। ইরান প্রতিবেশী শিয়া রাষ্ট্র আজারবাইজানের ঘনিষ্ঠ নয় বলে সম্প্রতি সুন্নি তুরস্ক আজেরিদের ত্রাণকর্তার ভূমিকায় নেমেছিল। এটা ইরানের নিঃসন্দেহে ব্যর্থতা।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us