সাইবার হামলা ও পরমাণু চুক্তির নতুন সমীকরণ
সাইবার হামলা ও পরমাণু চুক্তির নতুন সমীকরণ - ছবি : সংগৃহীত
ইরানের নাতাঞ্জ পরমাণু কেন্দ্রে সম্প্রতি সাইবার হামলা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহের তীর ছুটেছে ইসরাইলের দিকে। ইসরাইল সেই তীরকে পাত্তা না দিয়েই প্রকাশ্যে এই ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।
ইসরাইলি বেতার বলছে, নাতাঞ্জের পরমাণু কেন্দ্রে সাইবার হামলায় মোসাদ প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। গত বছরের জুলাই মাসেও নাতাঞ্জে এমন হামলা হয়েছিল।
ইসরাইলের দিকে তীর ছুটে কেন?
ইসরাইল প্রকাশ্যেই ঘোষণা করে থাকে যে ইরানের পরমাণু প্রকল্পের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে রুখে দিতে তারা সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাবে। বছরের শুরুর দিকে ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, 'ইরান পরমাণু অস্ত্র পেতে আগ্রহী। এটা পরিষ্কার যে ইসরাইলকে সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।'
২০১৫ সালে বহুল আলোচিত নিউক্লিয়ার ডিল স্বাক্ষর হলে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু জাতিসঙ্ঘে দেয়া এক ভাষণে বলেছিলেন, 'ইরানি শাসক আমার দেশকে ধ্বংস করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তারা আমার জনগণকে হত্যা করেছে। এখন হয়ত আপনারা বুঝতে পারছেন ইসরাইল কেন এই ডিল উদযাপনে শরিক হচ্ছে না।'
ইসরাইল কেন এত সক্রিয়?
নিউক্লিয়ার ডিলের পূর্বে ইরান যে পরিমাণ ইউরোনিয়াম মজুদ করেছিল তা দিয়ে অনায়াসে ৮-১০টি পরমাণু বোমা তৈরি করতে পারতো। যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া এই তথ্যে আরও বলা হয়েছিল ইরান চাইলে ২-৩ মাসের মধ্যে বোমা তৈরি করতে পারবে। এই সময় সীমাকে বলা হতো 'ব্রেক-আউট টাইম'।
চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ইরানের এই ব্রেক আউট টাইম বাড়িয়ে দেয়া। বুঝতে বাকি থাকে না ইসরাইল সাইবার হামলার মাধ্যেম এই ব্রেক-আউট টাইমকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে।
২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ালে ইরান পুনরায় ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেয়। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা প্রকাশিত স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা যায় ইরান নাতাঞ্জ কেন্দ্রের কাছে নতুন একটি ভূ-গর্ভস্থ চুল্লি নির্মাণ করেছে।
২০২১ সালের মার্চ মাস ইরান পুনরায় ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধি ও সেন্ট্রিফিউজ তৈরি বাড়িয়ে দেয়। ১০ এপ্রিল ইরান নতুন করে অত্যাধুনিক সেন্ট্রিফিউজ তৈরি কাজ শুরু করে। পর দিনই দুর্ঘটনা ঘটল। প্রথমে এই ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলা হলেও ইরান এখন একে সাইবার সন্ত্রাস বলেই অভিহিত করছে। যথাসময়ে এর জবাব দেয়া হবে বলেও হুমকি দিয়েছে ইরান।
নতুন করে পরমাণু ডিল নিয়ে ভিয়েনায় আলোচনা চলছে। বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইরানের সাথে চুক্তিতে ফেরার ব্যাপারে ইতিবাচক সুর শোনা যাচ্ছে।
ইসরাইল বাইডেনকে আটকাতে চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক। ট্রাম্পকে চুক্তি বাতিলে ইসরাইলি লবি বিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল এমন খবরও আমরা জানি৷ মজার ব্যাপার হল এই সাইবার হামলা এমন এক সময়ে হলো যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লর্ড অস্টিন ইসরাইল সফরে রয়েছেন।
সাইবার হামলার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ইরানের ৯ মাস সময় লাগবে। কেন্দ্রটি গত বছরের জুলাই মাসে হামলার ক্ষতিও পুরাপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। নাতাঞ্জ হলো ইরানের প্রধান পারমাণবিক কেন্দ্র।
সাইবার হামলা নতুন কিছু নয়
এই বছরের শুরু থেকেই ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরে ইসরাইল ইরানের ডজনখানেক জাহাজে আক্রমণ চালিয়েছে। এ বছরে দিল্লির ইসরাইলি দূতাবাসের সামনে বিস্ফোরণের জন্য ইরানকে সন্দেহ করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, ইরান ও ইসরাইলের মধ্যকার সাইবার হামলা নতুন কিছু নয়। ২০০৬ সালে জর্জ বুশ অলিম্পিক গেম নামে সাইবার হামলা চালান। ২০০৯ সালে বারাক ওবামাও একই কাজ করেন। ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের যৌথ প্রচেষ্টায় তৈরী স্টুক্সনেট ওয়ার্ম দিয়ে নাতাঞ্জ কেন্দ্রে সাইবার হামলা চালানো হয়েছিল।
স্টুক্সনেট এতই শক্তিশালী যে এক আঘাতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলতে থাকে এবং ইউরোনিয়াম সমৃদ্ধকরণের স্থাপনায় বড় ধ্বংস সাধন করে, সেন্ট্রিফিউ ভেঙে ফেলে। এক তথ্য মতে, ২০০৯-১০ সালে সাইবার হামলায় ইরানের পরমাণু প্রকল্প ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ১০০০ সেন্ট্রিফিউজ নষ্ট হয়।
ওবামা প্রশাসনের দেয়া তথ্য মতে, এর ফলে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি দুই বছর পিছিয়ে যায়। ২০২০ সালে ইরানের বন্দর আব্বাস বন্দরের কাছে শহীদ রাজি টার্মিনালে সাইবার হামলা চালায় ইসরাইল। আল জাজিরার শিরোনাম করেছিল, 'Israel cyberattack caused total disarray at Iran port.'
সাইবার হামলায় ইসরাইল কেন পারদর্শী?
সাইবার নিরাপত্তা খাতে ইসরাইল একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেছে। দেশটির স্কুল পাঠ্যে সাইবার নিরাপত্তা যুক্ত করা হয়েছে। ২০১৪ সালে টাইমস অব ইসরাইল-এর তথ্য মতে, সাইবার গবেষণায় ইসরাইলের স্কুলগুলো শীর্ষ স্থান দখল করেছে।
সাইবার নিরাপত্তার ওপর অনলাইন কোর্স পরিচালনায় তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান সবার ওপরে। বর্তমানে দেশটির ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইবার নিরাপত্তার ওপর গবেষণা সেল আছে। অবাক করা তথ্য হল ইসরাইল হল প্রথম দেশ যেখানে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি দেওয়া যায়।
উল্লেখ্য, দেশটিতে সাইবার নিরাপত্তাকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি বিষয় হিসেবেই পড়ানো হয়। কম্পিউটার বিজ্ঞানের কোনো বিষয় হিসেবে নয়। এমনকি মাধ্যমিক স্কুলে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে সাইবার নিরাপত্তা পড়ানো হয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে Forbes ম্যাগাজিনে প্রকাশিত '6 Reasons Israel Became a Cybersecurity Powerhouse leading the $ 82 Billion Industry' পড়তে পারেন।
সাইবার নিরাপত্তায় ইরানের পদক্ষেপ
২০০৬ ও ২০১০ সালে স্টুক্সনেট ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর ইরান সাইবার নিরাপত্তা জোরদারে কাজ শুরু করে। IRGC এর বাসিজ মিলিশিয়া এই কাজের জন্য যুবকদের সংগ্রহ করে। সাইবার হিজবুল্লাহ নামে একটি দলও গঠিত হয়েছে।
২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিজনেস ইনসাইডার -এ নাতাশা বারট্রান্ড একটি আর্টিকেল লিখেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ৫ বছর আগে ইরানের বর্তমান অবস্থান কেউ কল্পনা করতে পারেনি।' সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ডেভিড কেনেডি বলেছেন, 'একসময় ইরানকে সাইবার ইস্যুতে পাত্তাই দেয়া হতো না, কিন্তু এখন ইরানের সক্ষমতা রাশিয়া ও চীনের কাছাকাছি পৌঁছেছে।'
অনেকেই ইরানের পরমাণু কর্মসূচির চেয়ে সাইবার সক্ষমতাকে বড় হুমকি হিসেবে বর্ণনা করছেন। ইরান ধীরে ধীরে এই খাতে ব্যয়ও বৃদ্ধি করছে। বর্তমানে এই খাতে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দেয়া হয়।
২০১৯ সালে ইরান যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন ব্যাংক ও গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় সাইবার হামলা চালায়। এক তথ্য মতে, ২০১৯ সালে ইরান ৩৩ মিলিয়ন সাইবার আক্রমণ নিউট্রালাইজ করেছে। ফোর্বসের দেয়া তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার অবকাঠামোতে হামলা চালানোর মূল নায়ক ছিলেন কাসেম সুলাইমানি।
নাতাঞ্জের হামলা ও পরমাণু চুক্তির নতুন সমীকরণ
ভিয়েনায় নতুন করে পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন ইসরাইলের এই হামলা ইরানকে দুর্বল করতেই করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেছেন, ইসরাইল খুবই জঘন্য বাজি ধরেছে যা উজ্জীবিত পরমাণু চুক্তির আলোচনায় ইরানের হাতকেই শক্তিশালী করবে৷
নতুন করে শুরু হওয়া পরমাণু চুক্তির আলোচনা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। এবারের আলোচনায় পরমাণু প্রকল্পের পাশাপাশি ইরানের মিসাইল প্রকল্প নিয়েও আমেরিকা আলোচনা করতে চায়। এ ব্যাপারে ইরান অবস্থান স্পষ্ট করেছে।
ইরান বলছে, মিসাইল ইস্যুতে আরব দেশগুলোর সাথে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু ইইউ বা আমেরিকার সাথে এ নিয়ে তারা কোনো আলোচনা করবে না। এমন নানা ইস্যু নিয়েই চুক্তির ব্যাপারে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে।
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পুরনো পরমাণু চুক্তিতে যোগ দেওয়া অর্থহীন। 'পরমাণু চুক্তি প্লাস'ই হলো সমাধান। একই মতামত দিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের পরমাণু সংস্থার প্রধান রাফায়েল গ্রসি। তিনি মনে করেন,'নতুন চুক্তির প্রয়োজন তৈরি হয়েছে।'
দীর্ঘ অবরোধে ইরানের অর্থনীতির দৈন্য দশা কারো অজানা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ প্রত্যাহার হলে দেশটির অনেক সুবিধা হবে এটা সত্য। তবে ইরান শক্ত অবস্থানে থেকে দরকষাকষি করবে এটা বুঝতে পারা যায়। সম্প্রতি চীনের সাথে ৪০০ বিলিয়নের চুক্তি এ ক্ষেত্রে ইরানকে শক্তি জোগাবে সন্দেহ নেই।
নতুন করে শুরু হওয়া আলোচনার আশু কোনো সমাধান প্রত্যাশা করা উচিত হবে না। চুক্তি ঠেকাতে ইসরাইলের তৎপরতা, সাইবার হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরানের হুমকি প্রদর্শন সব কিছু মিলিয়ে সামনের দিনে ইরান ইস্যু বারবার উত্তাপ ছড়াবে। ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের রেষারেষি কি রয়ে যাবে, না এর ইতি ঘটবে তা দেখতে আরো কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে?