যুবরাজ হামজাহ ও বিশ্বরাজনীতির কলকাঠি
যুবরাজ হামজাহ ও বিশ্বরাজনীতির কলকাঠি - ছবি : সংগৃহীত
জর্দানে অভ্যুত্থানে যুক্ত থাকায় অভিযুক্ত সাবেক যুবরাজ হামজাহ বিন হুসেন বাদশাহর আবদুল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও সহযোগিতা করার অঙ্গীকার করেছেন বলে খবর বেরিয়েছে। বাদশাহর একসাথে হামজাহ পরলোকগত পিতার স্মরণে এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে জর্দানে ক্ষমতা পরিবর্তনের একটি আয়োজন বিফলে গিয়ে অস্থিরতার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির প্রতি যারা নজর রাখেন তারা তেমনটি মনে করতে পারছেন না। এ অঞ্চলের রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং ক্ষমতার হাত বদলের বিষয় অনেক জটিল এবং বিশ্ব রাজনীতি যারা নিয়ন্ত্রণ করেন; তারা এর সাথে নানাভাবে যুক্ত থাকেন।
জর্দানের অভ্যুত্থানে সাথে সরকারিভাবে বিদেশী শক্তি যুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়। বিশ্লেষকরা বলেছেন, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান আর আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের হাত রয়েছে বলেই এখানে মূলত ইঙ্গিত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের সময় নেয়া কথিত ‘শতাব্দীর সেরা শান্তি চুক্তি’ বাদশাহ আবদুল্লাহ গ্রহণ করেননি, তবে তিনি এর জন্য কিছু মূল্য আগে দিয়েছেন। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে সমর্থন করতে গিয়ে আবদুল্লাহ সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থ সহায়তা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ক্ষমতা নিয়ে অস্থিরতার মধ্যে পড়ার ঘটনায় মনে হচ্ছে তাকে আরো মূল্য দিতে হবে।
ইসরাইলের সাথে টানাপড়েন
‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’ নিয়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাথে জর্দানের বাদশাহর সম্পর্কে টানাপড়েন বেড়ে যায় সাম্প্রতিক বছরে। এই চুক্তিতে যেমন ফিলিস্তিন কর্র্তৃপক্ষকে সমঝোতার বাইরে রাখা হয়; তেমনিভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি জর্দানকেও। ইসলামের পবিত্র শহর মক্কা ও মদিনার রক্ষণাবেক্ষণকারী ছিলেন জর্দানের বাদশাহর পূর্ব পুরুষরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এর কর্তৃত্ব নিয়ে নেয় সৌদ পরিবার। এর পর মসজিদুল আকসার তত্ত্বাবধায়কের মর্যাদাটি কেবল ছিল জর্দানের রাজ পরিবারের। কথিত শান্তি চুক্তির পর এর কর্তৃত্বও জর্দানের হাত থেকে নিয়ে সৌদি রাজপরিবারের হাতে সমর্পণের সমঝোতার বিষয় প্রকাশ হয়ে পড়ে। বাস্তব আচরণেও এর প্রকাশ ঘটে। বাদশাহ আবদুল্লাহর ছেলে ক্রাউন প্রিন্স হুসেইন যখন সম্প্রতি জেরুসালেমে গিয়ে মসজিদে আল আকসায় নামাজ পড়ার কর্মসূচি নেন; তখন তার কতজন দেহরক্ষী অস্ত্র বহন করতে পারবেন সে সম্পর্কে জর্দানের নিরাপত্তা বিভাগের সাথে ইসরাইলের শিন বেটের বিবাদ শুরু হয়। এতে অপমানিত ক্রাউন প্রিন্স মসজিদুল আকসাহ পরিদর্শন বাতিল করে দেন। এর পাল্টা হিসাবে আবুধাবিতে নেতানিয়াহুকে নিতে মোহাম্মদ বিন জায়েদ প্রেরিত একটি ব্যক্তিগত বিমানকে জর্দানের আকাশসীমা অতিক্রম করার অনুমতি দিতে অস্বীকার করা হয়।
জর্দানে ভ্যাকসিনের ঘাটতি ইসরাইলের সাথে উত্তেজনার আরেকটি উৎস। জর্দান ভাইরাস দ্বারা ধ্বংস হচ্ছে। অথচ ইসরাইল গুয়াতেমালার মতো অনেক দূরের দেশগুলোকে সাহায্য করছে, তবে এর নিকটতম প্রতিবেশী জর্দানকে ভ্যাকসিন দেয়নি। বস্তুত জর্দানের প্রতি ইসরাইলের অবহেলা হলো সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে তার উদীয়মান সম্পর্কেরই এক অংশ।
ইসরাইলের বর্তমান রাজনৈতিক দৃশ্যপটে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা কতদিন কিভাবে বজায় থাকবে তা স্পষ্ট নয়। দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা সম্পর্ক নিয়ে উভয়েই দীর্ঘ দিন ধরে স্থিতিশীলতা ভোগ করেছে। তাদের গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে সহযোগিতা অনেক প্রতিকূল প্রকল্প বানচাল করতেও সহায়তা করেছে। ইসরাইলের নিরাপত্তায় জর্দানের স্থিতিশীলতা অপরিহার্য বলে মনে করা হয়। তবে ওই সহযোগিতা ইসরাইলের ক্রমবর্ধমানভাবে শক্তিধর হয়ে ওঠা ডানপন্থীরা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের এক ফর্মুলায় একমত হয়ে ১৯৯৪ সালে দুই দেশ একটি শান্তি চুক্তিতে পৌঁছেছিল। তখন পশ্চিম তীর ও গাজা নিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পশ্চিম তীরের ওপর মালিকানা পরিত্যাগ করে জর্দান। এখন ইসরাইলের কট্টরপন্থী দলগুলো যারা নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ক্ষমতায় রয়েছে তারা দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের বিরোধিতা করে পুরো পশ্চিম তীরকে ইসরাইলের অংশ করতে চাইছে। আর ফিলিস্তিনিদের জর্দানে ঠেলে দিয়ে সেই দেশকে ফিলিস্তিন বানানোর প্রস্তাব দিচ্ছে। ট্রাম্পের ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’র পুরোটা প্রকাশ করা হয়নি। এ চুক্তির অপ্রকাশিত উদ্দেশ্য এই রকম বলেই জানা গেছে।
জর্দানকে ভবিষ্যতের ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার আকাক্সক্ষা এবং পশ্চিম তীরের পুরোটি ইসরাইলকে তুলে দেয়া কোনোভাবেই জর্দনের বাদশাহ মেনে নেবার কথা নয়। বলা হয় যে, পরিকল্পনাটি গত শতকের আশির দশকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আরিয়েল শ্যারন গোপনে বাজারে ছাড়েন। সেটি নিয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে গেছেন নেতানিয়াহু, যা বাস্তবায়নে অনেক দূর এগিয়েছে ট্রাম্প এবং তার ইহুদি জামাতা জারাদ কুশনারের সহযোগিতায়। বাদশাহ আবদুল্লাহর এই বিরোধিতার আওয়াজ ক্ষীণ করতে হলে তার দেশে অস্থিরতা তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্র এবং সরকারকে বিপদে ফেলে দুর্বল করতে হবে। অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা তার একটি অংশ হয়ে থাকতে পারে।
ঐতিহাসিক সৌদি শত্রুতা ও এমবিজেড কানেকশন
সৌদি আরবের সাথে জর্দানের শত্রুতার সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জাজিরাতুল আরবের শাসক ছিলেন হুসেন বিন আলী আল-হাশিমি। তিনি ব্রিটিশদের উসকানিতে ওসমানীয় শাসকদের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু ওসমানীয়দের পতনের পরে ব্রিটিশদের সহায়তায় হুসেন বিন আলী আল-হাশিমিকে আল সৌদ পরিবার জাজিরাতুল আরবের শাসক পদ থেকে বরখাস্ত করে। সে সাথে মক্কা-মদিনা জেদ্দাসহ পুরো অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সৌদি শাসকরা এভাবেই মক্কা এবং মদিনার মুসলিম পবিত্র স্থানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পান।
হুসেনের উত্তরাধিকারী ফয়সাল ও আবদুল্লাহকে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসাবে যথাক্রমে ইরাক ও ট্রান্সজর্ডানের শাসক করা হয়। ইরাকের বাদশাহকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পঞ্চাশের দশকেই বিদায় করা হয়। সময়ের সাথে সাথে কেবল জর্দানের হাসেমীয় রাজতন্ত্র টিকে থাকে। জেরুসালেমের মুসলিম পবিত্র স্থানগুলো রক্ষার প্রতীকী দায়িত্ব অতিরিক্ত সান্ত¡না পুরস্কার হিসেবে অর্জন করে।
এই মূল ঘটনাটি এখনো জর্ডান-সৌদি আরব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে তাড়িয়ে বেড়ায়। হাশেমিরা মনের ভেতর থেকে কখনোই সৌদি রাজপরিবারকে ক্ষমা করতে পারে না এবং সৌদিরা কখনই নবী মুহাম্মদ সা:-এর প্রত্যক্ষ বংশধর হিসেবে হাশেমিদের ইসলামী কোনো ভূখণ্ডের উত্তরাধিকারের সাথে যুক্ত থাকতে দিতে চায় না। ২০০৬ সালে আমেরিকান ডিফেন্স জার্নালে পরিবর্তিত মধ্যপ্রাচ্যের যে মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছিল তাতে মক্কা মদিনাসহ জাজিরাতুল আরবকে আলাদা ইসলামী পবিত্র রাষ্ট্র এবং জর্দানের সাথে সৌদি আরবের একটি অংশ জুড়ে দেয়া হয়। ফলে বাইরে বাইরে যাই দেখা যাক না কেন ভেতরে নানা ধরনের সন্দেহ রয়ে গেছে দুই দেশের শাসক পরিবারের মধ্যে।
প্রিন্স হামজাহকে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার সাথে অভিযুক্ত করার কোনো যোগসূত্র সৃষ্টির মতো প্রমাণ না দিয়েই জর্দানের নিরাপত্তা সূত্রগুলো বিদেশী যোগাযোগের জন্য ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের মধ্যে দু’জনের ভূমিকা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সৌদি আরবের সাথে তাদের সংযোগের কারণে এটি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা দু’জন হলেন- রাজপরিবারের সদস্য হাসান বিন জায়েদ এবং বাসেম আওদাল্লাহ।
আওদাল্লাহ এক সময় বাদশাহ আবদুল্লাহর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জর্দানের প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০০৭ সালে তিনি জর্দানের রাজ আদালতের প্রধান নিযুক্ত হন, এক বছরেরও কম সময় এই পদে থাকার পর তাকে বরখাস্ত করা হয়। জর্দান ত্যাগ করে পরে আওদাল্লাহ দুবাই চলে গিয়ে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর আওদাল্লাহ আমিরাত ও সৌদিতে জর্দানের বিশেষ দূত হিসাবে কাজ করেন।
২০১৮ সালে আওদাল্লাহর জর্দানি দায়িত্ব পালনের সমাপ্তি টানা হয়। এ সময় বাদশাহ আবদুল্লাহকে বোঝানো হয়; তার দূত জর্দানের চেয়ে রিয়াদের বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছেন। আওদাল্লাহ সৌদি আরব ও জর্দান উভয় দেশের নাগরিকত্ব বজায় রাখেন।
এর মধ্যে আওদাল্লাহ বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের একটি নেটওয়ার্ক স্থাপন করেন। সৌদি যুবরাজের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি মোহাম্মদ বিন সালমানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং তার ভবিষ্যৎ নগরী নেওমের পরিকল্পনায় সহায়তা করছেন। মোহাম্মদ বিন জায়েদের (এমবিজেড) সাথে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করেন তিনি এবং এই সুবাদে দুবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদে নিযুক্তি পান। আমিরাতের অভ্যন্তরীণ সূত্রের তথ্য অনুসারে, নির্বাসিত ফিলিস্তিন নেতা মোহাম্মদ দাহলানের চেয়ে বিন জায়েদের কাছে আওদাল্লাহ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মোহাম্মদ বিন জায়েদ এবং আমিরাতের শাসকের সঙ্গে তার সম্পর্ক কত গভীর তা বোঝা যায় জেরুসালেমের আশপাশে ফিলিস্তিনি ভূমি কিনে নেয়ার পেছনে তার বিশেষ ভূমিকায়।
কিছু সংবাদমাধ্যম তাকে আরামকো বেসরকারীকরণের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী বলেও অভিহিত করেছে। আওয়াদাল্লাহ গত জানুয়ারিতে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগকারী সম্মেলনে মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে উপস্থিত ছিলেন।
স্বাভাবিকভাবে আওদাল্লাহকে গ্রেফতার করা বিন সালমান এবং বিন জায়েদ উভয়ের জন্য বিব্রতকর। তবে জর্দান প্রকাশ্যে সৌদি আরবের মুখোমুখি হতে পারবে না। যদি তারা তা করে এবং সৌদি আরবকে অভ্যুত্থান ঘটানোয় অভিযুক্ত করে বলে যে তারা আওদাল্লাহর মাধ্যমে এ ব্যাপারে হামজাকে বার্তা পাঠায়, তবে এর ফল হবে জর্দানি শ্রমিক এবং ব্যবসায়ীদের সৌদি আরব থেকে বহিষ্কার। যা হবে দেশটির অর্থনীতির জন্য বিপর্যয়কর।
আওদাল্লাহর গ্রেফতারের খবর প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে সৌদি প্রতিনিধি দল আম্মান সফরে যায়। ওয়াশিংটন পোস্টের বরাত দিয়ে এ ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে এমন একটি গোয়েন্দা সূত্র মতে, সৌদিরা আওদাল্লাহকে মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ করে। সৌদিরা বলছিল, তাকে ছাড়া তারা জর্দান ছাড়বেন না। এ সংযোগগুলো ব্যাখ্যা করে যে, কেন আওদাল্লাহকে সন্দেহজনক মনে করা হচ্ছে। প্রিন্স হামজার উচ্চাভিলাষ রয়েছে এ কথা নিশ্চয়ই সত্য তবে সৌদি, আমিরাতি ও ইসরাইল সবারই জর্দানকে দুর্বল করতে একটি সাধারণ এজেন্ডা সামনে রয়েছে বলে মনে হয়।
বাফার স্টেট
রাষ্ট্র হিসেবে জর্দান মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে দুর্বল দেশগুলোর একটি। জর্দান নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত পশ্চিম এশিয়ার লেভান্ট অঞ্চলের আরব দেশ হলো জর্দান। দেশটির সীমানা রয়েছে সৌদি আরব, ইরাক, সিরিয়া, ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের (পশ্চিম তীর) সাথে। মৃত সাগরটি পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত। দেশটির একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিমে লোহিত সাগরের ওপর একটি ২৬ কিলোমিটার উপকূলরেখা রয়েছে। দেশটির অবস্থান এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের চৌমাথায়। এর রাজধানী আম্মান হলো জর্দানের সর্বাধিক জনবহুল শহর। দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
জর্দান এক ধরনের বাফার স্টেট। এর দুই পাশে ইসরাইল এবং সৌদি আরবের মতো ক্ষমতাধর দেশের অবস্থান হওয়ায় এদের বিপজ্জনক আঞ্চলিক এজেন্ডাসহ উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার শিকার হতে হয়েছে বিভিন্ন সময়। পাশাপাশি সিরিয়া ও ইরাক থেকে অস্থিতিশীলতা ও উগ্রবাদবাদও ছড়িয়ে পড়েছে এখানে। গত দশকে আরব বসন্তে উদ্ভূত উত্তেজনা মোকাবেলা করে স্থিতি রক্ষা করে বাদশাহ আবদুল্লাহ একজন কৌশলী রাষ্ট্রনায়কের পরিচয় দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিও গভীরভাবে উপলব্ধি করেন তিনি।
ইসরাইল এবং আমেরিকা সর্বদা তাদের সহযোগিতার বিনিময়ে দেশটির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে। অথচ এর অর্থনৈতিকভাবে বেঁচে থাকার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি সৌদি আরব এবং অন্যান্য উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল।
স্থিতাবস্থার পরিবর্তন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি
জর্দানের প্রিন্স হামজাহর অভ্যুত্থানের গুজব এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট না ঘটনায় মনে হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে বিরাজমান স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের একটি গভীর এজেন্ডা নিয়ে কাজ হচ্ছে। গত মাসেই জর্দানে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে।
জর্দান সরকার পার্লামেন্টকে এড়িয়ে জর্দান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি বিতর্কিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি অনুমোদন করেছে গত মাসে। এই চুক্তি অনুসারে আমেরিকান সেনাবাহিনী কোনো ধরনের ভিসার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই জর্দানে আসতে পারবে, ঘাঁটি করে অবস্থান করতে পারবে এবং চলেও যেতে পারবে। ৩১ জানুয়ারি, এই প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তিটি স্বাক্ষর হওয়ার পর অনেক বিতর্ক তৈরি হয়। এটি জর্দান সরকার ১ ফেব্রুয়ারি অনুমোদন করে। চুক্তির অনুমোদনের একটি রাজকীয় ডিক্রি জারি হয়ে ১ মার্চ অফিসিয়াল গেজেট প্রকাশিত হয়। সংসদ বা জাতীয় পরিষদের সামনে উপস্থাপন না করেই তা কার্যকর করা হয়।
জর্দানবাসী অবাক হয়ে গিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এবং জর্দানের মার্কিন দূতাবাস দেশটি সফরের ব্যাপারে একটি উচ্চ স্তরের সতর্কতা জারির কয়েক দিন পরেই এই চুক্তি অনুমোদিত হয়।
চুক্তিটি জর্দানের অনেক সংসদ সদস্য, ইসলামিক অ্যাকশন ফ্রন্টের মতো বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও আইনজীবীদের মধ্যে নানা সমালোচনার জন্ম দেয়। অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, চুক্তিটি ঔপনিবেশিক অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং জর্দানের সার্বভৌমত্বের সাথে এটি সাংঘর্ষিক। অন্যরা বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন যে চুক্তিটি জর্দানের সংবিধান এবং আইন লঙ্ঘন করেছে। কারণ এটি আইন হিসাবে সংসদের মাধ্যমে অগ্রসর না হয়েই সরকার অনুমোদন করেছে।
জর্দান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রথম ১৯৪৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে জর্দান এবং যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এই সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যের জটিলতা ও অস্থিরতার মধ্য দিয়েই এগিয়েছে। ১৯৫১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র জর্দানে দ্বিপক্ষীয় সহায়তার বৃহত্তম একক সরবরাহকারীতে পরিণত হয়। জর্দানকে গত সাত দশকে ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন জর্দানকে একটি প্রধান নন-ন্যাটো মিত্র দেশ মনোনীত করেছে এবং দুই দেশ একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতেও স্বাক্ষর করেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, এ চুক্তিতে এমন কিছু রয়েছে যা আমেরিকান পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জর্দানের বিশেষ গুরুত্ব বোঝায়। এই বার্তায় এ অঞ্চলের সব আঞ্চলিক শক্তিকে লক্ষ্য করে দেয়া হয়েছে, যার শীর্ষে রয়েছে ইসরাইল ও সৌদি আরব। ইসরাইলের সাথে শান্তি কাঠামো স্বাক্ষরের সময়ের চেয়ে এখন সম্পর্ক শীতল বলে মনে হচ্ছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার চুক্তির সময়টিও বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এটি এ অঞ্চলে আসন্ন মার্কিন সামরিক কৌশল সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো প্রকাশ করে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে রাশিয়া ও চীনের সাথে দ্বন্দ্ব ও মুক্ত বিরোধের নতুন এক অবস্থা হাজির করেছে। চুক্তিটি এ অঞ্চলে মার্কিন বাহিনীর চলাচল সহজতর করবে। চুক্তিটির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান সামরিক অবস্থানে নতুন বিন্যাস ঘটার ইঙ্গিতও থাকতে পারে। সৌদি আরবের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি থেকে আমেরিকান সেনা এখন কমানো হচ্ছে। বিশেষত যেহেতু এ অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো মার্কিন-মিত্র সরকারগুলোর চাপের মধ্যে রয়েছে তাই নতুন কিছু তৈরির বিষয় পেন্টাগনের নীতি নির্ধারকরা ভেবে থাকতে পারেন।
জর্দানের সেনা অভুত্থানের বিষয়টি মনে হচ্ছে নিছক কোনো ক্ষমতার পরিবর্তন প্রচেষ্টা নয়। যে ধরনের চেষ্টা অতীতে অনেকবার দেশটিতে হয়েছে। এর সাথে মধ্য প্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নতুন কোনো অবয়ব দেয়ার বিষয় যুক্ত থাকতে পারে; যার সাথে ইসরাইলের সীমানা বৃদ্ধি অথবা এ অঞ্চলের রাষ্ট্রিক সীমানা পুনর্বিন্যাসের মতো বড় বিষয়ও থাকতে পারে। ফলে অভ্যুত্থানের গুজব জর্দান বা এ অঞ্চলের জন্য নিছক কোনো হালকা মাত্রার ভূমিকম্প নয়। এটি বড় রকমের সুনামির পূর্ব লক্ষণ বলেই মনে হচ্ছে।
mrkmmb@gmail.com