জর্দানের অভ্যুত্থানে এমবিজেডের ভূমিকা
এমবিজেড - ছবি : সংগৃহীত
সৌদি আরবের সাথে জর্দানের শত্রুতার সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জাজিরাতুল আরবের শাসক ছিলেন হুসেন বিন আলী আল-হাশিমি। তিনি ব্রিটিশদের উসকানিতে ওসমানীয় শাসকদের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু ওসমানীয়দের পতনের পরে ব্রিটিশদের সহায়তায় হুসেন বিন আলী আল-হাশিমিকে আল সৌদ পরিবার জাজিরাতুল আরবের শাসক পদ থেকে বরখাস্ত করে। সে সাথে মক্কা-মদিনা জেদ্দাসহ পুরো অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সৌদি শাসকরা এভাবেই মক্কা এবং মদিনার মুসলিম পবিত্র স্থানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পান।
হুসেনের উত্তরাধিকারী ফয়সাল ও আবদুল্লাহকে সান্ত্বনা পুরস্কার হিসাবে যথাক্রমে ইরাক ও ট্রান্সজর্ডানের শাসক করা হয়। ইরাকের বাদশাহকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পঞ্চাশের দশকেই বিদায় করা হয়। সময়ের সাথে সাথে কেবল জর্দানের হাসেমীয় রাজতন্ত্র টিকে থাকে। জেরুসালেমের মুসলিম পবিত্র স্থানগুলো রক্ষার প্রতীকী দায়িত্ব অতিরিক্ত সান্ত¡না পুরস্কার হিসেবে অর্জন করে।
এই মূল ঘটনাটি এখনো জর্ডান-সৌদি আরব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে তাড়িয়ে বেড়ায়। হাশেমিরা মনের ভেতর থেকে কখনোই সৌদি রাজপরিবারকে ক্ষমা করতে পারে না এবং সৌদিরা কখনই নবী মুহাম্মদ সা:-এর প্রত্যক্ষ বংশধর হিসেবে হাশেমিদের ইসলামী কোনো ভূখণ্ডের উত্তরাধিকারের সাথে যুক্ত থাকতে দিতে চায় না। ২০০৬ সালে আমেরিকান ডিফেন্স জার্নালে পরিবর্তিত মধ্যপ্রাচ্যের যে মানচিত্র প্রকাশ করা হয়েছিল তাতে মক্কা মদিনাসহ জাজিরাতুল আরবকে আলাদা ইসলামী পবিত্র রাষ্ট্র এবং জর্দানের সাথে সৌদি আরবের একটি অংশ জুড়ে দেয়া হয়। ফলে বাইরে বাইরে যাই দেখা যাক না কেন ভেতরে নানা ধরনের সন্দেহ রয়ে গেছে দুই দেশের শাসক পরিবারের মধ্যে।
প্রিন্স হামজাহকে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার সাথে অভিযুক্ত করার কোনো যোগসূত্র সৃষ্টির মতো প্রমাণ না দিয়েই জর্দানের নিরাপত্তা সূত্রগুলো বিদেশী যোগাযোগের জন্য ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের মধ্যে দু’জনের ভূমিকা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সৌদি আরবের সাথে তাদের সংযোগের কারণে এটি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা দু’জন হলেন- রাজপরিবারের সদস্য হাসান বিন জায়েদ এবং বাসেম আওদাল্লাহ।
আওদাল্লাহ এক সময় বাদশাহ আবদুল্লাহর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত জর্দানের প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০০৭ সালে তিনি জর্দানের রাজ আদালতের প্রধান নিযুক্ত হন, এক বছরেরও কম সময় এই পদে থাকার পর তাকে বরখাস্ত করা হয়। জর্দান ত্যাগ করে পরে আওদাল্লাহ দুবাই চলে গিয়ে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর আওদাল্লাহ আমিরাত ও সৌদিতে জর্দানের বিশেষ দূত হিসাবে কাজ করেন।
২০১৮ সালে আওদাল্লাহর জর্দানি দায়িত্ব পালনের সমাপ্তি টানা হয়। এ সময় বাদশাহ আবদুল্লাহকে বোঝানো হয়; তার দূত জর্দানের চেয়ে রিয়াদের বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে গেছেন। আওদাল্লাহ সৌদি আরব ও জর্দান উভয় দেশের নাগরিকত্ব বজায় রাখেন।
এর মধ্যে আওদাল্লাহ বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের একটি নেটওয়ার্ক স্থাপন করেন। সৌদি যুবরাজের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি মোহাম্মদ বিন সালমানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং তার ভবিষ্যৎ নগরী নেওমের পরিকল্পনায় সহায়তা করছেন। মোহাম্মদ বিন জায়েদের (এমবিজেড) সাথে দৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করেন তিনি এবং এই সুবাদে দুবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদে নিযুক্তি পান। আমিরাতের অভ্যন্তরীণ সূত্রের তথ্য অনুসারে, নির্বাসিত ফিলিস্তিন নেতা মোহাম্মদ দাহলানের চেয়ে বিন জায়েদের কাছে আওদাল্লাহ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মোহাম্মদ বিন জায়েদ এবং আমিরাতের শাসকের সঙ্গে তার সম্পর্ক কত গভীর তা বোঝা যায় জেরুসালেমের আশপাশে ফিলিস্তিনি ভূমি কিনে নেয়ার পেছনে তার বিশেষ ভূমিকায়।
কিছু সংবাদমাধ্যম তাকে আরামকো বেসরকারীকরণের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী বলেও অভিহিত করেছে। আওয়াদাল্লাহ গত জানুয়ারিতে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগকারী সম্মেলনে মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে উপস্থিত ছিলেন।
স্বাভাবিকভাবে আওদাল্লাহকে গ্রেফতার করা বিন সালমান এবং বিন জায়েদ উভয়ের জন্য বিব্রতকর। তবে জর্দান প্রকাশ্যে সৌদি আরবের মুখোমুখি হতে পারবে না। যদি তারা তা করে এবং সৌদি আরবকে অভ্যুত্থান ঘটানোয় অভিযুক্ত করে বলে যে তারা আওদাল্লাহর মাধ্যমে এ ব্যাপারে হামজাকে বার্তা পাঠায়, তবে এর ফল হবে জর্দানি শ্রমিক এবং ব্যবসায়ীদের সৌদি আরব থেকে বহিষ্কার। যা হবে দেশটির অর্থনীতির জন্য বিপর্যয়কর।
আওদাল্লাহর গ্রেফতারের খবর প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে সৌদি প্রতিনিধি দল আম্মান সফরে যায়। ওয়াশিংটন পোস্টের বরাত দিয়ে এ ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে এমন একটি গোয়েন্দা সূত্র মতে, সৌদিরা আওদাল্লাহকে মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ করে। সৌদিরা বলছিল, তাকে ছাড়া তারা জর্দান ছাড়বেন না। এ সংযোগগুলো ব্যাখ্যা করে যে, কেন আওদাল্লাহকে সন্দেহজনক মনে করা হচ্ছে। প্রিন্স হামজার উচ্চাভিলাষ রয়েছে এ কথা নিশ্চয়ই সত্য তবে সৌদি, আমিরাতি ও ইসরাইল সবারই জর্দানকে দুর্বল করতে একটি সাধারণ এজেন্ডা সামনে রয়েছে বলে মনে হয়।