জর্দান কি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ?
জর্দান ও তার প্রতিবেশীরা - ছবি : সংগৃহীত
রাষ্ট্র হিসেবে জর্দান মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে দুর্বল দেশগুলোর একটি। জর্দান নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত পশ্চিম এশিয়ার লেভান্ট অঞ্চলের আরব দেশ হলো জর্দান। দেশটির সীমানা রয়েছে সৌদি আরব, ইরাক, সিরিয়া, ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনের (পশ্চিম তীর) সাথে। মৃত সাগরটি পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত। দেশটির একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিমে লোহিত সাগরের ওপর একটি ২৬ কিলোমিটার উপকূলরেখা রয়েছে। দেশটির অবস্থান এশিয়া, আফ্রিকা এবং ইউরোপের চৌমাথায়। এর রাজধানী আম্মান হলো জর্দানের সর্বাধিক জনবহুল শহর। দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
জর্দান এক ধরনের বাফার স্টেট। এর দুই পাশে ইসরাইল এবং সৌদি আরবের মতো ক্ষমতাধর দেশের অবস্থান হওয়ায় এদের বিপজ্জনক আঞ্চলিক এজেন্ডাসহ উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার শিকার হতে হয়েছে বিভিন্ন সময়। পাশাপাশি সিরিয়া ও ইরাক থেকে অস্থিতিশীলতা ও উগ্রবাদবাদও ছড়িয়ে পড়েছে এখানে। গত দশকে আরব বসন্তে উদ্ভূত উত্তেজনা মোকাবেলা করে স্থিতি রক্ষা করে বাদশাহ আবদুল্লাহ একজন কৌশলী রাষ্ট্রনায়কের পরিচয় দিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিও গভীরভাবে উপলব্ধি করেন তিনি।
ইসরাইল এবং আমেরিকা সর্বদা তাদের সহযোগিতার বিনিময়ে দেশটির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে। অথচ এর অর্থনৈতিকভাবে বেঁচে থাকার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি সৌদি আরব এবং অন্যান্য উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল।
স্থিতাবস্থার পরিবর্তন ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি
জর্দানের প্রিন্স হামজাহর অভ্যুত্থানের গুজব এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট না ঘটনায় মনে হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে বিরাজমান স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের একটি গভীর এজেন্ডা নিয়ে কাজ হচ্ছে। গত মাসেই জর্দানে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে।
জর্দান সরকার পার্লামেন্টকে এড়িয়ে জর্দান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি বিতর্কিত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি অনুমোদন করেছে গত মাসে। এই চুক্তি অনুসারে আমেরিকান সেনাবাহিনী কোনো ধরনের ভিসার আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই জর্দানে আসতে পারবে, ঘাঁটি করে অবস্থান করতে পারবে এবং চলেও যেতে পারবে। ৩১ জানুয়ারি, এই প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তিটি স্বাক্ষর হওয়ার পর অনেক বিতর্ক তৈরি হয়। এটি জর্দান সরকার ১ ফেব্রুয়ারি অনুমোদন করে। চুক্তির অনুমোদনের একটি রাজকীয় ডিক্রি জারি হয়ে ১ মার্চ অফিসিয়াল গেজেট প্রকাশিত হয়। সংসদ বা জাতীয় পরিষদের সামনে উপস্থাপন না করেই তা কার্যকর করা হয়।
জর্দানবাসী অবাক হয়ে গিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর এবং জর্দানের মার্কিন দূতাবাস দেশটি সফরের ব্যাপারে একটি উচ্চ স্তরের সতর্কতা জারির কয়েক দিন পরেই এই চুক্তি অনুমোদিত হয়।
চুক্তিটি জর্দানের অনেক সংসদ সদস্য, ইসলামিক অ্যাকশন ফ্রন্টের মতো বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও আইনজীবীদের মধ্যে নানা সমালোচনার জন্ম দেয়। অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, চুক্তিটি ঔপনিবেশিক অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং জর্দানের সার্বভৌমত্বের সাথে এটি সাংঘর্ষিক। অন্যরা বলেছেন, তারা বিশ্বাস করেন যে চুক্তিটি জর্দানের সংবিধান এবং আইন লঙ্ঘন করেছে। কারণ এটি আইন হিসাবে সংসদের মাধ্যমে অগ্রসর না হয়েই সরকার অনুমোদন করেছে।
জর্দান এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রথম ১৯৪৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে জর্দান এবং যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। এই সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যের জটিলতা ও অস্থিরতার মধ্য দিয়েই এগিয়েছে। ১৯৫১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র জর্দানে দ্বিপক্ষীয় সহায়তার বৃহত্তম একক সরবরাহকারীতে পরিণত হয়। জর্দানকে গত সাত দশকে ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন জর্দানকে একটি প্রধান নন-ন্যাটো মিত্র দেশ মনোনীত করেছে এবং দুই দেশ একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতেও স্বাক্ষর করেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, এ চুক্তিতে এমন কিছু রয়েছে যা আমেরিকান পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জর্দানের বিশেষ গুরুত্ব বোঝায়। এই বার্তায় এ অঞ্চলের সব আঞ্চলিক শক্তিকে লক্ষ্য করে দেয়া হয়েছে, যার শীর্ষে রয়েছে ইসরাইল ও সৌদি আরব। ইসরাইলের সাথে শান্তি কাঠামো স্বাক্ষরের সময়ের চেয়ে এখন সম্পর্ক শীতল বলে মনে হচ্ছে। প্রতিরক্ষা সহযোগিতার চুক্তির সময়টিও বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এটি এ অঞ্চলে আসন্ন মার্কিন সামরিক কৌশল সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো প্রকাশ করে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে রাশিয়া ও চীনের সাথে দ্বন্দ্ব ও মুক্ত বিরোধের নতুন এক অবস্থা হাজির করেছে। চুক্তিটি এ অঞ্চলে মার্কিন বাহিনীর চলাচল সহজতর করবে। চুক্তিটির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান সামরিক অবস্থানে নতুন বিন্যাস ঘটার ইঙ্গিতও থাকতে পারে। সৌদি আরবের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি থেকে আমেরিকান সেনা এখন কমানো হচ্ছে। বিশেষত যেহেতু এ অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো মার্কিন-মিত্র সরকারগুলোর চাপের মধ্যে রয়েছে তাই নতুন কিছু তৈরির বিষয় পেন্টাগনের নীতি নির্ধারকরা ভেবে থাকতে পারেন।
জর্দানের সেনা অভুত্থানের বিষয়টি মনে হচ্ছে নিছক কোনো ক্ষমতার পরিবর্তন প্রচেষ্টা নয়। যে ধরনের চেষ্টা অতীতে অনেকবার দেশটিতে হয়েছে। এর সাথে মধ্য প্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নতুন কোনো অবয়ব দেয়ার বিষয় যুক্ত থাকতে পারে; যার সাথে ইসরাইলের সীমানা বৃদ্ধি অথবা এ অঞ্চলের রাষ্ট্রিক সীমানা পুনর্বিন্যাসের মতো বড় বিষয়ও থাকতে পারে। ফলে অভ্যুত্থানের গুজব জর্দান বা এ অঞ্চলের জন্য নিছক কোনো হালকা মাত্রার ভূমিকম্প নয়। এটি বড় রকমের সুনামির পূর্ব লক্ষণ বলেই মনে হচ্ছে।
mrkmmb@gmail.com