কিভাবে ফিরে পেতে পারি সুশিক্ষা ও মনুষ্যত্ব?
কিভাবে ফিরে পেতে পারি সুশিক্ষা ও মনুষ্যত্ব? - ছবি সংগৃহীত
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সুশিক্ষার বিনাশের সাথে সাথে ঘটছে মনুষ্যত্বের অবক্ষয়। এখন কিভাবে ফিরে পেতে পারি ওই সুশিক্ষা ও মনুষ্যত্বকে? কেমন হওয়া উচিত দেশের কার্যকরী শিক্ষাব্যবস্থা এবং কখন শুনব সেই বিজয়ের ধ্বনি। মানবজীবনে দীর্ঘমেয়াদি পরাজয় বলে কিছু নেই তবে এর একটি সংক্ষিপ্ত সময় আছে। জয়-পরাজয় জীবন চলার চাবিকাঠি। জীবনে বেঁচে থাকতে দুটিরই দরকার রয়েছে, যেমন দরকার রয়েছে আলো ও অন্ধকারের। অন্ধকার ছাড়া যেমন আলোর অস্তিত্ব নেই, ঠিক পরাজয় ছাড়া জয়ের অস্তিত্ব নেই।
এটা অনস্বীকার্য যে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য একটা দক্ষ ও সুশিক্ষিত নাগরিক সমাজ গঠন করতে হলে যে কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োজন আমরা তা এখনও গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। দেশের প্রতিটি উন্নয়ন-রূপকল্পের ভিত্তিমূলেই রয়েছে বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের প্রতিধ্বনি। কিন্তু দক্ষ ও সুশিক্ষিত নাগরিক সমাজ গঠনের জন্য কোনো কার্যকর ও টেকসই প্রকল্প গ্রহণ করতে না পারলে দেশের উন্নয়ন-রূপকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।
সব দেশের মানুষেরই প্রথম চাওয়া এখন সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা, আর শিক্ষা বলতে বুঝায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদেরকে ঘিরে আবর্তিত হয়। যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-সম্পর্কিত সব উদ্যোগ, সব প্রক্রিয়া শ্রেণিকক্ষে সঞ্চারণ করার অদ্বিতীয় সঞ্চারক হচ্ছেন শিক্ষক, সেহেতু শ্রেণিকক্ষে যুগোপযোগী শিক্ষা সঞ্চারণ করার জন্য শিক্ষককে নিতে হয় প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন প্রস্তুতি। এসব প্রস্তুতির জন্য সহায়ক মাধ্যম হচ্ছে প্রশিক্ষণ। আমাদের শিক্ষক সমাজ কি ওই মাপের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারছেন? অর্থাৎ আমাদের শিক্ষক সমাজ কি প্রস্তুত?
সব শিক্ষার্থীই কোনো না কোনো গুণে সমৃদ্ধ। তা ছাড়া শিক্ষা হলো সবার জন্মগত অধিকার। কাজেই সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাই সবাইকে সুযোগ দিতেই হবে। কিন্তু শুধু সুযোগ দিলেই তো হবে না, নিশ্চিত করতে হবে তারা যেন ভালো শিক্ষা পায়। ভালো শিক্ষা যদি চাই, ভালো শিক্ষক ছাড়া তা কিছুতেই সম্ভব নয়।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ধারার একমাত্র বাহক শিক্ষক সমাজই যদি মজবুত না হয়, শিক্ষার্থী নামক বাহনের অভিযাত্রীরা কি নির্বিঘ্নে এই বৈতরণী পাড়ি দিতে পারবেন? সে প্রশ্ন সব নাগরিকের, সব অভিভাবকের। আমরা জানি, শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য, দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দরকার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। শিক্ষকের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য একদিকে প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মত ও স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা, অন্যদিকে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক-শিক্ষা এবং চাহিদাভিত্তিক যুগোপযোগী পৌনঃপুনিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধন করা। সমগ্র দেশের শিক্ষাচিত্রে বাস্তবে ভিন্ন চিত্র বিরাজ করলেও শিক্ষানীতিতে মানসম্মত, চাহিদাভিত্তিক, যুগোপযোগী, পৌনঃপুনিক, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পেশাগত উৎকর্ষ সাধন এসব বিষয়ের ওপর জোর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
শিক্ষানীতিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে প্রচলিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা খুবই গতানুগতিক, অসম্পূর্ণ, সনদপত্রসর্বস্ব, তত্ত্বীয়বিদ্যা প্রধান, ব্যবহারিক শিক্ষা অপূর্ণ, মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরশীল এবং পুরনো পরীক্ষা পদ্ধতি অনুসারী, তাই আশানুরূপ ফল লাভ হচ্ছে না। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এসব দুর্বলতা চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। যেমন, শিক্ষক-শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের শেখা-শেখানো কলাকৌশল সম্পর্কে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা। শিক্ষকদের পেশাগত জ্ঞান বৃদ্ধি করা এবং সময়ের সঙ্গে যুগোপযোগীকরণে সহায়তা দান করা। শিক্ষকদের মধ্যে ব্যক্তিত্ব, উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধি এবং নেতৃত্বের গুণাবলি জাগ্রত করা, নতুন নতুন শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে দক্ষতা ও কৌশল বৃদ্ধি করা। দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতন থেকে কার্য সম্পাদনের জন্য শিক্ষকদের উৎসাহিত করা ইত্যাদি। শিক্ষানীতিতে শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে এমনসব আশাপ্রদ বাক্য সংযোজন করা হলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন তেমন একটা চোখে পড়ে না। অর্থ্যাৎ দেশে বিছিন্নভাবে কিছু শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও তা তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। এইগুলো এখন শুধু শিক্ষানীতির পাতায় বন্দি না রেখে বাস্তবে প্রয়োগের সময় এসেছে। বাংলাদেশে এখনো চলছে সেই সনাতন শিক্ষাদান পদ্ধতি যা বয়ে আনছে দেশে শুধু অন্ধকার ও বেকারত্ব, তার প্রমাণ দেশের সর্বত্র। তাই শিক্ষাঙ্গনে এক বিরাট পরিবর্তনে চাই সংশ্লিষ্ট সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে একটা বিষয় বেশ পরিষ্কার যে দেশ ও সমাজের চাহিদাভিত্তিক দক্ষ জনসম্পদ তৈরির জন্য সুশিক্ষা ও মানসম্পন্ন শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
আর মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য দেশে এক বা একাধিক বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় অবিলম্বে গড়ে তোলা দরকার।
দেশের সকল কিন্ডারগার্টেন থেকে শুরু করে সব স্তরের শিক্ষকবৃন্দ প্রশিক্ষণ প্রদান ও গ্রহণের একটি সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা করা যেখানে শিক্ষকদের পেশাগত জ্ঞান বৃদ্ধি ও যুগোপযোগীকরণে সহায়তা দান করা, শিক্ষকদের ব্যক্তিত্ব, উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধি এবং নেতৃত্বের গুণাবলি জাগ্রত করা, নতুন নতুন শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে দক্ষতা ও কৌশল বৃদ্ধি করা, দায়িত্ব ও কর্তব্য সচেতন থেকে কার্য সম্পাদনের জন্য শিক্ষকদের উৎসাহিত করা দরকার। Value of teaching is learning from learners এই কনসেপ্ট প্রয়োগ করতে হবে।
এটা পৃথিবীর প্রথম ভিন্নধর্মী একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়টি হবে সকল শিক্ষকদের জন্য একটা মিলন কেন্দ্র। দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার জন্য সমগ্র শিক্ষক সমাজকে সত্যিকারের অঙ্গিকার নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের সাফল্য অর্জনের উদ্দেশ্যে এই ধরনের শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে সকল উদ্যোগী মানুষকে এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
দেশের প্রতিটি জেলায় ডিসি মহোদয়ের তত্ত্বাবধানে 'শিক্ষা ও উন্নয়ন' নামে একটা করে সেল রয়েছে। প্রাইমারি ও মাধ্যমিক শিক্ষা দেখাশুনার জন্য জেলা শিক্ষা অফিসারের কার্য্যালয় আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর এ্যফিলিয়েটিং কর্তৃপক্ষ হিসেবে আছে শিক্ষা বোর্ড ও বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বিদ্যমান শিক্ষা কাঠামোগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের তেমন ব্যবস্থা নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত পরিদর্শনও করা হয় না। ফলে প্রশিক্ষণ যতটুকু দেয়া হচ্ছে তারও প্রয়োগ তেমন হচ্ছে না।
দেশে প্রাথমিক শিক্ষাই এখনও পর্যন্ত শক্ত ভিত্তির উপর দাড়াতে পারেনি। প্রাথমিক শিক্ষাকে এখনও সর্বজনীন করা সম্ভব হয়নি। এখনো শিক্ষার প্রতিটি স্তর থেকে বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী নিয়মিত ঝড়ে পড়ছে। এর হার কোনো কোনো স্তরে প্রায় এক চতুর্থাংশ যা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।
এই সমস্যা দ্রুত সমাধানের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে স্বল্প মেয়াদি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন। স্বল্প মেয়াদি পদক্ষেপের মধ্যে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো ভেবে দেখার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সুদৃষ্টি কামনা করছি :-
ক) দেশে বিদ্যমান শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা বিজ্ঞানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগসহ আধুনিক এবং যুগোপযোগী শিক্ষক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো অবিলম্বে গড়ে তুলা প্রয়োজন।
খ) সকল স্তরের শিক্ষকদের নিয়মিত ও কার্যকর প্রশিক্ষণের জন্য আরো বেশি সংখ্যক শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলা দরকার।
গ) মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন ও তত্ত্বাবধানের জন্য আরো কার্যকর ও জবাবদিহিমুলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার।
এজন্য সরকারি কর্মকর্তা, সুধীজন, বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক ও শিক্ষাবিদবৃন্দ, বিভিন্ন শিল্প সংস্থার কর্ণধার বা জনবল রিক্রুটিং সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জেলা ও উপজেলা কমিটি গঠন করে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা খুবই দরকার।
ঘ) সকল স্তরের শিক্ষকবৃন্দকেই এই প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং এর গুরুত্ব সংশ্লিষ্ট সকলেরই উপলব্দিতে আনা দরকার।
ঙ) দেশের ও আধুনিক বিশ্বের প্রয়োজনের সাথে সংগতিপূর্ণ শিক্ষা যেন দেশের জনগোষ্ঠী গ্রহণ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা দরকার।
চ) শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখার জন্য সরকার, শিক্ষক ও সমাজের আরও সম্পৃক্ততার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
ছ) শিক্ষার জন্য জাতীয় বাজেটে আরো বরাদ্ধ বৃদ্ধি করে একে দেশের সমৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ করণীয় হিসেবে গণ্য করা দরকার।
জ) শিক্ষার জন্য গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রমকে সুষ্টুভাবে পরিচালনার জন্য দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলা আশু প্রয়োজন বলে মনে করি।
শিক্ষকরা যেহেতু সুশিক্ষার মূল কারিগর তাই তাদের মান সম্পন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাই হবে এই বিশেষায়িত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য।
লেখক : সুইডেনপ্রবাসী; সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার rahman.mridha@gmail.com