ইরান-ইসরাইল দ্বন্দ্ব এবং আত্মক্ষতি
ইরান-ইসরাইল দ্বন্দ্ব এবং আত্মক্ষতি - ছবি সংগৃহীত
কোন দেশ বর্তমানে ইরানকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে? ইসরাইল অবশ্যই এর শীর্ষ তিন দেশের মধ্যে রয়েছে। বর্তমানে কোনো দেশ সবচেয়ে বেশি মনে করছে জবরদস্তিমূলকভাবে ইরান আক্রমণ করবে? এটা যে ইসরাইল তাতে সন্দেহ নেই।
২০২১ সালের মার্চের গোড়ার দিকে ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গ্যান্টজ একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে ইসরাইলি সেনাবাহিনী ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে হামলার পরিকল্পনাটিকে আপডেট করছে এবং ইরানের পারমাণবিক উন্নয়ন রোধে স্বতন্ত্রভাবে পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আসলে, ইসরাইল বারবার ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো আক্রমণ করার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। আমরা সিরিয়ায় তথাকথিত 'ইরানি লক্ষ্য'-এর উপর ইসরাইলের সামরিক হামলাও দেখেছি।
ইরানের সাথে বৈরিতা এই মুহূর্তে ইসরাইলে একটি সামাজিক ঐকমত্য। আমি যখন ইসরাইলে ছিলাম তখন আমি স্পষ্টভাবে ইরান ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রতি দেশটির চরম অবিশ্বাস অনুভব করেছি। ইসরাইলিরা সাধারণভাবে বিশ্বাস করে যে ইরানের পারমাণবিক বিকাশের চূড়ান্ত লক্ষ্য পারমাণবিক অস্ত্র প্রাপ্তি।
কয়েক বছর আগে, আমি ইসরাইলে একটি একাডেমিক সম্মেলনে অংশ নিয়েছি। সম্মেলনে অংশ নেয়া ইসরাইলি পণ্ডিত ও সাবেক সামরিক নেতারা ইরানের পারমাণবিক বিকাশের বিষয়ে তাদের বড় রকমের উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এবং তারা আশঙ্কাও করেছিলেন যে ইরানের পদক্ষেপগুলো মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। আমি ইসরাইলি অংশগ্রহণকারীদের জিজ্ঞাসা করলাম, যদি ইসরাইল তার পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করে দেয়, তাহলে ইরান কি পারমাণবিক উন্নয়ন বন্ধ করবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের পারমাণবিক প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে?
আমার প্রশ্নটি স্পষ্টতই ইসরাইলি অংশগ্রহণকারীদের স্তম্ভিত করেছে, যারা এই ইস্যুতে একটি অবিশ্বাস্য রকমের আবহ তৈরি করেছিল এবং এ নিয়ে হায় হুতাশ করেছিল। এক সাবেক সামরিক জেনারেল এর জবাব দিয়ে বলেছিলেন যে 'ইসরাইল ইরান থেকে আলাদা।' তিনি বলেছিলেন, "ইসরাইলের পারমাণবিক উন্নয়ন শান্তির জন্য আর ইরানের পারমাণবিক উন্নয়ন আঞ্চলিক নিরাপত্তায় হুমকিস্বরূপ। কারণ ইরানি সরকার 'দুবৃত্ত'।"
আমি ইসরাইল ও ইরান উভয়কেই আরো বিশদভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। বস্তুনিষ্ঠভাবে বলতে গেলে, ইসরাইল গুরুতরভাবে 'ইরানি হুমকি'কে অতিরঞ্জিত করেছে। ইরানি কর্মকর্তারা যদিও প্রায়ই ইসরাইলবিরোধী মন্তব্য করেন, বাস্তবে ইরানে বর্তমানে ইসরাইল বিরোধী সামাজিক ঐকমত্য সেভাবে নেই।
নেতানিয়াহুর কাহিনী
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবার ওই গল্পটির উল্লেখ করেন যে প্রাচীন পার্সিয়ান রাজা সমস্ত ইহুদিকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই গল্পটি বাইবেলে স্পষ্টভাবে লেখা হয়েছে। এটি ছিল ইহুদিদের আরব শত্রু যারা পারস্যের রাজার সামনে ইহুদিদের অপবাদ দিয়েছিল। সত্যটি আবিষ্কার হবার পর, পারস্য রাজা কেবল ইহুদিদের হত্যা থেকে বিরত থাকেননি তাই নয়, যিনি ইহুদিদের অপবাদ দিয়েছিলেন সেই কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ডও দিয়েছিলেন।
ইতিহাসের কথা বলতে গেলে, ইহুদিদের মনে রাখা উচিত যে গ্রেট সাইরাস গ্রেফতারকৃতদের 'ব্যাবিলনীয়দের মুক্ত করেছিলেন', যা বাইবেলে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এছাড়াও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ফ্রান্সে ইরানি কনস্যুলেট নাৎসিদের অত্যাচারের মুখোমুখি ইহুদিদের রক্ষা করেছিল। দুই হাজার বছরেরও বেশি দীর্ঘ সময় ধরে, পারস্য ও ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় কোনো বিরোধ ছিল না।
সেক্ষেত্রে ইসরাইল কেন ইরানকে এত ঘৃণা করে? কারণ ইরান কখনো ইসরাইল রাষ্ট্রের বৈধতার স্বীকৃতি দেয়নি। বলা যেতে পারে যে ইসরাইলের সাথে ইরানের শত্রুতা ইরানের প্রতি ইসরাইলের ঘৃণার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ফিলিস্তিনের লেন্স
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের শীর্ষস্থানীয় চিন্তাভাবনা আসে ইসলাম থেকে। যেহেতু এটি 'ইসলামী' বিপ্লব ছিল, তাই ইরান বিপ্লবীদের মধ্য প্রাচ্যের ইসলামি বিশ্বের প্রধান উদ্বেগগুলোর ব্যাপারে সেই সময়ের প্রতিক্রিয়া জানানো দরকার ছিল। এইভাবে, ফিলিস্তিন ইরানের ইসলামি বিপ্লবী নেতাদের ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। অনেক আরব দেশের মতো দেশটি ইসরাইলকে একটি স্বাধীন ও আইনি দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে।
স্পষ্টতই, ফিলিস্তিনের কারণে ইরান ইসরাইলকে ঘৃণা করে। তবে ফিলিস্তিন আজ ৪০ বছর আগের ফিলিস্তিন থেকে আলাদা। যদিও ফিলিস্তিন ইসরাইলকে একটি বৈধ দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং অনেক আরব দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে অথচ ফিলিস্তিনের কারণে ইরান এখনো ইসরাইলের বৈধতাকে অস্বীকার করছে। এটা কি সত্যিই যুক্তিযুক্ত হচ্ছে? ইসরাইলের প্রতি নিম্নলিখিত নীতিটি ইরানের গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত।
ইরান যদি ইসরাইলের প্রতি তার বৈরী নীতি বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখে, তবে ইসরাইলের ইরানের প্রতি বিদ্বেষের অবসান হবে না, ইসরাইল আরব দেশগুলির সাথে আরও সহযোগিতা করার জন্য 'ইরানি হুমকি' ব্যবহার করবে এবং ইসরাইল ইরানকে দমন করার জন্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিতে থাকবে।
ইরান যদি ইসরাইলের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে তবে ইসরাইল কেবল ইরানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ হবে না, বরং ইসরাইল আরব দেশগুলিকে ইরানের বিরুদ্ধে একত্রিত হতে বাধা দেবে। ইহুদিদের অন্তরে গভীর এবং মধ্য প্রাচ্যে ইসরাইলের প্রথম আদর্শ অংশীদার আরব বিশ্ব নয় (পড়ুন ইরান)।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ইরান-ইসরাইলের সম্পর্কের উন্নতি সম্ভবত ধীরে ধীরে ইরান-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে। সর্বোপরি, ইরান-ইসরাইল সম্পর্ক এবং ইরান-মার্কিন সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
সবার জন্য উপকার
সংক্ষেপে, ইসরাইলের প্রতি ইরানের মনোভাব সহজ করা ইরানের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে উপকারী। তদুপরি, ইসরাইলের সাথে ইরানের সম্পর্কের উন্নতি ফিলিস্তিনের ভবিষ্যতের উন্নয়নের জন্যও আরও সহায়ক হবে।
এখনও অবধি, ইরান এবং ইসরাইল ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। পারস্পরিক শত্রুতা এই দুটি দেশের জন্য আরও বেশি নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আসছে।
বর্তমানে ইসরাইল সত্যি গুরুতরভাবে 'ইরানের হুমকি'কে অতিরঞ্জিত করেছে। ইসরাইলের প্রতি ইরানের বৈরিতাও নিজের উপকারে আসে না। উভয় দেশকে তাদের নিজস্ব জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয় পুনর্বিবেচনা করা দরকার।