তুরস্কের পরবর্তী লক্ষ্য
এরদোগান - ছবি : সংগৃহীত
তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইইউতে তুরস্কের পূর্ণাঙ্গ সদস্য পদের ব্যাপারে ২০০৫ সালে আলোচনা শুরু করে তাদের মধ্যকার সম্পর্ককে একটি নতুন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার সূচনা করেছিল। তখন অনেকে এটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তুরস্কের সুম্পর্কের একটি টার্নিং পয়েন্ট হবে বলে আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। সে সময় তুরস্কের একজন বিখ্যাত স্কলার জিয়া ওনিস তার এক নিবন্ধে তুরস্ক-ইইউ-যুক্তরাষ্ট্র ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কের উপকারিতা নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কেবল ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণেই তুরস্কের ইইউ সদস্য পদ অর্জন সহজ হবে না বরং একটি বিচ্ছিন্ন দেশ হিসেবে নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের একজন সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অধিকতর ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রেও তুরস্ক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছতে পারবে। এতে পর্যায়ক্রমে তুরস্ক তার জাতীয় স্বার্থকে আরো ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে পারবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের ‘একটি আঞ্চলিক শক্তি’ হিসেবে আরো গঠনমূলক ভূমিকা পালনে নিজেকে সক্ষম করে তুলতে পারবে। তখন থেকে এ পর্যন্ত বহু ঘটনা ঘটেছে, যা তুরস্কের সাথে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে মারাত্মকভাবে চ্যালেঞ্জ করেছে। তুরস্ক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পায়নি এবং ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক তুরস্কের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে কোনো সহায়ক অবস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। আর তুরস্ক একটি আঞ্চলিক শক্তি হয়ে ওঠেনি। বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যে অবশ্য কোনো দেশই আঞ্চলিক শক্তি হয়ে ওঠার মতো অবস্থানে নেই।
তবে তুরস্ক বিশেষভাবে ২০১৬ সালের পর থেকে বেশি স্বাধীন নীতিকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানত সামরিক শক্তি ব্যবহার এবং সামরিক কূটনীতিকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে তুরস্ক এই অঞ্চলে তার অবস্থানকে সুসংহত করছে।
এ ছাড়াও ডোনাল্ড ট্রাম্প আমলের বিতর্কিত মার্কিন নীতি কেবল ইইউ-তুর্কি সম্পর্কই ক্ষতিগ্রস্ত করেনি; বরং এতে ইউরোপের সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্কের ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে। ফলে ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।
বহু মতের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের কোনো আগ্রহ না থাকায় পশ্চিমা বিশ্বের ঐক্য ভেঙে যায় এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নীতির পক্ষে ওকালতি শুরু করে। এতে কয়েকটি আঞ্চলিক ইস্যুতে তুরস্কের ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভাবিত হয়। এ ক্ষেত্রে পূর্ব ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চল ইস্যু থেকে অভিবাসী প্রবাহ এবং সিরিয়া ও লিবিয়া ইস্যুর উল্লেখ করা যায়।
জো বাইডেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর দেশটি পররাষ্ট্রনীতি পুনরুদ্ধারের একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। এতে ইউরোপীয় রাজধানীগুলোতে আশাবাদের সঞ্চার হয়। ট্রাম্পের ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতির পরিবর্তে বাইডেন ন্যাটো, ইইউ ও জাতিসঙ্ঘের সাথে ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক ও কাঠামোগত সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে সমন্বয় করাকে অগ্রাধিকার দেবেন বলে মনে হচ্ছে। ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসের মধ্যকার এই ঘনিষ্ঠ সমন্বয় আগামী দিনগুলোতে আঙ্কারার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। দেশে ও বিদেশে উভয় ক্ষেত্রে তুরস্কের স্বাধীন নীতির পরিপ্রেক্ষিতে, তুরস্ককে ট্রান্স-আটলান্টিক লাইনে ফিরিয়ে আনার জন্য আঙ্কারার সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ককে বিন্যস্ত করতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সম্ভবত দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন।
তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে এবং সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত তাদের শীর্ষ সম্মেলনে উল্লেখ করেছে যে, আঙ্কারার ব্যাপারে তাদের নীতি নতুন মার্কিন প্রশাসনের সাথে দৃঢ়ভাবে সমন্বয় করা হবে। সুতরাং গত সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে সেখানে ট্রান্স-আটলান্টিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ভার্চুয়ালি যোগদান করেছিলেন; সেটাতে আঙ্কারার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ উপসংহার টানা হয়েছে।
প্রথমত, তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করার ব্যাপারে ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্ত কাউন্সিল অব ইউরোপের প্রেসিডেন্ট চার্লস মিশেল ঘোষণা করার পর তুরস্ক সেটাকে স্বাগত জানিয়েছে। তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করার মাধ্যমে সম্প্রতি পূর্ব ভূমধ্যসাগর নিয়ে সঙ্ঘাত এড়ানোর ব্যাপারে যে অগ্রগতি হয়েছে এবং জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে সাইপ্রাস প্রশ্নে আসন্ন আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণের কারণে ইউরোপীয় ইউনিনের নেতৃবৃন্দ খুশি হয়েছেন। এ ছাড়াও ইইউ নেতৃবৃন্দ উল্লেখ করেছেন, সঙ্ঘাত হ্রাস করার বর্তমান প্রচেষ্টা টেকসই হলে এবং আঙ্কারা সঙ্কট সমাধানে গঠনমূলক ভূমিকা গ্রহণ করলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন তুরস্কের সাথে সহযোগিতা জোরদার করার ব্যাপারে পর্যায়ক্রমে, আনুপাতিকভাবে তাদের আচরণ পাল্টে ফেলবে এবং জুন মাসে ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভায় পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ঘোষণাকে ইতিবাচক বলে জানিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক ইস্যুতে খুব বেশি চাপ না দেয়ার কারণেই আঙ্কারা এসব মন্তব্যকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। শীর্ষ বৈঠকের একদিন আগেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতাবিষয়ক ‘ইস্তাম্বুল কনভেনশন’ থেকে সরে আসার ঘোষণা দেয়ায় এবং পশ্চিমাদের কাছ প্রিয়, তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গবর্নরকে বরখাস্ত করায় তুরস্কের বিরুদ্ধে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। অধিকন্তু, শীর্ষ বৈঠকের পর দ্রুত প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে ২২-২৩ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য জলবায়ু সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বাইডেন এই সম্মেলনের উদ্যোগ নিয়েছেন।
এটা বলার প্রয়োজন নেই যে, এখনো তুরস্ক ও ইইউ-যুক্তরাষ্ট্র ব্লকের মধ্যে রাশিয়ায় এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে, ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চল এবং উদ্বাস্তু ইস্যু নিয়ে বিরোধ রয়েছে। তুরস্কের সাথে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র এসব বিরোধ রাতারাতি মিটে যাবে বলে কেউ আশা করে না। ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র যখন যেকোনোভাবে একই সময়ে তাদের ট্্রান্স আটলান্টিক সম্পর্ককে পুনরায় নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত বা পুনর্বিন্যস্ত করতে যাচ্ছে, তখন এ নতুন সংলাপে তুরস্কের সাথে সম্পর্ক বিন্যস্ত করলে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা হবে।
সুতরাং তুরস্ককে অবশ্যই একটি নতুন যুগের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর মধ্যকার সমন্বয় ও সহযোগিতা হবে আরো ঘন ঘন ও খোলামেলা। ইইউর সর্বশেষ শীর্ষ বৈঠকে ইতোমধ্যেই এ ধরনের সমন্বয়ের কথা উচ্চারিত হয়েছে। তাই তুরস্ককে নতুন পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে হবে, যেখানে তাদের নীতি হবে পশ্চিমা বিশ্বমুখী, যেখানে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপীয় ইউনিয়ন বৃহত্তর সমন্বয়।
লেখক : তুর্কি রাজনৈতিক বিশ্লেষক
‘আরব নিউজ’ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার