মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য বজায় রাখা জরুরি কেন?
মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য বজায় রাখা জরুরি কেন? - ছবি সংগৃহীত
আমাদের মুখগহ্বর হলো দেহের অন্দরে প্রবেশের প্রধান পথ। ফলে শরীরের কোথাও সমস্যা তৈরি হলে তার লক্ষণ দেখা যায় মুখগহ্বরে। অন্যদিকে আমরা মুখ দিয়েই নানা ধরনের খাবার খাই। কথা বলার কাজটিও করি। মুখগহ্বরেও তাই জীবাণু সংক্রমণ সহ কিছু অসুখ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেই অসুখগুলোকেও চিহ্নিত করা দরকার। তা না হলে মুখ থেকে সারা শরীরে অসুখ ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর এই কারণেই মুখগহ্বর সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
আমাদের মুখগহ্বরের যে ত্বক থাকে তা দেহের ত্বকের তুলনায় আলাদা। মুখগহ্বরের ত্বকে পাঁচটি স্তর থাকে। কোনোভাবে এই ত্বকে ক্ষত তৈরি হলে খুব দ্রুত সেরে যায়। জানলে অবাক হবেন, কোনো ক্ষত তৈরি হলে দেহের ত্বকের তুলনায় মুখগহ্বরের ত্বক তিনগুণ দ্রুত গতিতে সেরে ওঠে। মুখগহ্বরের ত্বক স্বাস্থ্যকর হওয়ার কতকগুলো শর্ত আছে—
• মুখগহ্বরের লালাগ্রন্থি পূর্ণ দেয়াল অথবা মিউকোসা যেন অটুট থাকে। মিউকোসা যেন চকচকে মনে হয়। এছাড়া মুখগহ্বরের ত্বক হতে হবে নরম। ত্বকের ইলাস্টিসিটি বা স্থিতিস্থাপকতা বজায় থাকতে হবে যাতে হাঁ করলে অন্তত তিনটি আঙুল মুখগহ্বরে ঢুকতে পারে। না ঢুকলে বুঝতে হবে মাড়ি ও মুখগহ্বরের ত্বকে কোনো সমস্যা তৈরি হয়েছে।
• দাঁত থাকবে কেরিজমুক্ত। আবার মাড়ি হতে হবে সংক্রমণমুক্ত। দাঁতের গোড়ায় যেন মাড়ি শক্ত হয়ে লেগে থাকে।
• মুখগহ্বরের তালু ও জিভে কোনো ঘা থাকলে চলবে না। এছাড়া গলার টনসিল গ্রন্থি হতে হবে প্রদাহমুক্ত।
ওরাল হাইজিন কীভাবে নষ্ট হয়?
• ক্ষয়জনিত কারণে বা আঘাতের কারণে দাঁতের কোনো অংশে ধারালো খাঁজ তৈরি হলে বিপদ। দাঁতের ধারালো অংশ মুখগহ্বরের দেয়ালে বারবার ক্ষত তৈরি করে। সেখান থেকে হতে পারে ঘা। এমনকী দাঁতের খোঁচা থেকে আলসার হতে পারে জিভেও। এইধরনের ঘা থেকে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সারা শরীরে যত ধরনের ক্যান্সার হয় তার মধ্যে ৪০ শতাংশই হয় ওরাল ক্যান্সার! এমনকী পুরনো ডেঞ্চার বা কৃত্রিম দাঁত আলগা হয়ে গিয়েও এমন ক্ষত তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বয়স্করা তাই সতর্ক হন।
• ভারতীয়দের মধ্যে পান, সুপারি চিবানোর বদভ্যাস রয়েছে। সুপারির মধ্যে ক্ষতিকর উপাদান বা অ্যালকালয়েড থাকে। দীর্ঘদিন এবং দীর্ঘসময় ধরে সুপারি খেলে মুখগহ্বরের ত্বকে অ্যালকালয়েড অল্প অল্প করে প্রবেশ করতে থাকে। এই অ্যালকালয়েড মুখগহ্বরের ইলাস্টিসিটি নষ্ট করে। এই সমস্যাকে বলে ওরাল সাব মিউকাস ফাইব্রোসিস। অর্থাৎ মিউকোসার তলায় ইলাস্টিসিটি বজায় রাখার জন্য যে কোলাজেন টিস্যু থাকে তা অনমনীয় হয়ে যাওয়া। কোষগুলো সঠিকভাবে পুষ্টি উপাদান পায় না। রুগ্ন হয়ে যায়। ফলে সেখানে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না! দেখা গেছে সুপারি সেবনকারী ২০ শতাংশ মানুষ ওরাল সাবমিউকাস ফাইব্রোসিস-এর সমস্যায় ভোগেন।
• আজকাল আমাদের জিভ ছোলা’র অভ্যাস চলে গিয়েছে যা আমাদের বড় বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কীভাবে? দেখা যাক। জিভের গোড়ার দিকে থাকে ভ্যালেট প্যাপিলা নামে অংশ। এই কোষগুলিতে থাকে স্বাদ গ্রন্থি বা টেস্ট বাড। এদিকে জিভের কোষগুলির দ্রুত বিভাজন হয়। ফলে খুবই তাড়াতাড়ি জিভের ওপরের স্তরের মৃত কোষের জায়গা দখল করে নতুন কোষ। এই কারণেই আঘাত লাগলেও জিভের ক্ষত তাড়াতাড়ি সেরে যায়। জিভ ছোলার অভ্যাস চলে যাওয়ার কারণে জিভের ওপরের স্তরের মৃতকোষগুলো জমতে থাকে এবং ভ্যালেট প্যাপিলাকে আকারে বড় করে তোলে। এই কারণে মুখগহ্বরে জিভের নড়াচড়াও সীমিত হয়ে যায়। দাঁতের সঙ্গে বারবার ঘষা লাগতে থাকে। তৈরি হতে থাকে ক্ষত যা ভবিষ্যতে বড় বিপদ তৈরি করতে পারে।
• মুখগহ্বরের ত্বকে অনেক সময় লাল লাল, সাদা সাদা ছোপ পড়তে দেখা যায়। সাধারণত ধূমপান করার কারণে এমন সাদা ছোপ পড়ে মুখগহ্বরে। খাবার খেলেই রোগীর মুখ জ্বালা জ্বালা করে। এই সমস্যাকে বলে লিউকোপ্লাকিয়া। লিউকোপ্লাকিয়া হতে পারে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণেও। দেখা গেছে যত মানুষের লিউকোপ্লাকিয়া হয়, তার মধ্যে ৫ শতাংশ মানুষের পরবর্তীকালে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে!
• অনেকসময় পানির মতো লাল-সাদা ছোপ দেখা যায় মুখগহ্বরে। এই সমস্যাকে বলে লাইকেন প্লানাস। এক্ষেত্রেও খাবার খাওয়ার পর মুখে জ্বালা জ্বালা ভাব দেখা যায়। ডায়াবেটিস, মারাত্মক দুশ্চিন্তা এই রোগের কারণ। সময়ে চিকিৎসা না হলে লাইকেন প্লানাস পরবর্তীকালে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হতে পারে।
ওরাল হাইজিন বজায় রাখার শর্ত
• এমন কোনো কাজ করা চলবে না যা মুখগহ্বরের মিউকোসা ও ত্বকের ক্ষতিসাধন করে। কারণ মুখগহ্বরে থাকে নানা ধরনের উপকারী কোষ ও লালগ্রন্থিতে যেগুলো ‘ইমিউনোগ্লোবিউলিন এ’ বা রোগপ্রতিরোধী প্রোটিন ক্ষরণ করে। এই কারণেই মুখে ক্ষত তৈরি হলে বা সংক্রমণ হলেও তা সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে না। সুতরাং কোনো রকম মন্দ নেশা করা চলবে না। করা যাবে না ধূমপান। খাওয়া যাবে না পান, সুপারি, খৈনি, গুটকা।
• দাঁত ভেঙে ধারালো হয়ে গেলে তা চিকিৎসকের কাছে গিয়ে ঠিক করে আনতে হবে।
• লিউকোপ্লাকিয়া, লাইকেন প্লানাসের মতো এইরকম আরও অনেক ‘প্রি ক্যান্সারাস’ বা ক্যান্সার হওয়ার আগের অবস্থা রয়েছে যা সঠিক সময়ে ধরা পড়লে ও ওষুধ খেলে একশো শতাংশ ক্ষেত্রে রোগী সুস্থ হয়ে যান। এছাড়া মুখে যেকোনো ঘা হলেই আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কারণ কোনটি সাধারণ ঘা আর কোনো ক্যান্সার তা একমাত্র চিকিৎসকই নির্ধারণ করতে পারেন। ওরাল ক্যান্সার দ্রুত ধরা পড়লে ও সময়ে চিকিৎসা করালে রোগী সুস্থ হয়ে যান। এমনকি রিকনস্ট্রাকটিভ সার্জারির সাহায্যে রোগীর মুখের গঠনও ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব।
• মাড়ি ফুলে গিয়েছে, রক্ত আর পুঁজ বেরচ্ছে দেখলে চিকিৎসকের কাছে যান। আলট্রাসোনিক ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়ে চিকিৎসক মাড়ি পরিষ্কার করে দিলেই পুনরায় মাড়ি পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়।
• দাঁতে কেরিজের কারণে তীব্র ব্যথা শুরু হলে রুট ক্যানাল করে নার্ভ রুট বাদ দিতে হবে। এরপর ওই দাঁতটিকে ফিলিং (ফাঁকা স্থান পূর্ণ করা) বা ক্রাউন (ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতের ওপর টুপি পরানো) করতে হবে। কেরিজপূর্ণ দাঁত রেখে দেওয়া একবারেই অনুচিত। না হলে সেখানে টিউমার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
• অনেকেই দাঁত তুলে ফেলেন। দাঁতের পাটিতে ফাঁকা অংশ থাকলে খাবার চিবিয়ে খেতে যথেষ্ট সমস্যা হয়। তা সত্ত্বেও অনেকে কোনোভাবে অবস্থাটির সঙ্গে মানিয়ে নেন। মুশকিল হল, দাঁতের পাটিতে ফাঁকা অংশ থাকার কারণে, খাবার খাওয়ার সময়, কথা বলার সময় ওপরের চোয়ালের সঙ্গে নিচের চোয়াল সঠিকভাবে জোড়ে না। এই ভারসাম্যে অভাবে কানের নীচের দিকে চোয়ালের টেম্পেরোম্যান্ডিবুলার জয়েন্টে চাপ পড়ে ও সন্নিহিত পেশির ক্ষতি হয়। পেশিগুলোতে ব্যথা শুরু হয়। এই সমস্যা এড়াতে দাঁত তোলার পর সবসময় কৃত্রিম দাঁত বসানোর ব্যবস্থা করুন।
• প্রচণ্ড দুশ্চিন্তার কারণেও ওরাল হাইজিনের সমস্যা দেখা দেয়। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত প্রতিদিন এক্সারসাইজ করুন। ফলে মন চাপমুক্ত থাকে। দূরে থাকে ওরাল হাইজিনের সমস্যাও।
সূত্র : বর্তমান