চীন-তুরস্ক -সৌদি আরব সমীকরণ : যেভাবে বদলে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য
চীন-তুরস্ক -সৌদি আরব - ছবি সংগৃহীত
গত কলামে চীন-ইরান ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষরে নতুন স্বায়ুযুদ্ধের সূচনা এবং মধ্যপ্রাচ্যে গেম চেঞ্জিংয়ের সূত্রপাত হতে পারে বলে মন্তব্য করেছিলাম। সেই কলামের শেষ দিকে ইঙ্গিত ছিল যে এই চুক্তি ইরানের অবস্থানকে মধ্যপ্রাচ্যে সুসংহত করবে, বিষয়টি কেবলই তাই হবে না। বরং সৌদি আরবের সাথে ইরানের যে আঞ্চলিক পর্যায়ের কৌশলগত দ্ব›দ্ব রয়েছে তা বোঝাপড়ার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করতে পারে বেইজিং। সৌদি আরবে চীনা বিনিয়োগ এবং চীনের সাথে সৌদি তেল বাণিজ্যের যে উদ্যোগ তাতে এই সম্ভাবনা দেখা যায়। চীনা স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং ইয়ি ইরান যাওয়ার আগে সৌদি আরব সফরে যাওয়ার পর সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের সাথে তার আলোচনা সম্পর্কে যেসব খবর বেরিয়েছে তাতে সেই ইঙ্গিতই স্পষ্ট পাওয়া যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ক‚টনীতিক অ্যান্টনি ব্লিংকেন জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের নীতি বাস্তবায়নে প্রথম বিদেশ সফরকে অগ্রাধিকার দেয়ার পরে, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মধ্যপ্রাচ্যের ছয় দেশ সফর শুরু করেন। মধ্যপ্রাচ্যের এই ছয় দেশ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেংয়ের চারটি ইউরোপীয় দেশ সফরের পর ৩১ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত চীনের স্টেট কাউন্সিলর আসিয়ান সদস্য সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন যান। দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এর পরপর চীন সফরে গেলেন। তার আগে, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ২২ থেকে ২৩ মার্চ চীন সফর করেন। এসব সফরের প্রতি লক্ষ রাখলে মনে হবে, বড় কোনো অ্যাজেন্ডাকে সামনে নিয়ে বেইজিং ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে।
চীনের শূন্যতা পূরণ ও সম্পর্কের বিস্তার
মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আমেরিকার অবস্থান সঙ্কুচিত হওয়ার ফলে চীন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে বিভিন্ন দিক থেকে তার সম্পর্ক দৃঢ়তর করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। যদিও আমেরিকার শূন্যতা পুরোপুরি পূরণ চীন করতে পারবে বলে মনে হয় না। চীন অদূর ভবিষ্যতে আমেরিকার সামরিক শক্তি প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হিসেবে বিবেচিত হবে না, তবে আঞ্চলিক দেশগুলোর নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এর ক্রমবর্ধমান ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ।
চীন অন্যান্য দেশে মার্কিন প্রভাব রোধ করতে অনেক টুলস ব্যবহার করে থাকে। ওয়াংয়ের মধ্যপ্রাচ্যের ভ্রমণের ঠিক পরই, চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেং-এর হাঙ্গেরি, সার্বিয়া, গ্রিস এবং উত্তর ম্যাসিডোনিয়াতে সফর শুরু করেছেন। তার সফরগুলোর উদ্দেশ্য এই দেশগুলোর সামরিক বাহিনীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ও ব্যবহারিক সহযোগিতা বাড়ানো। এর মধ্যে কয়েকটি দেশ ন্যাটো সদস্য। তদুপরি, গ্রিস ভ‚মধ্যসাগর এবং ইজিয়ান সামুদ্রিক অঞ্চলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) দেশ হিসেবে সা¤প্রতিক বছরগুলোতে অনেকগুলো মার্কিন সামরিক সংস্থার হোস্ট-রূপে কাজ করেছে। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় দু’দেশ তাদের কূটনৈতিক টুলস ব্যবহার করে।
চীন পশ্চিম এশিয়ায় ক্ষমতার গতিশীলতার সতর্কভাবে মূল্যায়ন করার পরে আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে তার সম্পর্কের ভিত্তি তৈরির জন্য অঞ্চলজুড়ে সমানভাবে প্রযোজ্য কিছু অভিন্ন নীতি অনুসরণ করছে। এর অপ্রকাশিত উদ্দেশ্য হলো- আঞ্চলিক দেশগুলোকে পশ্চিমা বিশেষত আমেরিকার আধিপত্য থেকে মুক্ত করে বৈদেশিক নীতিতে স্বনির্ভর সিদ্ধান্ত গ্রহণে উৎসাহ দেয়া। পশ্চিমা শক্তিগুলোর ঐতিহ্যগতভাবে এই অঞ্চলে অবলম্বিত সহিংস কৌশলগুলোর চেয়ে চীনের এ পদ্ধতিটি সম্পূর্ণ আলাদা।
গ্লোবাল টাইমসের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘ইসরাইল ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর আধিপত্য রয়েছে এবং জিনজিয়াং-সম্পর্কিত ইস্যুতে তাদের হামলায় নাম লেখানো আমেরিকার একটি স্বপ্ন। ইরান, সৌদি আরব এবং অন্য দেশগুলো বেইজিংকে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা জিনজিয়াংয়ের বিষয়ে চীনের নীতি সমর্থন করে। ’
পত্রিকাটি প্রশ্ন তুলেছে, আমেরিকা কিভাবে বিভিন্ন স্বার্থ ও মতামত নিয়ে এত দেশকে চীনের বিরুদ্ধে প্রাচীর তৈরি করতে ইটে পরিণত করতে পারবে? চীনের প্রশস্ত পরিবেষ্টন, অন্যান্য দেশগুলোর সাথে চীনের সাধারণ বিনিময়গুলো ওয়াশিংটনের একটি বড় গোলযোগের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে উড়িয়ে দিয়েছে।
চীনা কর্মকর্তাদের ধারণা, ওয়াশিংটন চীনের প্রতিবেশী এবং ইইউকে মার্কিন রথে চলা ও যৌথভাবে চীনের বিরোধিতা করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য অন্যান্য দেশের সাথে চীন বিরোধের সুবিধা নিতে পারছে না। সমসাময়িক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক একমাত্রিক নয়। চীন ও অন্যান্য দেশের পারস্পরিক অনেক স্বার্থ জড়িত যা কোনো ভ‚-রাজনৈতিক ছুরি দিয়ে কেটে ফেলা সহজ নয়।
এটি ঠিক যে, স্নায়ুযুদ্ধের সময় ক‚টনীতির মূল প্রতিপাদ্য ছিল, জোট এবং দ্ব›দ্ব। অনেক ছোট দেশের তাতে জড়িত হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তবে আজকের পরিবর্তিত সময়ের মূল থিম হলো সুষম সম্পর্কের ক‚টনীতি। সব দেশ বড় বড় ক্ষমতাশালীদের বিরোধের সুযোগ নিয়ে তাদের নিজস্ব স্বার্থকে সর্বাধিক নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তবে চীন অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত বিষয় পরিচালনার যুক্তি অনুসরণ করে সম্পর্ক নির্মাণের চেষ্টা করছে। পরিস্থিতি যদি এভাবেই চলতে থাকে তবে শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে মিত্রদের নিয়ে চীনবিরোধী লড়াইয়ে নামা শক্ত হয়ে উঠতে পারে আশা চীনা কর্মকর্তাদের।
চীন-তুরস্ক সম্পর্ক : পররাষ্ট্র সম্পর্কে ভারসাম্য আনার চেষ্টা
মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশের জন্য ওয়াংয়ের সফরসংক্রান্ত ফাইলটিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে এবং তুরস্কের জন্য এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এই বছর দু’দেশের মধ্যে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পঞ্চাশতম বার্ষিকী। দুই দিনের আঙ্কারা সফরকালে ওয়াং তার তুরস্কের প্রতিপক্ষ মেভলুত কাভুুসোগলু এবং রাষ্ট্রপতি রজব তাইয়েব এরদোগানের সাথে দেখা করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রকের এক বিবৃতি অনুসারে, দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
চীনের দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির সাথে বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান প্রভাব তুর্কি নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। যদিও তুরস্ক এবং চীনের মধ্যে সম্পর্কে মাঝে মাঝে ভাটা পড়ে, এরপরও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের সম্পর্ক পারস্পরিক সুবিধার ভিত্তিতে বিকাশের সময়ে প্রবেশ করেছে বলে মনে হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য এবং আন্তঃসরকারি সংলাপ ত্বরান্বিত হয়েছে।
বিআরআই এবং ‘মধ্য করিডোর’ অঞ্চলে তুরস্কের ক্রমবর্ধমান প্রভাব চীনের সাথে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে দেশটির আগ্রহের প্রমাণ দেয়। গত এক দশকে তুরস্ক চীন থেকে ব্যাপক বিনিয়োগ পেয়েছে। অসংখ্য বড় বড় চীনা সংস্থা তাদের সংস্থার জন্য তুরস্ককে একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। তদুপরি, তুরস্ক গত বছরে চীনে রফতানি ট্রেন পাঠানো শুরু করে, চীনে আরো কনস্যুলেট স্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তুরস্কের পতাকাবাহী তুর্কি এয়ারলাইন্সের (টিএইচওয়াই) সরাসরি বিমান নেটওয়ার্ক বহু চীনা শহরে বাড়িয়েছে। তুরস্ক সম্ভবত চীনের সাথে তৃতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও তৈরি করতে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্ব ভ‚মধ্যসাগরে তুরস্কের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার যুক্তির পক্ষে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের (ইউএনএসসি) স্থায়ী সদস্য হিসেবে চীনের সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ব ভূমধ্যসাগরের স্থিতি বিআরআইয়ের স্থায়িত্বকেও প্রভাবিত করে। তুরস্ক চীন থেকে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ক্রয় করেছে।
ওয়াংয়ের সাথে বৈঠকে রাষ্ট্রপতি এরদোগান পারস্পরিক আস্থা বাড়াতে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এবং তুরস্কের মধ্য করিডোর পরিকল্পনার মধ্যে সমন্বয়, আন্তঃসংযোগ অবকাঠামো নির্মাণ এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে তুরস্কের গভীর আগ্রহের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বিনিয়োগ, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের আরো সুষম বিকাশ এবং স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্যকে উৎসাহিত করার কথাও বলা হয়েছে।
এরদোগান মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য চীনের পাঁচ দফা উদ্যোগ এবং আঞ্চলিক বিষয়ে চীনের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয়কে আরো গভীর করার আগ্রহের জন্য প্রশংসা করেন। মূলত, চীন আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে ‘উইন-উইন’ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য গঠনমূলক অ্যাজেন্ডার প্রক্ষেপণ করছে বলে মনে হচ্ছে।
আঙ্কারা যখন পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপড়েনের মুখোমুখি হয় এবং তুর্কি অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন চীনের সাথে তার সম্পর্কের বৃদ্ধি বিকল্প হিসেবে সামনে চলে আসে। ব্লিংকেন যদিও স¤প্রতি বলেছেন যে, বাইডেন প্রশাসন তার মিত্রদের যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে একজনকে বেছে নেয়ার দাবি করবে না, তবুও মনে হয় এই অঞ্চলের মার্কিন মিত্রদের জন্য চীনের আগমন এক ধরনের বিকল্প নিয়ে এসেছে।
চীনের প্রতি তুরস্কের ঝোঁকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে তাদের মাথা না ঘামানোর নীতি। ২০১৩ সালের শেষদিকে, এরদোগান বেইজিংয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে তুরস্কের আগ্রহ দেখাতে তার অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা ও সাবেক উপদেষ্টা আবদুল কাদির এমিন ওনেনকে চীনের রাজধানীতে তুর্কি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত করেন।
আঙ্কারার জন্য চীন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। কারণ এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং একটি প্রধান ব্যবসায়িক শক্তি যা তুরস্ককে তার অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ঘাটতিগুলো কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করতে পারে। অন্যদিকে, চীনের জন্য ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে ভ‚-তাত্তি¡ক এবং মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের অবস্থান বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) কাঠামোর মধ্যে এর একটি কৌশলগত স্থান হিসেবে তুর্কি-চীনা সম্পর্কে নতুন গতিশীলতা আনে।
২০১৫ সালে, আঙ্কারা বিআরআইতে ককেশাস এবং মধ্য এশিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলগুলোতে একটি ‘মধ্যম করিডোর’ হিসেবে সূচনার পয়েন্ট হিসেবে নিজেকে প্রস্তাব করে এবং এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তুরস্ক ২০১৭ সালে বাকু-তিবলিস-কারস রেলপথ প্রকল্পটি সম্পন্ন করেছে এবং এই রুট দিয়ে চীনে প্রথম রফতানি ট্রেনটি গত ডিসেম্বরে ইস্তাম্বুল ছেড়ে একই মাসে মধ্য চীনের জিয়ান শহরে পৌঁছেছে।
বেইজিংয়ের প্রতি আঙ্কারার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তববাদ ভিত্তিক, যা কোনো আদর্শিক পছন্দের পরিবর্তে মূলত অর্থনৈতিক উদ্বেগ দ্বারা পরিচালিত। ২০২০ সালের মধ্যে চীন ও তুরস্কের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায় এবং বেইজিং আঙ্কারার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠে। তবে তুর্কি-চীনা সম্পর্ক এখন অর্থনৈতিক গণ্ডি ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং এর মধ্যে নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক দিকও চলে আসছে বলে অনেকে মনে করেন। উভয় দেশই তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক জোটকে ক্ষতিগ্রস্ত না করার জন্য উইঘুর ইস্যুর মতো বিষয় এড়িয়ে চলেছে।
সিরিয়ার যুদ্ধ আরেকটি ক্ষেত্র যেখানে দুটি দেশের আগ্রহ রয়েছে। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে সর্বশেষ চীন সফরে এরদোগান জোর দিয়েছিলেন যে, তুরস্ক কাউকে চীনের সাথে সম্পর্ক নিয়ে ঝাঁকুনির সুযোগ দেবে না। তিনি রাজনৈতিকভাবে পারস্পরিক বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করা এবং বেইজিংয়ের সাথে নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করার ওপর জোর দেন। অতীতে, এরদোগান এমনও ভেবেছিলেন যে- চীন, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার চারটি দেশের সমন্বিত আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংস্থা সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায় (এসসিও) তার দেশ যোগ দিতে পারে।
এরদোগানের মন্তব্য ন্যাটো সদস্য হিসেবে আঙ্কারার অবস্থান নিয়ে পশ্চিমা রাজধানীগুলোতে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি করে। তবে এটি স্পষ্ট, তুরস্ক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্পর্ক বাড়িয়ে তুলতে এবং তার অংশীদারিত্বকে বৈচিত্র্যময় করার ক্ষমতা রাখে। বিশেষত এমন একটি সময় যখন এই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে এবং তুরস্কের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের টানাপড়েন আরো গভীর হচ্ছে বলে মনে হয়। এস-৪০০ এবং মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে আমেরিকার সমালোচনায় এই অবিশ্বাস আরো বাড়তে পারে। ফলে বেশ কয়েকটি ইস্যুতে মতাদর্শগতভাবে মতবিরোধ থাকা সত্তে¡ও, আঙ্কারা এবং বেইজিং উভয়ই তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থকে সর্বাগ্রে রেখে অগ্রসর হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চীন গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্কের (সিজিটিএন) মতে, আলোচনার সময় তুর্কি নেতারা‘এক চীন’ নীতিতে তুরস্কের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
চীনের প্রবীণ ক‚টনীতিক এবং মধ্যপ্রাচ্যে সাবেক দূত উ সাইক মন্তব্য করেছেন, জাতিগত ও ধর্মীয় ইস্যু সম্পর্কে একে অপরের উদ্বেগের জন্য পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে চীন-তুরস্ক সম্পর্ক গভীরতর হচ্ছে। কিছু চীনা সংবাদমাধ্যমে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, ওয়াংয়ের মধ্যপ্রাচ্যে সফরে চীনা মুদ্রা আরএমবির আন্তর্জাতিকীকরণের বিষয়টিও থাকতে পারে এবং মার্কিন ডলারের অবমূল্যায়নে এটি নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করতে পারে।
আঙ্কারার বিশ্লেষকদের ধারণা, তুরস্ক তার সুষম নীতি বজায় রাখতে পারবে এবং দুটি বড় শক্তির মধ্যে যুদ্ধে জড়ানো এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তুরস্ক ন্যাটো সদস্য হলেও বর্তমান বিরোধটি ন্যাটো অ্যাজেন্ডার বিষয় নয়। স¤প্রতি নাভা সম্মেলনে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট অব অ্যান্টনি ব্লিংকেনের সাথে প্রথম মুখোমুখি বৈঠক করেছিলেন আভুয়ানোলু। উভয় পক্ষই একে অপরের পক্ষে সমর্থন প্রকাশ করেছে।
তুরস্কের বহুমাত্রিক বৈদেশিক নীতি দেশটিকে অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে তুরস্কের ‘নতুন এশিয়া উদ্যোগ’-এ তুরস্ক-চীন সম্পর্কগুলো বিকশিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে, তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সদস্য। নতুন স্নায়ুযুদ্ধকে কেন্দ্র করে চীন-আমেরিকা সংঘাত বেধে গেলে তুরস্কের পক্ষে চীনের সাথে সম্পর্ক এখন যেভাবে এগুচ্ছে সেভাবে বজায় রাখা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। বিশেষত পাশ্চাত্য এখন যেখানে করোনাভাইরাস সংক্রমণকে চীনের জীবাণু যুদ্ধের অংশ বলে মনে করে। আর যুক্তরাষ্ট্র চীন-রাশিয়াকে প্রধান কৌশলগত শত্রু হিসাবে চিহিৃত করেছে। এমনও বলা হচ্ছে সভ্যতার দ্ব›দ্ব থিউরি দিয়ে মুসলিমদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে চিহিৃত করে গত ৩০ বছর চীন-রাশিয়া শক্তিমান হয়ে পাশ্চাত্যকে চ্যালেঞ্জ করার পর্যায়ে যাবার অবকাশ দেয়া হয়েছে।
সৌদি-চীন সম্পর্ক : মার্কিন নির্ভরতা হ্রাসের চেষ্টা
ওয়াংয়ের আঞ্চলিক সফরে তিনি সৌদি আরব হয়ে যে ইরান ভ্রমণ করেন, তার প্রতীকী ও তাৎপর্যপূর্ণ গুরুত্ব- উভয়ই রয়েছে। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে ২৪ মার্চ রিয়াদে বৈঠকে ওয়াং বলেছেন, চীন সার্বভৌমত্ব, জাতীয় মর্যাদা, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় সৌদি আরবকে সমর্থন এবং যেকোনো অজুহাতে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে।
যুবরাজ মোহাম্মদ প্রতিক্রিয়ায় নিশ্চিত করেন, চীনা উত্থান বিশ্ব শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির পাশাপাশি আরো সুষম বৈশ্বিক সম্পর্কের বিকাশে সহায়ক হবে। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স আশা প্রকাশ করেন যে, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে উচ্চ স্তরে উন্নীত করতে দুই দেশ সন্ত্রাসবিরোধী ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়িয়ে তুলবে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, ক্রাউন প্রিন্স বলেছেন, সৌদি আরব জিনজিয়াং ও হংকং সম্পর্কিত ইস্যুতে চীনের বৈধ অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে, যেকোনো অজুহাতে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরোধিতা এবং চীন ও ইসলামী বিশ্বের মধ্যে মতবিরোধ বপন করার জন্য কয়েকটি পক্ষের প্রয়াসকে প্রত্যাখ্যান করে।
দু’পক্ষের বক্তব্যে মনে হয় যে, চীন ইরানের সাথে ২৫ বছরের যে চুক্তি করেছে তা সৌদি আরবের সাথে চীনের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। সৌদি নিরাপত্তা উদ্বেগ নিরসন এবং সৌদি তেলের চীনা বাজারের সুযোগ সৃষ্টি আর সৌদি আরবে চীনা বিনিয়োগের মাধ্যমে এমন একটি সম্পর্ক নির্মাণ করা হবে যা সৌদি আরবকে চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকা শিবিরের টুলস করবে না; অন্যদিকে সৌদি নিরাপত্তায় ইরানের যেকোনো প্রচেষ্টায় চীন বাধা তৈরি করে সমঝোতামূলক নীতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করবে।
সাধারণভাবে বলতে গেলে, সৌদি আরব চীনের বিরুদ্ধে জিনজিয়াং সম্পর্কিত বর্তমান মার্কিন প্রচারণায় অংশ নিচ্ছে না। জিনজিয়াং ইস্যুতে চীনকে চাপে ফেলা বাইডেন প্রশাসনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ কৌশল। প্রকৃতপক্ষে, ওয়াংয়ের আঞ্চলিক সফর ও মাঠের এই বাস্তবতায় মনে হয় যে চীনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করার অংশীদার কমে যাচ্ছে।
তবে সৌদি আরব শতাব্দিকাল থেকে পাশ্চাত্যের কৌশলগত বন্ধু। এখন চীনের সাথে কতটা ঘনিষ্ঠ হতে পারবে তুরস্কের মতোই তারও একটি সীমানা থাকবে বলে মনে হয়। চীন-রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক নিয়ে এখনো যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্ররা চূড়ান্ত তৎপরতা শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে এ বিষয়টি আগে থেকে অনুমান করে চীন তার অভিযান শুরু করেছে বলে মনে হচ্ছে।
ই শক্তির দ্বন্দ্ব সামনে খোলাসা হবে
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িত, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্দিষ্ট কিছু দেশ ‘মানবাধিকার’ এবং ‘গণতন্ত্রের’ নামে চীনকে চাপ দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি তৃতীয় পক্ষের দেশগুলোকে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি পক্ষ বেছে নেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করার পর্যায়ে এখনো যায়নি। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয় বৃটেন জার্মানি জাপানের মতো দেশও হঠাৎ করেই তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে শুরু করেছে। প্রাক সংঘাতের একটি প্রস্তুতি পাশ্চাত্যে শুরু হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
এই বিষয়টি চীন ও রাশিয়া দুই পক্ষের অজানা নেই। দুটি প্রধান শক্তি অংশীদার দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে তাদের বন্ধু অঞ্চলের ক্ষেত্র বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে চীনা প্রয়াস যতটা জনসমক্ষে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ততটা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে হয়নি। উভয় পক্ষ যখন সমানভাবে মাঠে সক্রিয় হবে তখন বিষয়টি হবে আরো স্পষ্ট।
তবে চীন শুধু মধ্যপ্রাচ্যে তার মনোযোগ বিশেষভাবে নিবদ্ধ করেনি, দক্ষিণ এশিয়াতে নতুন মেরুকরণের সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে। চীন এই অঞ্চলে প্রতিদ্ব›দ্বী ভারতের সাথে বিরোধের বিষয়গুলো নমনীয় করে অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বাড়িয়ে তুলতে মনোযোগী হচ্ছে। পাকিস্তানের সাথে তিক্ততা নিরসনে আলোচনার উদ্যোগ এবং মিয়ানমার-বাংলাদেশে আমেরিকার হস্তক্ষেপ বা প্রভাববিরোধী সমঝোতার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। মিয়ানমারে বিদ্রোহ চাঙ্গা হওয়া ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এমনকি বাংলাদেশ নতুন মেরুকরণ সৃষ্টির বাইরে নেই। এ নিয়ে পরে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
mrkmmb@gmail.com