চীন-তুরস্ক সম্পর্কে নতুন মাত্রা

মাসুম খলিলী | Apr 06, 2021 03:57 pm
এরদোগান ও শি

এরদোগান ও শি - ছবি সংগৃহীত

 

মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশের জন্য ওয়াংয়ের সফরসংক্রান্ত ফাইলটিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে এবং তুরস্কের জন্য এটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এই বছর দু’দেশের মধ্যে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পঞ্চাশতম বার্ষিকী। দুই দিনের আঙ্কারা সফরকালে ওয়াং তার তুরস্কের প্রতিপক্ষ মেভলুত কাভুুসোগলু এবং রাষ্ট্রপতি রজব তাইয়েব এরদোগানের সাথে দেখা করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রকের এক বিবৃতি অনুসারে, দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।

চীনের দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির সাথে বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান প্রভাব তুর্কি নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। যদিও তুরস্ক এবং চীনের মধ্যে সম্পর্কে মাঝে মাঝে ভাটা পড়ে, এরপরও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের সম্পর্ক পারস্পরিক সুবিধার ভিত্তিতে বিকাশের সময়ে প্রবেশ করেছে বলে মনে হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য এবং আন্তঃসরকারি সংলাপ ত্বরান্বিত হয়েছে।

বিআরআই এবং ‘মধ্য করিডোর’ অঞ্চলে তুরস্কের ক্রমবর্ধমান প্রভাব চীনের সাথে সহযোগিতা করার ক্ষেত্রে দেশটির আগ্রহের প্রমাণ দেয়। গত এক দশকে তুরস্ক চীন থেকে ব্যাপক বিনিয়োগ পেয়েছে। অসংখ্য বড় বড় চীনা সংস্থা তাদের সংস্থার জন্য তুরস্ককে একটি আঞ্চলিক কেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। তদুপরি, তুরস্ক গত বছরে চীনে রফতানি ট্রেন পাঠানো শুরু করে, চীনে আরো কনস্যুলেট স্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তুরস্কের পতাকাবাহী তুর্কি এয়ারলাইন্সের (টিএইচওয়াই) সরাসরি বিমান নেটওয়ার্ক বহু চীনা শহরে বাড়িয়েছে। তুরস্ক সম্ভবত চীনের সাথে তৃতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও তৈরি করতে যাচ্ছে।

রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্ব ভ‚মধ্যসাগরে তুরস্কের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার যুক্তির পক্ষে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের (ইউএনএসসি) স্থায়ী সদস্য হিসেবে চীনের সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পূর্ব ভূমধ্যসাগরের স্থিতি বিআরআইয়ের স্থায়িত্বকেও প্রভাবিত করে। তুরস্ক চীন থেকে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ক্রয় করেছে।

ওয়াংয়ের সাথে বৈঠকে রাষ্ট্রপতি এরদোগান পারস্পরিক আস্থা বাড়াতে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এবং তুরস্কের মধ্য করিডোর পরিকল্পনার মধ্যে সমন্বয়, আন্তঃসংযোগ অবকাঠামো নির্মাণ এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে তুরস্কের গভীর আগ্রহের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। বিনিয়োগ, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের আরো সুষম বিকাশ এবং স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্যকে উৎসাহিত করার কথাও বলা হয়েছে।

এরদোগান মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য চীনের পাঁচ দফা উদ্যোগ এবং আঞ্চলিক বিষয়ে চীনের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয়কে আরো গভীর করার আগ্রহের জন্য প্রশংসা করেন। মূলত, চীন আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে ‘উইন-উইন’ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য গঠনমূলক অ্যাজেন্ডার প্রক্ষেপণ করছে বলে মনে হচ্ছে।
আঙ্কারা যখন পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে টানাপড়েনের মুখোমুখি হয় এবং তুর্কি অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন চীনের সাথে তার সম্পর্কের বৃদ্ধি বিকল্প হিসেবে সামনে চলে আসে। ব্লিংকেন যদিও স¤প্রতি বলেছেন যে, বাইডেন প্রশাসন তার মিত্রদের যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে একজনকে বেছে নেয়ার দাবি করবে না, তবুও মনে হয় এই অঞ্চলের মার্কিন মিত্রদের জন্য চীনের আগমন এক ধরনের বিকল্প নিয়ে এসেছে।

চীনের প্রতি তুরস্কের ঝোঁকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে তাদের মাথা না ঘামানোর নীতি। ২০১৩ সালের শেষদিকে, এরদোগান বেইজিংয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে তুরস্কের আগ্রহ দেখাতে তার অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা ও সাবেক উপদেষ্টা আবদুল কাদির এমিন ওনেনকে চীনের রাজধানীতে তুর্কি রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিযুক্ত করেন।

আঙ্কারার জন্য চীন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। কারণ এটি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং একটি প্রধান ব্যবসায়িক শক্তি যা তুরস্ককে তার অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ঘাটতিগুলো কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করতে পারে। অন্যদিকে, চীনের জন্য ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে ভ‚-তাত্তি¡ক এবং মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্কের অবস্থান বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) কাঠামোর মধ্যে এর একটি কৌশলগত স্থান হিসেবে তুর্কি-চীনা সম্পর্কে নতুন গতিশীলতা আনে।

২০১৫ সালে, আঙ্কারা বিআরআইতে ককেশাস এবং মধ্য এশিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলগুলোতে একটি ‘মধ্যম করিডোর’ হিসেবে সূচনার পয়েন্ট হিসেবে নিজেকে প্রস্তাব করে এবং এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে তুরস্ক ২০১৭ সালে বাকু-তিবলিস-কারস রেলপথ প্রকল্পটি সম্পন্ন করেছে এবং এই রুট দিয়ে চীনে প্রথম রফতানি ট্রেনটি গত ডিসেম্বরে ইস্তাম্বুল ছেড়ে একই মাসে মধ্য চীনের জিয়ান শহরে পৌঁছেছে।

বেইজিংয়ের প্রতি আঙ্কারার দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তববাদ ভিত্তিক, যা কোনো আদর্শিক পছন্দের পরিবর্তে মূলত অর্থনৈতিক উদ্বেগ দ্বারা পরিচালিত। ২০২০ সালের মধ্যে চীন ও তুরস্কের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায় এবং বেইজিং আঙ্কারার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠে। তবে তুর্কি-চীনা সম্পর্ক এখন অর্থনৈতিক গণ্ডি ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং এর মধ্যে নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক দিকও চলে আসছে বলে অনেকে মনে করেন। উভয় দেশই তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক জোটকে ক্ষতিগ্রস্ত না করার জন্য উইঘুর ইস্যুর মতো বিষয় এড়িয়ে চলেছে।

সিরিয়ার যুদ্ধ আরেকটি ক্ষেত্র যেখানে দুটি দেশের আগ্রহ রয়েছে। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে সর্বশেষ চীন সফরে এরদোগান জোর দিয়েছিলেন যে, তুরস্ক কাউকে চীনের সাথে সম্পর্ক নিয়ে ঝাঁকুনির সুযোগ দেবে না। তিনি রাজনৈতিকভাবে পারস্পরিক বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করা এবং বেইজিংয়ের সাথে নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করার ওপর জোর দেন। অতীতে, এরদোগান এমনও ভেবেছিলেন যে- চীন, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার চারটি দেশের সমন্বিত আঞ্চলিক নিরাপত্তা সংস্থা সাংহাই সহযোগিতা সংস্থায় (এসসিও) তার দেশ যোগ দিতে পারে।

এরদোগানের মন্তব্য ন্যাটো সদস্য হিসেবে আঙ্কারার অবস্থান নিয়ে পশ্চিমা রাজধানীগুলোতে আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি করে। তবে এটি স্পষ্ট, তুরস্ক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্পর্ক বাড়িয়ে তুলতে এবং তার অংশীদারিত্বকে বৈচিত্র্যময় করার ক্ষমতা রাখে। বিশেষত এমন একটি সময় যখন এই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে এবং তুরস্কের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের টানাপড়েন আরো গভীর হচ্ছে বলে মনে হয়। এস-৪০০ এবং মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে আমেরিকার সমালোচনায় এই অবিশ্বাস আরো বাড়তে পারে। ফলে বেশ কয়েকটি ইস্যুতে মতাদর্শগতভাবে মতবিরোধ থাকা সত্তে¡ও, আঙ্কারা এবং বেইজিং উভয়ই তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থকে সর্বাগ্রে রেখে অগ্রসর হচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চীন গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্কের (সিজিটিএন) মতে, আলোচনার সময় তুর্কি নেতারা‘এক চীন’ নীতিতে তুরস্কের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।

চীনের প্রবীণ ক‚টনীতিক এবং মধ্যপ্রাচ্যে সাবেক দূত উ সাইক মন্তব্য করেছেন, জাতিগত ও ধর্মীয় ইস্যু সম্পর্কে একে অপরের উদ্বেগের জন্য পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে চীন-তুরস্ক সম্পর্ক গভীরতর হচ্ছে। কিছু চীনা সংবাদমাধ্যমে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, ওয়াংয়ের মধ্যপ্রাচ্যে সফরে চীনা মুদ্রা আরএমবির আন্তর্জাতিকীকরণের বিষয়টিও থাকতে পারে এবং মার্কিন ডলারের অবমূল্যায়নে এটি নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করতে পারে।

আঙ্কারার বিশ্লেষকদের ধারণা, তুরস্ক তার সুষম নীতি বজায় রাখতে পারবে এবং দুটি বড় শক্তির মধ্যে যুদ্ধে জড়ানো এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তুরস্ক ন্যাটো সদস্য হলেও বর্তমান বিরোধটি ন্যাটো অ্যাজেন্ডার বিষয় নয়। স¤প্রতি নাভা সম্মেলনে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট অব অ্যান্টনি ব্লিংকেনের সাথে প্রথম মুখোমুখি বৈঠক করেছিলেন আভুয়ানোলু। উভয় পক্ষই একে অপরের পক্ষে সমর্থন প্রকাশ করেছে।

তুরস্কের বহুমাত্রিক বৈদেশিক নীতি দেশটিকে অন্য দেশের সাথে সম্পর্ক বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে তুরস্কের ‘নতুন এশিয়া উদ্যোগ’-এ তুরস্ক-চীন সম্পর্কগুলো বিকশিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে, তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের সদস্য। নতুন স্নায়ুযুদ্ধকে কেন্দ্র করে চীন-আমেরিকা সংঘাত বেধে গেলে তুরস্কের পক্ষে চীনের সাথে সম্পর্ক এখন যেভাবে এগুচ্ছে সেভাবে বজায় রাখা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। বিশেষত পাশ্চাত্য এখন যেখানে করোনাভাইরাস সংক্রমণকে চীনের জীবাণু যুদ্ধের অংশ বলে মনে করে। আর যুক্তরাষ্ট্র চীন-রাশিয়াকে প্রধান কৌশলগত শত্রু হিসাবে চিহিৃত করেছে। এমনও বলা হচ্ছে সভ্যতার দ্বদ্ব থিউরি দিয়ে মুসলিমদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে চিহিৃত করে গত ৩০ বছর চীন-রাশিয়া শক্তিমান হয়ে পাশ্চাত্যকে চ্যালেঞ্জ করার পর্যায়ে যাবার অবকাশ দেয়া হয়েছে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us