মুসলিম ভোট নিয়ে মমতা চিন্তিত!
টালিউড নায়িকা নুসরাতের সাথে মমতা - ছবি সংগৃহীত
ভারতের সংখ্যালঘুদের (মুসলিম) ভোট পেতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মতো এতটা কাজ সম্ভবত আর কেউ করেননি। পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠেয় পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপের ৭৫ আসনে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের ভোটই প্রধান নির্ধারকের ভূমিকা পালন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মমতা ব্যানার্জি এখন এ ভয়ে আছেন যে হয়ত তার ‘সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক’ বিভিন্ন দলের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে।
আর এর মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে আগের মতো সংখ্যালঘুদের (মুসলিম) ভোট তিনি নাও পেতে পারেন। অথচ আগের দু’নির্বাচনে তিনি সংখ্যালঘুদের (মুসলিম) একচেটিয়া সমর্থন পেয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যে ভীত-স্বন্ত্রস্ত তার প্রমাণ তিনি তার সাম্প্রতিক বক্তৃতায় দিয়েছেন। তিনি তার বক্তব্যে নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করেছেন হায়দরাবাদের কোনো লোক যেন পশ্চিমবঙ্গে না আসতে পারে। কারণ, মমতার মতে তিনি বিজেপির টাকা খেয়েছেন, তাই পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন। তিনি এ বক্তব্যের মাধ্যমে অল ইন্ডিয়া মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের প্রধান আসাদ-উদ্দিন ওয়াইসির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যিনি একা এ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। তিনি ফুরফুরা শরিফের পীর আব্বাস সিদ্দিকেরও সমালোচনা করেছেন। আব্বাস সিদ্দিক ‘ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট’ দল গঠন করেছেন এবং কংগ্রেস ও বামদের সাথে মিলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
মুসলিম ভোটার অধুষ্যিত কোচবিহার জেলায় একটি নির্বাচনী সমাবেশে মমতা ব্যানার্জি বলেন, ‘হায়দরাবাদের দল ও হুগলির বাচাল লোককে নিয়ে মেতে উঠবেন না। তারা টাকা দিয়ে (মুসলিম) ভোটারদের বিভক্ত করতে চাচ্ছেন। তারা আপনাদের যতই ভয় দেখাক একটি ভোটও যাতে বিভক্ত না হয়। তারা হিন্দু ও মুসলিম ভোটারদের বিভক্ত করতে চাচ্ছে। তাহলে মমতা ব্যানার্জি কে? তিনি কি হিন্দু নাকি মুসলিম?‘
আমরা বিশ্লেষণে যাবার আগে এ রাজ্যের জনসংখ্যার গঠন দেখব। এর মাধ্যমে নির্বাচনের হিসাব সহজ হবে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে পশ্চিমবঙ্গে দু’কোটি ৪৬ লাখ মুসলিম আছে। তারা এ রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ২৭.০১ শতাংশ।
বাংলার মুসলিমরা তিন জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। জেলাগুলো হলো মালদা, মুর্শিদাবাদ ও উত্তর দিনাজপুর। মুসলিমরা রাজ্যের মোট ভোটের ৩০ শতাংশ। এটা বিশ্বাস করা হয় যে যদি কোনো দল এককভাবে সংখ্যালঘুদের ভোট পায় তাহলে তারা সহজেই ক্ষমতা লাভ করবে। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের ২৯৪ আসনের মধ্যে ১২৫ আসনে মুসলমানদের সংখা উল্লেখযোগ্য। এছাড়া হাওড়া, বিরভূম, মুর্শিদাবাদ, উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাতে মুসলিমদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে মুসলিম ভোটব্যাংক সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর। প্রায় ৩৫ বছর ধরে এ ব্যাপারটি লক্ষ্য করা গেছে। আগে এ রাজ্যের মুসলিম ভোট একচেটিয়াভাবে বাম ফ্রন্ট পেত। পরে তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল পরিবর্তন নিয়ে আসে। তারা সিঙ্গুর ও নন্দী গ্রামের আন্দোলনের মাধ্যমে কৃষক, শ্রমিক ও মুসলিমদের মন জয় করে নেয়। এরপর থেকে মুসলিমদের ভোটের বিশাল অংশ পেতে থাকে তৃণমূল কংগ্রেস। তারপরও ওই সময়ের ২০১১ সালের নির্বাচনে বাম ফ্রন্ট মুসলিমদের ৪৫ শতাংশ ভোট পায়। এ কারণে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে ভোটে জয়লাভ করা ছিল কষ্টকর।
মুসলিম ভোটারদের বিশাল অংশ যে তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করত তার প্রমাণ, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তারা ৪২ আসনের মধ্যে ৩৪ আসন পায়। এ সময় তারা ৪০ ভাগ মুসলিম ভোটারদের সমর্থন পায়।
যদিও ওই সময়ে কংগ্রেস ও বাম ফ্রন্ট মুসলিমদের ৫৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। কিন্তু, তারা আলাদাভাবে নির্বাচন করেছিল। এ কারণে মমতা ব্যানার্জি নির্বাচনে ভালো ফল করেছিলেন।
২০১৬ সালে কংগ্রেস ও বাম ফ্রন্ট যুক্তভাবে নির্বাচন করে। তারা যুক্তভাবে মুসলিমদের ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। আর তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ৫১ শতাংশ মুসলিম ভোট। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস মুসলিদের বিপুল ভোট পায়, তারা ৭০ শতাংশ মুসলিম ভোট পেয়ে সরকার গঠন করে। এ সময়ে বাম ফ্রন্ট ও কংগ্রেস যথাক্রমে ১০ শতাংশ ও ১২ শতাংশ মুসলিম ভোট পায়।
কিন্তু, ২০১৯ সাল থেকে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। তারা লোকসভার ১৮ আসনে জয় পায়। এ সময় তৃণমূল কংগ্রেসের আসন ৩৪ থেকে কমে ২২টিতে সীমাবদ্ধ হয়। বিধানসভার হিসাব অনুসারে তৃণমূল কংগ্রেস ১৬৪ আসনে আর বিজেপি ১২১ আসনে আধিপত্য বিস্তার করে। তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে ভোটের পার্থক্য ছিল ৩.১ ভাগ। এ মাধ্যমে বিজেপি নজিরবিহীন ভালো ফল লাভ করে। পশ্চিমবঙ্গের লোকসভায় ২০১৪ সালে তাদের আসন ছিল ২, আর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তা বিপুল সংখ্যায় বেড়ে হয় ১৮।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান রিপোর্ট অনুসারে বিজেপি সফলতার সাথে হিন্দু ও আদিবাসী ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পেরেছে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ১৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এ ভোট প্রাপ্তির হার বেড়ে হয় ৪০ শতাংশরও বেশি। এ সময় বিজেপি ৫৭ শতাংশ হিন্দু ভোট পায়।
সেন্টার ফর স্টাডি অব ডেভলপিং সোসাইটির হিসাব অনুসারে, বিজেপি এ নির্বাচনে ৫৭ শতাংশ উচ্চবর্ণের ভোট পায়। এছাড়া অনগ্রসর শ্রেণীর ৬৫ শতাংশ, তফশিলি গোষ্ঠীর ৬১ শতাংশ ও ৫৮ শতাংশ আদিবাসী ভোটারদের ভোট লাভ করে এ হিন্দুত্ববাদী দলটি।
যেহেতু হিন্দু ভোটাররা বিজেপিকে সমর্থন করছে। তাই মমতা ব্যানার্জিকে মুসলিম ভোটের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। যদি সিদ্দিকী ও ওয়াইসি তৃণমূল কংগ্রেসের থেকে মুসলিম ভোটারদের ছিনিয়ে নিতে পারে, তবেই বিজেপি পক্ষে শেষ হাসি হাসা সম্ভব।
অপরদিকে মমতা যদি মুসলিম ভোটব্যাংক ধরে রাখতে পারেন, তাহলে তিনি হবেন গেরুয়া শিবিরের একটি অন্যতম প্রতিরোধক।
সূত্র : মুসলিম মিরর