প্রিন্স হামজা, রানি নূর ও জর্ডানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্র
প্রিন্স হামজা ও তার মা, রানি নূর - ছবি সংগৃহীত
জর্ডানে খুবই ইন্টারেস্টিং একটা ঘটনা ঘটেছে।
জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করার প্রচেষ্টার অভিযোগে দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা অন্তত ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে। এবং এই অভ্যুত্থানে মদদ দেওয়ার অভিযোগে বাদশাহ আব্দুল্লাহর সৎ ভাই, সাবেক ক্রাউন প্রিন্স হামজা বিন হুসেইনকে গৃহবন্দী থাকার নির্দেশ দিয়েছেন আব্দুল্লাহ।
সরকারিভাবে অভ্যুত্থানের পেছনে বিদেশী কিছু রাষ্ট্র (ইসরাইলসহ) জড়িত থাকার ব্যাপারে অভিযোগ করা হয়েছে। অবশ্য বাস্তবে বাদশাহ আব্দুল্লাহর সাথেও ইসরাইলের সম্পর্ক খারাপ নয়। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর প্রবাসী এক ইসরাইলি কর্মকর্তা হামজা এবং তার স্ত্রীকে নিরাপদে জর্ডান থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন বলেও দেশটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
জর্ডানের রাজপরিবারে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র নতুন না। ক্ষমতা গ্রহণকে কেন্দ্র করে এর আগেও আব্দুল্লাহর বাবা বাদশাহ হুসেইনের স্ত্রীদের এবং তাদের ছেলেদের মধ্যে শীতল লড়াই চলেছিল। এবং হামজার সাথেও যে ভবিষ্যতে আব্দুল্লাহর ছেলে দ্বিতীয় হুসেইনের দ্বন্দ্ব শুরু হতে পারে, সেটা অনুমিত ছিল।
গত বছর প্রিন্সেস সারভাত ইকরামউল্লাহকে নিয়ে লিখতে গিয়ে এ ব্যাপারটার উপর আলোকপাত করেছিলাম। আবার তুলে দিচ্ছি লেখাটা :
যে বাঙালি নারী হতে যাচ্ছিলেন জর্ডানের রানি!
তার নাম সারভাত একরামউল্লাহ। জন্ম কলকাতায়। তার বাবা ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব, আর মা ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম দুই নারী এমপির একজন।
কিন্তু তার আরেকটি পরিচয়ও আছে। তিনি হচ্ছেন পাকিস্তানের এককালের প্রধানমন্ত্রী, এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর ভাগ্নি। তার মা ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর মামাতো বোন। এবং এই সারভাতেরই হওয়ার কথা ছিল জর্ডানের রানি!
সারভাতের বিয়ে হয়েছিল জর্ডানের ক্রাউন প্রিন্স হাসান বিন তালালের সাথে। সে সময় ক্ষমতায় ছিলেন হাসানের বড় ভাই, বাদশাহ হুসেইন বিন তালাল। এবং হুসেইনের মৃত্যু হলে হাসানেরই রাজা হওয়ার কথা ছিল। নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে অবশ্য ক্রাউন প্রিন্স ছিলেন হুসেইনের বড় ছেলে আব্দুল্লাহ। কিন্তু আব্দুল্লাহর মা, রানি মুনা ছিলেন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত। সে হিসেবে আব্দুল্লাহ ছিলেন হাফ ব্রিটিশ।
ষাটের দশকের উত্তাল সময়ে বাদশাহ হুসেইনের বিরুদ্ধে যখন নানান ধরনের ষড়যন্ত্র চলছিল, তখন তিনি বিতর্ক এড়ানোর জন্য এবং পুত্রের জীবনের নিরপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তার পরিবর্তে ভাই হাসানকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মনোনীত করেন।
১৯৬৮ সালে ক্রাউন প্রিন্স হাসান বিয়ে করেন সারভাত একরামউল্লাহকে। ফলে বাঙালি নারী সারভাত হয়ে যান জর্ডানের ক্রাউন প্রিন্সেস - সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ রানি। পরবর্তী ৩০ বছর তিনি এই পদে বহাল থাকেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে, মৃত্যুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে হাসপাতালের বিছানায় শোয়া বাদশাহ হুসেইন হঠাৎ তার ভাইয়ের মনোনয়ন বাতিল করে নিজের বড় ছেলে আব্দুল্লাহকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মনোনীত করেন। সারভাতের রানি হওয়ার স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়।
শোনা যায়, হুসেইনের এই সিদ্ধান্তের পেছনে তার আরেক স্ত্রী, রানি নূরের ভূমিকা ছিল। নূরের সাথে সারভাতের বেশ দ্বন্দ্ব ছিল। নূর, আব্দুল্লাহ এবং হুসেইনকে প্ররোচিত করেন আব্দুল্লাহকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগ দিতে। বিনিময়ে তার চাওয়া ছিল আব্দুল্লাহ সিংহাসনে বসলে তার নিজের ছেলেকে ক্রাউন প্রিন্স বানাতে হবে। হুসেইন এবং আব্দুল্লাহ রাজি হন।
বাদশাহ হুসেইনের মৃত্যুর আগে এবং পরের দিনগুলোতে সিংহাসনের এই খেলাকে কেন্দ্র করে হুসেইনের স্ত্রী নূর, এবং হাসানের স্ত্রী সারভাতের মধ্যে বেশ স্নায়ু যুদ্ধ চলে। তারা একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন অপপ্রচার চালান। নূর দাবি করেন, হুসেইনের মৃত্যুর আগেই সারভাত নিজের মতো করে প্রাসাদ সাজাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। অন্যদিকে সারভাত দাবি করেন, নূর ইহুদি বংশোদ্ভূত।
যাইহোক, শেষ পর্যন্ত আব্দু্ল্লাহ সিংহাসনে বসেন এবং তিনি তার সৎ মা নূরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখেন। ক্ষমতা গ্রহণ করার পর প্রথমেই তিনি ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগ দেন তার সৎ ভাই, প্রিন্স হামজাকে। কিন্তু কয়েক বছর পর, আব্দুল্লাহর নিজের ছেলে হুসেইনের বয়স যখন ১৮ বছর হয়, তখন তিনিও তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। হামজার মনোনয়ন বাতিল করে তিনি নিজের ছেলেকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মনোনয়ন দেন।
এই সেই প্রিন্স হামজা। ক্রাউন্স প্রিন্সের পদ থেকে অপসারিত হওয়ার ১৭ বছর পর তিনি আবার আন্তর্জাতিক সংবাদের শিরোনাম হলেন।