করোনা নিয়ে কী হচ্ছে?
করোনা নিয়ে কী হচ্ছে? - ছবি সংগৃহীত
এক বছর আগে যা সাধারণ ছুটি ছিল, এক বছর পর সেই একই জিনিস হাজির হলো লকডাউন নামে৷ এই পুরোটা সময়ে নেই কোনো পরিকল্পনা৷ করোনার অ্যাকশনের বদলে সরকার ও জনগণ কেবল রিঅ্যাকশনই দেখিয়েছে৷
করোনা বাংলাদেশে আসার আগেই আমরা শুনেছি, 'আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী', 'মাস্ক-পিপিইর কোনো অভাব নেই', 'আমাদের বিমানবন্দর প্রস্তুত'৷
অথচ, বাস্তবে যখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়েও কয়েক মাস পর বাংলাদেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হলো, তখন দেখা গেলো করোনায় শত শত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, মাস্ক-পিপিইর সংকট, বিমানবন্দরে কোনো ব্যবস্থা নেই, কোয়ারান্টিন নিয়ে ঝামেলা।
বিদেশ থেকে কপি-পেস্ট করে সরকার বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি দিয়ে দিলো৷ অথচ এই সাধারণ ছুটিতে খেটে খাওয়া মানুষ, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের কী হবে? এ বিষয়ে কেউ কিছু জানে না৷
পুলিশ ও প্রশাসন এমনকি মাঠ পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরাও রাস্তায় নেমে মাস্ক না পরার কারণে মানুষকে কানে ধরাতে লাগলেন, লাঠিপেটা করাতে লাগলেন। শুরুতে মধ্যবিত্ত তার উন্নাসিক মানসিকতা নিয়ে এই গায়ের জোরে বাসায় রাখার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করলেও যখন বুঝতে পারলো এমনটা চলতে থাকলে তারা নিজেরাও বিপদে পড়তে যাচ্ছেন, তখন সুরুৎ করে বাসার বাইরে বেরিয়ে পড়লেন৷
এদিকে, বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য ছাড়াই হার্ড ইমিউনিটির গল্প বলা শুরু করলেন৷ কেউ কেউ বলে বসলেন কয়েক মাসের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছে যাবেন৷
সঠিক তথ্য ও গবেষণা থাকলে এসব তথ্য মেনে নেয়া যায়৷ কিন্তু সামান্য পড়াশোনা করলেই যেখানে ভাইরাসের স্ট্রেইন বদল ও আগের চেয়ে শক্তশালী হওয়ার ক্ষমতার কথা জানা যায়, সেখানে কোনো তথ্য-উপাত্ত ছাড়া খোদ 'বিজ্ঞানীদের' মুখ এমন ভ্রান্তিকর তথ্যও সরকার ও জনগণকে অনেকটাই উদাসীন হতে সহায়তা করেছে৷
এক বছরেও উদ্ভ্রান্ত পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি। এখনও হাসপাতালে আইসিইউ সংকট। এখন ঘটছে অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ঘটনা। একদিকে করোনার ব্রিটিশ ভ্যারিয়েন্ট বেশি ভয়ঙ্কর হচ্ছে, অন্যদিকে বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ যুক্তরাজ্য ছাড়া ইউরোপের বাকি সব দেশ থেকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। আবার সেই যুক্তরাজ্যই পরের দিন বাংলাদেশ থেকে ভ্রমণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করছে। সেল্যুকাস, তাই না?
জার্মানিতেও প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতি৷
জার্মানিসহ ইউরোপ এবং বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে প্রথম ঢেউয়ে ভালোভাবে করোনা সামলেছে৷ কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপে এসে এখন জার্মান সরকার কী করবে বুঝতে না পেরে নাকানিচুবানি খাচ্ছে।
নভেম্বর থেকে টানা ছয় মাস বিভিন্ন মাত্রায় লকডাউন চলছে। কিন্তু তাতেও কমানো যাচ্ছে না করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু। চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সরকারের জনসমর্থন দ্রুত কমে চলেছে৷ এদিকে রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে দোকানপাট, পর্যটন, সবই বন্ধ থাকায় দেশের অর্থনীতিতে বিপুল চাপ পড়ছে। যারা এসব চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন, তারাও মারাত্মক দুর্ভোগে পড়তে পারেন৷
অন্যদিকে টিকা নিয়েও তৈরি হয়েছে সমস্যা৷ গত বছর বলা হয়েছিল, টিকা আবিষ্কারের কয়েক মাসের মধ্যে অধিকাংশ নাগরিক টিকা পেয়ে যাবেন৷ অথচ যখন সত্যিই বাজারে টিকা এলো, তখন জার্মানির প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন করা টিকাই আর জার্মানিতে পাওয়া যাচ্ছে না৷
ভ্রমণ, টিকা, স্কুল খোলা, দোকান খোলা ইত্যাদি নিয়ে একেক সপ্তাহে একেক ধরনের সিদ্ধান্ত দিচ্ছে জার্মান সরকারও৷
আবার ফিরি বাংলাদেশে৷ এক বছর ধরে বাংলাদেশে স্কুল বন্ধ৷ এর মধ্যে বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যমেলা, বইমেলা, সমাবেশ, ভর্তি পরীক্ষা, দল বেঁধে ঘুরতে যাওয়া, সবই হচ্ছে৷
অন্য অনেক দেশের চেয়ে জনসংখ্যার তুলনায় শনাক্ত ও মৃত্যুর হার বাংলাদেশে অনেক কম৷ সেটার কারণ কী? আবারও কোনো গবেষণা এবং তথ্য ছাড়াই হাজির কিছু বিজ্ঞানী৷ আবারও বলে দিলেন, বাংলাদেশ হার্ড ইমিউনিটির পথে হাঁটছে বলেই এমন ঘটছে৷
তাহলে এখন করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু রেকর্ড করছে কেন? এখন কেন লকডাউন দিতে হলো? করোনা একটা দুর্যোগ৷ এবং এটা ভূমিকম্পের মতো নয় যে আগে থেকে কিছু বোঝা যায় না৷ বরং ঘূর্ণিঝড়ের মতো অনেক আগে থেকে সব জানিয়েই আসছে৷
এরপরও কেন আমাদের কোনো পরিকল্পনা নেই? কেন লাখ লাখ মানুষকে মেলা, পরীক্ষা, সমাবেশ ইত্যাদির নামে এক জায়গায় জড়ো হয়ে করোনা ছড়ানোর সকল ব্যবস্থা করে দিয়ে তারপর লকডাউনের নামে মানুষকে না খাইয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে?
এই লকডাউন নিয়েও নানা প্রশ্ন থেকে যায়৷
১) লকডাউন নামের বস্তুটি পশ্চিমা দেশে কার্যকর করা অনেকক্ষেত্রে সম্ভব৷ তাদের অবকাঠামো, অর্থনীত এই ধাক্কা সামলাতে অনেকটাই সক্ষম৷ অন্যদিকে জনসংখ্যার ঘনত্ব কম হওয়ায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণও অপেক্ষাকৃত সহজ৷
বাংলাদেশে এটা আদৌ বাস্তবসম্মত কিনা, এ নিয়ে কোনো গবেষণা হয়েছে? নাকি টিভি-পত্রিকায় অন্যরা কী করছে দেখে সিদ্ধান্ত কপি-পেস্ট করা হচ্ছে?
২) করোনার সংক্রমণ চেইন ভাঙতে অন্তত তিন সপ্তাহ প্রয়োজন৷ লকডাউন যদি দিতেই হয়, এক সপ্তাহ কেন? কোন যুক্তিতে?
৩) লকডাউনে শিল্প-কারখানা খোলা থাকছে৷ এর আগেও এমনই করা হয়েছিল৷ বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে তথাকথিত 'সচেতন‘ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে অনীহা, সেখানে কারখানার উচ্চবিত্ত মালিকরা 'অসচেতন' নিম্নবিত্ত শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি মানাবেন? এটা অলীক কল্পনা৷ নাকি আমরা ধরেই নিয়েছি শ্রমিকদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, তাদের কিছু হবে না? (বা, হলেই বা কার কী এসে যায়?)
৪) লকডাউনে যারা আর্থিকভাবে ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তাদের জন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থা কি সরকার ভেবেছে?
আর জনগণ তো বলিহারি৷ বিশেষ করে মধবিত্ত৷ যখন মধ্যবিত্তের মনে হবে লকডাউন প্রয়োজন, তখন কেউ না খেয়ে মারা গেলেও সেটা চিন্তা না করে লকডাউন চাপিয়ে দিতে চাইবেন৷ যখন তাদের মনে হবে এবার যথেষ্ট হয়েছে, তখনও অন্য কারো কথা চিন্তা না করে বইমেলা, পরীক্ষা, কক্সবাজার ঘুরতে যাওয়া ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করবেন৷
যখন মসজিদে নামাজ না পরে বাসায় পরার আহ্বান এলো, অনেকে দেখালেন- ব্যাংক তো খোলা, যখন বইমেলা বন্ধের আহ্বান এলো, তখন অনেকে দেখালেন- মসজিদ-মাদ্রাসা তো খোলা৷
সরকার-জনগণ সবাই হয়তো ভাবছেন, একে অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকারটা সেরে ফেলবেন৷ কিন্তু এক্ষেত্রে শিকারটা আপনি নিজেই, সেটা বুঝতে পারছেন?
হুট করে একেক দিন সকালে বৈঠকে বসে একেকটা সিদ্ধান্ত না নিয়ে, অন্য দেশ থেকে সিদ্ধান্ত কপি-পেস্ট না করে, নিজেদের গবেষণা ও তথ্যের ভিত্তিতে নিজেদের মহাপরিকল্পনা জানান৷
কোন কারণে কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে, কী করা যাবে না সেটা নিজেরা স্পষ্ট হোন আগে, তারপর জনগণের কাছে স্পষ্ট করুন৷ নাহলে গত বছরের মতো মাস্ক কেনার ব্যবস্থা না করেই 'মাস্ক কই' বলে মানুষকে পুলিশের লাঠিপেটার মতো ঘটনা ঘটতেই থাকবে৷ তাতে জনগণ-সরকার-স্বাস্থ্যসেবীর বদলে বরং করোনারই লাভ হবে৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে