হুমায়ূন আহমেদের ‘বাদশাহ নামদার’

সেতারা কবির সেতু | Apr 03, 2021 02:39 pm
 ‘বাদশাহ নামদার’

‘বাদশাহ নামদার’ - ছবি : অন্য এক দিগন্ত

 

বিচিত্র সব বিষয়ে আগ্রহ ছিল হুমায়ূন আহমেদের। গল্প, উপন্যাস, ছোটগল্প লিখে যেমন পাঠকের হৃদয় জয় করেছেন, তেমনই সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন নাটক ও চলচ্চিত্রে। হুমায়ূন আহমেদের লেখা প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয়। তার টেলিভিশন নাটকগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তার অন্যতম উপন্যাস হলো মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাতাল হাওয়া, লীলাবতী, কবি, বাদশাহ নামদার ইত্যাদি।

ইতিহাস আশ্রয় করে হুমায়ূন আহমেদ যে ক’টি উপন্যাস লিখেছেন, তার মধ্যে ‘বাদশাহ নামদার’ অন্যতম। ২০১১ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়।

মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের বৈচিত্র্যময় শাসনকাল, তার চরিত্রের খামখেয়ালিপনা এবং তার চারপাশের বহুবর্ণের বিচিত্র মানুষকে ইতিহাসের পাতা থেকে হুমায়ূন আহমেদ তার এই উপন্যাসে চিত্রিত করেছেন। সুন্দর ও সাবলীলভঙ্গিতে মুঘল সাম্রাজ্যের চমকপ্রদ উপস্থাপনে এ উপন্যাসে ইতিহাস জীবন্ত হয়ে পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে সালাহউদ্দিন বাবর ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বাবরের প্রথম পুত্র হুমায়ূন মীর্জা। লেখক মূলত বাদশাহ হুমায়ূনকে কেন্দ্র করেই এই উপন্যাসটি রচনা করেছেন।

কাহিনীসূত্র এমন : সম্রাট বাবর চেয়েছিলেন তার পুত্র হুমায়ূন সিংহাসনের দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু হুমায়ূন ছবি আঁকতে, বই পড়তে, শেয়র রচনা করতে ভালোবাসেন। প্রকৃতিপ্রেমী হুমায়ূনের প্রকৃত সুখ ছিল প্রকৃতির মাঝেই। হুমায়ূন একবার খুব অসুস্থ হলেন। সব চিকিৎসক তার বাঁচার আশা ছেড়ে দিলেন। সম্রাট বাবর নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইলেন মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহর কাছে। ৫০ বছর বয়সে সম্রাট বাবর মারা যান। তার মৃত্যুর তিন দিন পর সিংহাসনের দায়িত্ব নেন হুমায়ূন মীর্জা।

হুমায়ূনের দুই ভাই কামরান মীর্জা আর হিন্দাল মীর্জা শুরু থেকেই তার বিরোধিতা করে আসছে। চিতোরের রানী কর্ণবতী হুমায়ূনের কাছে সাহায্য চেয়ে একটি চিঠি পাঠান। দরবারের আমিররা সবাই মিলে সম্রাটকে নিষেধ করেন যেন রানীকে সাহায্য করা না হয়। কারণ মোঘল সাম্রাজ্য এখন মহাবিপদে। আমিররা বলেন, শাহানশাহ রাজনীতিতে আবেগের কোনো স্থান নাই। উত্তরে বাদশাহ বলেন, আমার রাজনীতিতে আছে। একজনের চরম বিপদে আমি যখন তার পাশে দাঁড়াব, আমার বিপদেও কেউ-না-কেউ আমার পাশে দাঁড়াবে।

বাদশাহ দায়িত্ব পালনের সময় সাথে পান সাহসী সেনাপতি বৈরাম খাঁকে। মোঘল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তার অবদান সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে মোঘল সাম্রাজ্যের শত্রু শেরশাহ শক্তি সংগ্রহ করছে মোঘল সাম্রাজ্য আক্রমণের জন্য। শেরশাহ খুব ভালোভাবে জানতেন শক্তিতে সে কখনই হুমায়ূনকে পরাজিত করতে পারবে না। তাই সে হুমায়ূনের দুর্বল দিককে কাজে লাগিয়ে রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত সৈনিকদের ওপর হামলা চালায়।

বাদশাহ জীবন রক্ষার জন্য নদীতে ঝাঁপ দেন। সেখানে ভিস্তিওয়ালা নাজিম তার জীবন বাঁচায়। শুরু হয় হুমায়ূনের কষ্টের জীবন। হুমায়ূন আশ্রয় নেন বীরভূমে। সেখানেও শেরশাহর লোকেরা আক্রমণ চালায়। বাদশাহ নদীপথে পালিয়ে যাওয়ার সময় বৈরাম খাঁর সাথে দেখা হয়। ভগ্নহৃদয় নিয়ে হুমায়ূন আগ্রায় পৌঁছান।

তার দুই ভাই মোঘল সাম্রাজ্য ফিরে পেতে সব ধরনের সাহায্যের ওয়াদা করেন। ফলে বাদশাহ শেরশাহের সাথে কনৌজের যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু এই যুদ্ধেও বাদশাহর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। পরাজয়ের কারণ ভাইদের বিশ্বাসঘাতকতা। শুরু হয় হুমায়ূনের যাযাবর জীবন।

একদিন মায়ের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য লুকিয়ে রাজদরবারে আসেন। সেখানে দেখা হয় হামিদা বানুর সাথে। হুমায়ূন যে কোনো মূল্যে হামিদা বানুকে বিয়ে করতে চান। এই হামিদা বানুই হয় বাদশাহর পঞ্চম স্ত্রী এবং দুঃসময়ের সঙ্গী। আর হামিদা বানুর গর্ভেই জন্ম নেন পৃথিবীর সেরা নৃপতি সম্রাট আকবর। স্ত্রী হামিদা বানুর সাথে শুরু হয় সম্রাটের পথে প্রান্তরের জীবন। হুমায়ূন বিভিন্ন দুর্গে আশ্রয় নেন। সবাই আশ্রয় দিলেও তাদের মূল উদ্দেশ্য থাকে কোহিনূর হীরা নেয়া এবং সম্রাটকে শেরশাহের হাতে তুলে দেয়া। সেনাপতি বৈরাম খাঁ নিজের জীবনের বিনিময়ে সম্রাটের জীবন বাঁচান।

১৫৪২ সালে জন্ম হয় আকবরের। শিশুপুত্রকে নিয়ে পথে পথে ঘুরতে থাকে তার পিতা-মাতা। বাদশাহ হুমায়ূন আজ বড়ই ক্লান্ত। তিনি এভাবে আর পারছেন না। তিনি সিদ্ধান্ত নেন পারস্য হয়ে মক্কা চলে যাবেন। তাই তিনি পারস্যের সম্রাট শাহ তামাস্পের কাছে আশ্রয় নেন। এদিকে পারস্যের সম্রাটের কাছে মীর্জা কামরান পত্র পাঠান হুমায়ূনকে জীবিত বা মৃত তার হাতে তুলে দিতে। বিনিময়ে তিনি কান্দাহার পারস্য সম্রাটকে উপহার দেবেন।
কিন্তু শাহ তামাস্প তা করলেন না। তিনি হুমায়ূনকে সব ধরনের সহযোগিতা করলেন মোঘল সাম্রাজ্য ফিরে পেতে। হুমায়ূন প্রথমে কান্দাহার জয় করলেন, এরপর কাবুল। হুমায়ূন আবার কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হলেন। সেনাপতি বৈরাম খাঁ এর মধ্যে সিকান্দার শাহকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করেন। বাদশাহ হুমায়ূন সুস্থ হয়ে ১৫৫৫ সালের ২৩ জুলাই দিল্লির সিংহাসনে বসেন।

বইটি পড়তে গিয়ে কিছু ঘটনা পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো হলো: বাদশাহ প্রজাদের দুঃখ কষ্ট দেখার জন্য ছদ্মবেশে রাজ্যে ঘুরে বেরাতেন। নদীর ঘাটে দেখেন, একটি অল্পবয়সী মেয়েকে সতীদাহ করা হচ্ছে। বাদশাহ মেয়েটিকে উদ্ধার করে দরবারে নিয়ে আসেন। মেয়েটি বাদশাহ কন্যার সঙ্গী হিসেবে তার সাথে থাকে। এখানে জাতি ধর্মের মধ্যে বাদশাহ কোনো পার্থক্য করেননি।

বাদশাহর দক্ষ কামানচি রুমী খাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে তিনি চুনার দুর্গ দখলের সময় ৩৫০ মানুষের হাত কেটে নেয়ার আদেশ দেন। রুমী খাঁ বলেন অভিযোগ সত্য। আমি যা করেছি সম্রাটের নিরাপত্তার জন্য করেছি। কারণ তারা সবাই দক্ষ কামানচি। হুমায়ূন এতে ভীষণভাবে অখুশি হন। তিনি বলেন, আপনি ভয়াবহ অন্যায় করেছেন। তার শাস্তি আপনার দুই হাত কেটে নেয়া। এখানে বাদশাহ হুমায়ূন ন্যায়বিচারের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

বাদশাহ যখন দিল্লির সিংহাসনে বসেন, তখন গরিব ভিস্তিওয়ালা তার সাথে দেখা করেন। হুমায়ূন তার ওয়াদা রক্ষায় এক দিনের জন্য তাকে সিংহাসনে বসান। এতে দরবারের সবাই হাসাহাসি করে। হুমায়ূনের ভাইয়েরা এটি মেনে নিতে পারেন না। সবাই যুক্তি দিয়ে বাদশাহকে বোঝানোর চেষ্টা করেন। উত্তরে বাদশাহ বলেন, যুক্তি দিয়ে সবকিছু হয় না। যুক্তির উপরে অবস্থান করে মানুষের হৃদয়। দুঃসময়ে আমরা অনেক কথা দিলেও পরে তা ভুলে যাই। বাদশাহ যেভাবে কথা রেখেছেন তা সত্যিই শিক্ষণীয়।

মীর্জা কামরান বাদশাহকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। কিন্তু তা প্রকাশ পেলে তার শাস্তি হয় মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু বাদশাহ হুমায়ূন তাকে ক্ষমা করে দিয়ে তার সাথে আলিঙ্গন করেন। বাদশাহ বলেন, আমার মহান পিতা মৃত্যুর আগে আমাকে বলেছেন, তুমি সব সময় ভাইদের দেখবে ক্ষমাসুন্দর চোখে। তারা তোমার প্রতি নির্দয় হতে পারে, কিন্তু তুমি নির্দয় হয়ো না। সময়ের সাথে সাথে আমরা কত কিছু ভুলে যাই। দিল্লির সম্রাট পিতার আদেশ ভুলে যাননি।

বাদশাহ হুমায়ূন যখন হামিদা বানুকে বিয়ের প্রস্তাব দেন তখন হামিদা বানু বলেন, আমি এমন একজনকে বিয়ে করব, চাইলেই যার হাত ধরতে পারি, তার পাশাপাশি বসে জোছনা দেখতে পারি। এমন কাউকে বিয়ে করব না যার সামনে যেতে তিনবেলা আমাকে কুর্নিশ করতে হবে। এখানে হামিদা বানুর কথা সহজ সরল এক চিরন্তন নারীমনের পরিচয় তুলে ধরে যার কাছে জীবনসঙ্গীর ভালোবাসাই সবচেয়ে দামি। এ এক সুন্দর জীবনবোধ, যেখানে অর্থ, যশ, খ্যাতির প্রতি কোনো মোহ তার মধ্যে কাজ করেনি।

সাহসী এবং বিশ্বস্ত সেনাপতি বৈরাম খাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি- যুদ্ধ এবং প্রেমে কোনো কিছুই পরিকল্পনা মতো হয় না। পাঠক জানেন, মোঘল সাম্রাজ্যে বৈরাম খাঁর অবদান কতটুকু। কিন্তু হুমায়ূনপুত্র আকবর যখন সিংহাসনে বসেন, তখন তিনি বাধ্য করেন বৈরাম খাঁকে মক্কা যেতে। আবার পথে আকবরের গুপ্তঘাতকরা বৈরাম খাঁকে হত্যা করে। এই ঘটনা পাঠক হৃদয়কে ব্যথিত করেছে। মোঘল শাসকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে পাঠক মনে।

সর্বশেষে বলি, অমর কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ শেষ জীবনে এসে ইতিহাস আশ্রিত এই অসাধারণ উপন্যাসটি রচনা করেছেন। এটি বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। পড়া শেষ হলেও ঘোর কাটতে চায় না। সুখপাঠ্য উপন্যাসটি পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us