মারাত্মক চাপে মমতা!

অন্য এক দিগন্ত | Apr 02, 2021 06:41 pm
মমতা

মমতা - ছবি : সংগৃহীত

 

গত দশ বছরে কখনো এই রকম পরিস্থিতি দেখা যায়নি। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল তৃণমূলের এজেন্ট ভয় পেয়ে বাড়িতে। তাকে আনতে পুলিশ গেছে। কিন্তু তার মা হাতজোড় করে বলছেন, তিনি ছেলেকে পাঠাবেন না। পুলিশ চলে গেলে তার ছেলের নিরাপত্তা কে দেবে? কোথায় হলো এই ঘটনা? নন্দীগ্রামের নির্বাচনে, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। গত দশ বছর ধরে মমতা ব্যানার্জির রাজত্বে এত দিন এই অভিযোগ করে এসেছেন বিরোধীরা। এবার তৃণমূলকেই তা করতে হলো। এই ঘটনা কতটা ইঙ্গিতবাহী?

দীর্ঘদিন ধরে নিজের কেন্দ্রে যেদিন ভোট থাকে ওই দিন বাড়ি থেকে বের হন না মমতা ব্যানাজ্যি। এটাই তিনি নিয়মে পরিণত করেছিলেন। এবারও নন্দীগ্রামের রেয়াপাড়ার বাড়িতে তিনি বেলা ১টা পর্যন্ত ছিলেন। কিন্তু তারপর তিনি বেরোলেন বা বলা ভালো বের হতে বাধ্য হলেন। কারণ, বয়াল গ্রাম থেকে খবর আসছে, তৃণমূলের কাউকে ভোট দিতে দেয়া হয়নি। মমতা গেলেন বয়ালে।

এর পরের পরিস্থিতিও অপ্রত্যাশিত। মমতার গাড়ি সরু রাস্তা দিয়ে ঢুকছে এবং তৃণমূল সমর্থকরা সমানে অভিযোগ করছেন, বিজেপি ভোট দিতে দেয়নি। কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বলেও লাভ হয়নি। মমতা বুথে ঢুকলেন। বুথের বাইরে শুরু হলো বিজেপি ও তৃণমূল সমর্থদের মধ্যে প্রায় হাতাহাতির পরিস্থিতি। মমতা বুথের চত্বরে বসে পড়লেন। তিনি একের পর এক ফোন করতে লাগলেন। রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে তার আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক। তাকে ফোন করলেন। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের ফোন করলেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেন। তৃণমূল নেতারা অবশ্য বলছেন, মমতা ঠিকই করেছেন। তিনি সাংবিধানিক পথে চলেছেন।

মমতা যখন বুথের ভিতরে, বাইরে তখন তুলকালাম হচ্ছে। বিজেপি ও তৃণমূল সমর্থকদের মধ্যে। চীৎকার-চেঁচামিচি হচ্ছে। মাঝখানে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিল। ঘণ্টা দুয়েকের বেশি সময় থাকার পর মমতা বেরোলেন। প্রচুর পুলিশ প্রহরায় তাকে বের করা হলো। তৃণমূলের কর্মীরা তখন স্লোগান দিচ্ছেন, 'জয় বাংলা'। বিজেপি কর্মীরা বলছেন, 'জয় শ্রীরাম'। এর মধ্যে দিয়েই মমতা বের হন। কিছুদিন আগেও এই ছবি ভাবা যেত না। গোটা নন্দীগ্রাম ছিল তৃণমূলের দূর্গ। আর তৃণমূলের হয়ে নন্দীগ্রাম সামলাতেন শুভেন্দু। মমতাকে এত দিন নন্দীগ্রাম দেখার দরকার পড়েনি। যে বয়াল গ্রামে এই ঘটনা ঘটেছে, সেটাও ছিল তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি।

কিন্তু শুভেন্দু বিজেপি-তে চলে যাওয়ার পর অনেক হিসাব বদলে গেছে। শুভেন্দুর পর বয়াল গ্রামের তৃণমূল নেতারাও অনেকে দলবদল করে বিজেপি-র পতাকা হাতে তুলে নিয়েছেন। তার মধ্যে পঞ্চায়েতের প্রধান এবং বেশ কয়েকজন পঞ্চায়েত সদস্যও আছেন। ফলে শুভেন্দুর যোগদানের ফলে বয়ালে রাতারাতি বিজেপি-র শক্তি অনেকখানি বেড়ে গেছে। ভোটের দিন সেটা দেখা গেছে। আর এটা তো শুধু বয়ালে নয়, গোটা নন্দীগ্রামের ক্ষেত্রেই সত্যি। কারণ, নন্দীগ্রাম হলো শুভেন্দু তথা অধিকারী পরিবারের শক্ত ঘাঁটি। দীর্ঘদিন ধরে শিশির ও শুভেন্দু অধিকারী নন্দীগ্রাম ও তার আন্দোলন এবং রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। শুভেন্দুর সঙ্গে সঙ্গে এখানকার অনেকেই দলবদল করেছেন। তার উপর শুভেন্দুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিজেপি এবং মোদী-শাহের শক্তি। যারা এবার সর্বশক্তি দিয়ে মমতাকে হারাতে মাঠে নেমে পড়েছেন। গত কয়েকদিন ধরে তারা পশ্চিমবঙ্গের মাটি কামড়ে পড়ে আছেন। আর ভোটে জিততে তারা সব ধরনের কৌশল নেন। তার উপর এবার নন্দীগ্রামের ভোটে মেরুকরণ বা বিভাজন বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। ফলে মমতার চাপে পড়ার মধ্যে অস্বাভাবিকতা নেই। তার সেই চাপ নন্দীগ্রামের ছবিতে বের হয়েছে বলেও মনে হতে পারে।

তবে দীর্ঘ দিন ধরে মমতা ও তার রাজনীতিকে দেখার সুবাদে এইটুকু বলতে পারি, জনগণের নাড়ি বোঝার একটা ক্ষমতা মমতা ব্যানার্জির আছে। তিনি সবদিক ভেবেই নন্দীগ্রামে লড়েছেন। প্রথমে দ্বিতীয় কোনো কেন্দ্র থেকে লড়বেন ভেবেও পরে একটি কেন্দ্রেই লড়ছেন তিনি। অনেকে মনে করছেন, এটা মমতার কাছে বেশি ঝুঁকি নেয়া হয়ে গেছে। আবার প্রায় ৪০ বছর ধরে মমতাকে খুব কাছ থেকে দেখা সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন, মমতা এই সিদ্ধান্ত আবেগ দিয়ে নয়, মস্তিষ্ক দিয়ে নিয়েছেন। তার মতে, একটা কথা মনে রাখতে হবে, নন্দীগ্রামের ভোটে বয়াল ছাড়া আর দু-একটি জায়গা নিয়ে তৃণমূল অভিযোগ করেছে। ফলে মমতা দুপুরে বয়ালে গিয়ে সব নজর সেই দিকে নিয়ে গিয়েছেন। এটা সম্ভবত তার কৌশলের অঙ্গ ছিল। তিনি দ্বিতীয় কোনো বুথে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি।

কোনো সন্দেহ নেই, নন্দীগ্রামে মমতা কঠিন লড়াইয়ের মুখে পড়েছেন। শুধু নন্দীগ্রাম কেন, পুরো পশ্চিমবঙ্গেই লড়াই হচ্ছে তীব্র, নাছোড় ও মারকাটারি। তৃণমূল শিবির অবশ্য নন্দীগ্রামে জয় নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত। ভোট শেষের পর বুথওয়ারি দলীয় অঙ্ক বলছে, মমতা জিতবেন। কিন্তু ভোটের লড়াইয়ে ফল প্রকাশ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। তবে মমতার কাছে সুখবর হলো, মুসলিমরা নন্দীগ্রামে সদলবলে তাকেই ভোট দিয়েছেন। ফলে তিনি যদি প্রত্যাশামতো হিন্দু ভোট জোগাড় করতে পারেন, তা হলে অনেককে ভুল প্রমাণিত করে জয় ছিনিয়ে আনতেই পারবেন।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে মমতা চাপে নেই। অবশ্যই আছেন। কারণ, তাকে লড়তে হচ্ছে প্রবল শক্তিধর প্রতিপক্ষ বিজেপি এবং মোদী-শাহের সঙ্গে। তারা এখন পুরো শক্তি পশ্চিমবঙ্গ জেতার জন্য কাজে লাগিয়েছেন। যারা ভারতে মোদি-শাহের ভোট কৌশল ও লড়াইয়ের সঙ্গে পরিচিত, তারা জানেন, বিজেপি কতটা শক্তি দিয়ে ভোটে লড়ে। জেতার জন্য সামান্যতম কোনো বিষয়ও ভাগ্যের হাতে ছাড়েন না মোদী-শাহ। সুতরাং তাদের সঙ্গে লড়তে গেলে চাপে থাকাটা স্বাভাবিক। বিশেষ করে লোকসভায় যখন ৪২টির মধ্যে ১৮টি আসন ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেছিলেন মোদি-শাহ। সেখানে মমতার সামান্য ভুলও বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।

তবে একটা কথা ভুললে চলবে না, প্রথম দুই পর্বে যেখানে ভোট হয়েছে, সেখানে বিজেপি শক্তিশালী। উত্তরবঙ্গেও বিজেপি-র শক্তি বেশি। তারপর দক্ষিণবঙ্গে ভোট আসবে, যেখানে তৃণমূলের শক্তি বিজেপি-র তুলনায় অনেক বেশি। তাই প্রথম দুই-তিন পর্বের ভোট দেখে গেল গেল রব তোলা ঠিক হবে না। আরো কয়েক পর্বের ভোটের প্রবণতা দেখতে হবে। তারপর বোঝা যাবে মমতা চাপ অতিক্রম করতে পারছেন, না কি ২০২১ আবার পালাবদলের সাক্ষী হয়ে থাকবে।

সূত্র : ডয়চে ভেলে


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us